জানুয়ারির দলবদল: ইতিহাস কী বলে? এবার দল বদলাতে পারেন কারা?
জানুয়ারির দলবদলের বাজার মানেই কোনও না কোনও ধরনের নাটকীয়তা। মৌসুম শেষের দলবদলের বাজারের মত অসংখ্য রদবদল হয়ত এখানে হয় না; সেই অর্থে বড় অংকের দলবদলগুলোও হয়ত দেখা যায় না। তবে মৌসুমের মাঝে ইনজুরি, স্কোয়াডের শক্তি বাড়ানোর কথা মাথায় রেখে দলবদল নেহায়েত কম হয় না। আর সেটা করতে যেয়ে দলগুলো তাড়াহুড়োও কম করে না। জানুয়ারির বাজারে বড় দলগুলোকেও প্রায়ই ভুল করতে দেখা যায়। আবার বড় দলের অনেক বড় খেলোয়াড় নিজ দলে কোন্দলে জড়িয়ে বা নতুন কোচের পরিকল্পনায় ব্রাত্য হয়ে এই বাজারে নতুন দল খুঁজে নেন। এবারও সেরকমটা হবে বলাই যায়।
জানুয়ারির বাজারের সর্বোচ্চ মূল্য দরে দল বদলানো খেলোয়াড়
মূল্যের দিকটা বিবেচনা করে এই দলবদলের হিসেবের ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায় বেশ কিছু বড় অঙ্কের দলবদলের নমুনা। জানুয়ারির বাজারের সবচেয়ে বেশি দামে যারা নতুন দলে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে শীর্ষ পাঁচে রয়েছেন -
১. ফিলিপ কুটিনিয়ো (লিভারপুল থেকে বার্সেলোনা, ১৪২ মিলিয়ন পাউন্ড)
২. এনজো ফার্নান্দেজ (বেনফিকা থেকে চেলসি, ১০৬.৮ মিলিয়ন পাউন্ড)
৩. ভার্জিল ভ্যান ডাইক (সাউদাম্পটন থেকে লিভারপুল, ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড)
৪. দুশান ভ্লাহোভিচ (ফিওরেন্তিনা থেকে জুভেন্টাস, ৬৬.৬ মিলিয়ন পাউন্ড)
৫. মিখাইলো মুদ্রিক (শাখতার দোনেৎস্ক থেকে চেলসি, ৬২ মিলিয়ন পাউন্ড)
জানুয়ারির বাজারে দল বদলিয়ে সেরাদের কাতারে যারা
তবে এরকম চক্ষু ছানাবড়া দামে দলে এসে অনেকেই সেই মূল্যমানের ভারেই আর ভালো খেলতে পারেননি। আবার কিছু খেলোয়াড় আছেন যাদের মূল্যমান বলতে গেলে নগণ্য ছিল। তবে দিনশেষে তারা ক্লাব তো বটেই, ফুটবল ইতিহাসেই নিজেদের জায়গায় সেরাদের কাতারে নিয়ে গিয়েছেন তাদের। জেনে নেওয়া যাক তেমনি কয়েকজনের কথা।
মার্সেলো
ফ্লুমিনেন্স থেকে ছিপছিপে গড়নের এক লেফট ব্যাককে ২০০৭ সালে দলে ভিড়িয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। তারকাদের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা তখন রিয়াল মাদ্রিদে প্রবল। অথচ ছোট সেই লেফট ব্যাকটাই পরে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসেই সবচেয়ে বেশি শিরোপা জয়ী খেলোয়াড় হিসেবে নিজের নাম লিখিয়ে শৈশবের ক্লাবে ফিরেছেন আবার। মার্সেলোর চেয়ে ভালো সাইনিং বোধহয় জানুয়ারির দলবদলের ইতিহাসেই খুব একটা নেই।
লুইস সুয়ারেজ
লিভারপুলে যখন নাম লেখালেন তখন ২২.৮ মিলিয়ন পাউন্ডের মূল্য নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। হ্যাঁ, আয়াক্সে গোলের পর গোল দিয়ে ইতিমধ্যেই নাম কামিয়েছিলেন সুয়ারেজ; তবে এরডিভিসি নিয়ে আর কয়জনই বা রব তোলে! রব তোলার উপলক্ষ সুয়ারেজ নিজেই করে দিয়েছিলেন। বড় শিরোপাগুলো হয়ত হাতে পাওয়া হয়নি, তবে হালান্ড-সালাহর আগে এক মৌসুমে ৩১ গোল করে প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড বইয়ে নিজের নামটা সবার শুরুতেই খোঁদাই করেি বিদায় নিয়েছিলেন। পরে তো বার্সায় গিয়ে সব জিতে আধুনিক ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফরওয়ার্ড হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন উরুগুয়ের এই কালজয়ী ফরওয়ার্ড।
ভার্জিল ভ্যান ডাইক
সাউদাম্পটন থেকে এক প্রকার তড়িঘড়ি করেি দীর্ঘদেহী ডাচ এক ডিফেন্ডারকে দলে ভেড়ালেন ক্লপ, সেটাও ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডার হিসেবে। দামটা নিয়ে ভুরু কুঁচকানোর লোকের অভাব হয়নি তখন। ক্লপকে নিয়ে হাসি-তামাশার জবাবটা দেওয়ার দায়িত্ব যেন পরে নিজের কাঁধেই বুঝে নিলেন ভ্যান ডাইক। কোচ যে কারণে তাকে দলে আনতে মরিয়া ছিলেন সেটাই কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দিলেন তিনি। লিভারপুলের হয়ে পরে তো আর কিছুই জেতার বাকি রাখেননি।
প্যাট্রিস এভরা
মোনাকো থেকে ৫.৫ মিলিয়ন পাউন্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পাড়ি জমানোর পর শুরুটা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে বেঞ্চে বসেই দিন পার করতে হত এই ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডারকে। তবে নিজেকে প্রমাণ করতে সময় নিলেও রেড ডেভিলদের ইতিহাসের পাতায় পাতায় পরে নিজের নাম সিলগালা করে গিয়েছেন এভরা। শুধু ক্লাব নয় প্রিমিয়ার লেগ ইতিহাসের সেরা লেফট ব্যাকদের নাম বললে শুরুর দিকেই থাকবে তার নাম।
নেমানিয়া ভিদিচ
সার্বিয়ার এই ডিফেন্ডারের নাম নিলেই হয়ত আপনার চোখে ভাসে মাটিতে শুয়ে পড়ে হলেও বুটের ধারালো স্পাইকের তোয়াক্কা না করে হেড দেওয়া; অঝোরে মাথা থেকে রক্ত বেয়ে পড়লেও ব্যান্ডেজ বেঁধেই বুক চিতিয়ে লড়তে মাঠে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া। ভিদিচের তুলনা বোধহয় ভিদিচ নিজেই। স্পারতাক মস্কো থেকে ২০০৬ সালে ৭.৫ মিলিয়ন পাউন্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়ে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসের তর্কসাপেক্ষে সেরা রক্ষণ জুটি গড়েছিলেন রিও ফার্ডিনান্ডের সাথে; সেই সাথে নিজেও জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায় সেরাদের একজন হিসেবেই।
এবারের বাজারে আগুন লাগাতে পারে যেসব দলবদল
আগের মৌসুমগুলোতে এই বাজারে লোনের সংখ্যাটাই বেশি ছিল। তবে গত কয়েক মৌসুম ধরে বড় ক্লাবগুলোতে বড় অঙ্কেই নতুন খেলোয়াড় দলে ভেড়ানোর হিড়িক পড়েছে। বিশেষ করে মালিকানায় পরিবর্তন এলে দল নতুন করে ঢেলে সাজাতে এই বাজারের সুযোগটাও হাতছাড়া করেনি বড় ক্লাবগুলো। এবারের মৌসুমেও তার ব্যত্যয় ঘটবে না। কিছু খেলোয়াড়ের দিকে এবার বেশ কিছু ক্লাবের নজর থাকবে। আবার কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে প্রতিবার গুঞ্জন উঠেই; তবে সেগুলোর কোনও একটা সত্যি হয়ে গেলে পত্রিকায়, ফুটবল বিশ্বে যেন শোরগোল শুরু হয়ে যাবে। সেই দুই ধরনের তালিকা মেলাতে গেলে এবার কাদের নাম আসতে পারে?
কিলিয়ান এমবাপে
গত কয়েক মৌসুম ধরেই দলবদলের বাজারের সবচেয়ে বড় গুঞ্জন তাকে নিয়েই। গত মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের সাথে ছিনিমিনি খেলে, পিএসজির সাথে খোলামেলাভাবেই বিবাদে জড়িয়েও এমানুয়েল মাখোর হস্তক্ষেপে শেষমেশ পিএসজিতে থেকে গিয়েছেন এমবাপে। পরের মৌসুমে তাকে নেওয়ার চেষ্টা আবারও করবে রিয়াল মাদ্রিদ - এই বিষয়েও খুব একটা ধোঁয়াশা নই। তবে লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগে ভাল শুরু করা সত্ত্বেও ফরওয়ার্ডের জায়গাটা নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের মাথাব্যথা থাকছেই। লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে তাই জানুয়ারির বাজারেই এমবাপের দিকে লস ব্লাঙ্কোসরা হাত বাড়ালেও অবাক হওয়ার অবকাশ নেই।
মোহামেদ সালাহ
মৌসুম শুরুর আগে সালাহকে দলে ভেড়াতে শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল আল ইত্তিহাদ, ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের আকাশচুম্বী অর্থের ঝুলি নিয়ে সালাহর পানে চেয়ে রইলেও আল ইত্তিহাদের অর্থের ঝনঝনানি সালাহর কান অব্দি পৌঁছায়নি। তবে নিজেকে কতদিন এই মিশরীয় ফরওয়ার্ড সামাল দিতে পারেন সেটাই দেখার বিষয়। পাঁচে থাকা আল ইত্তিহাদ যে আবারও চেষ্টা করবে সেটা বলাই বাহুল্য। আর এবার যে আরও বেশি অর্থের প্রলোভন তার দ্বারে কড়া নাড়বে সেটাও আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সালাহ যদি শেষমেশ তাতে সাড়া দেন তাহলে দলবদলের বাজারে আগুন লাগবেই লাগবে।
ভিক্টর ওসিমহেন
মৌসুমের শুরুর দিকে নাপোলির টিকটকে তাকে ব্যঙ্গ করা এক ভিডিওতে বেজায় চটেছিলেন ওসিমহেন। নাইজেরিয়ান এই ফরওয়ার্ড পরে সেটা ক্লাবের সাথে মিমাংসা করেছেন; এমনকি গতকাল চুক্তি নবায়নও করেছেন। তবে নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য যে তিনি উন্মুখ সেটা তিনি আগেও জানিয়েছেন। একইসাথে চেলসির প্রতি তার টানের কথাও মাঝে জানিয়েছেন। প্রিমিয়ার লিগে কোনও একদিন পাড়ি জমাতে চান সেটা বলেছেন খোলাখুলি। চেলসির ফরওয়ার্ড সংক্রান্ত জটিলতা ও টড বোয়েলির খরচের মানসিকতা থেকে এই জানুয়ারিতেই তাই তার দিকে হাত বাড়াতে পারে দশ নম্বরে থাকা ক্লাবটি।
জানুয়ারির এই বাজারে দল বদলানোর বাস্তবিক সম্ভাবনা আছে যাদের
ব্রুনো গিমারাইশ
এই জানুয়ারির দলবদলের বাজারেই নিউক্যাসলে এসেছেন ব্রাজিলিয়ান এই মিডফিল্ডার। নিউক্যাসলের হয়ে শুরু থেকেই নিজেকে মেলে ধরেছেন। তবে নিউক্যাসল থেকে তার যাওয়ার প্রশ্নও কেন আসছে? আসছে কারণ বার্সা তার দিকে হাত বাড়াতে পারে। গাভির অনুপস্থিতে বেশ ধুঁকছে বার্সার মিডফিল্ড। ইতিমধ্যে এই ব্রাজিলিয়ানকে নিয়ে তলবও করেছে ক্লাবটি। গাভির বদলি হিসেবে তাই ধারে হলেও তাকে আনতে পারে বার্সা। তবে সেক্ষেত্রে বেতন কাঠামোর মাঝে তাকে অন্তর্ভুক্ত করতে বেশ কিছু খেলোয়াড় অথবা লেভানডোফস্কির মত উচ্চ বেতনধারী কাওকেও বিক্রি করতে হবে কাতালান এই ক্লাবটিকে।
বিকল্প: অবশ্য তাদের জন্য আরও বাস্তবিক চাল হতে পারে থিয়াগো আলকানতারার দিকে এগুনো। ইনজুরির কারণে লিভারপুলের প্রথম সারির পরিকল্পনা থেকে দূরে তো ছিলেন বটেই; শবজলাই, এনদো, ম্যাক-অ্যালিস্টারদের মত দারুণ সব সাইনিংয়ে দলে জায়গা পাওয়াটা কঠিন হয়ে গিয়েছে এই স্প্যানিশের জন্য। এই মৌসুমের জন্য তাই তাকে লোনে নেওয়ার কথা ভাবতে পারে বার্সা।
ইভান ফার্গুসন
ব্রাইটনের হয়ে ইতিমধ্যে হ্যাটট্রিকও করে ফেলেছেন তরুণ এই ইংলিশ ফরওয়ার্ড। জানুয়ারির বাজারে তাকে পেতে হয়ত অনেক ক্লাবই হন্যে হয়ে থাকবে। তবে হ্যারি কেইনকে না পাওয়া ও নতুন খেলোয়াড় রাসমুস হয়লুন্ডের এখনও প্রিমিয়ার লিগে গোলের খাতা খুলতে না পারার কারণে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হয়ত জোরেশোরেই এই দৌড়ে শামিল হবে। সেই সাথে গতকালই স্যার জিম র্যাটক্লিফ পেয়েছেন ক্লাবের পঁচিশ শতাংশ মালিকানা। তাই জেডন সাঞ্চোকে ছেড়ে দিয়ে নতুন আরেকজন স্ট্রাইকারের সন্ধানে তারা নামবে বলাই যায়।
বিকল্প: এছাড়াও বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার কারণে ফুটবলের বাইরে থাকা আইভান টোনিকেও বিবেচনা করতে পারে তারা। জানুয়ারির মাঝামাঝি নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে যাওয়া এই ইংলিশ ফুটবলারের জন্য অবশ্য আর্সেনাল হাত বাড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি।
ডগলাস লুইজ
মৌসুম শুরুর আগেই তাকে নিয়ে আর্সেনালের আগ্রহ থাকলেও অ্যাস্টন ভিলা সাফসাফ না করে দিয়েছিল। ভিলা যে মৌসুমে বড়দিনের আগে তিনে আছে তাতে এই ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডারের অবদান অসামান্য। থমাস পার্টেকে ছেড়ে দিয়ে কেন এই ব্রাজিলিয়ানকে পেতে চাইছিলেন আরতেতা সেটা তিনি প্রমাণ করেই চলেছেন। জানুয়ারির বাজারে নিজেদের মিডফিল্ডের শক্তি বাড়িয়ে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপাটা ছুঁয়ে দেখতে আরতেতা হয়ত আবারও তার দিকে তাই হাত বাড়াবেন।
বিকল্প: তবে তাকে না পেলে আবারও ফুলহামের জোয়াও পালিনহার দিকে হাত বাড়াতে পারে গানার্সরা।