• ক্রিকেট, অন্যান্য
  • " />

     

    মেইকশিফট ওপেনার : ক্যাটিচ-শেবাগ-জয়সূরিয়াদের পথেই স্মিথ?

    মেইকশিফট ওপেনার : ক্যাটিচ-শেবাগ-জয়সূরিয়াদের পথেই স্মিথ?    

    বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ার শেষে  টেস্ট ক্রিকেট ছেড়েছেন ডেভিড ওয়ার্নার। ওপেনিংয়ে তার রেখে যাওয়া জায়গায় কাকে খেলাবে অস্ট্রেলিয়া, সেই আলোচনা বেশ জমে উঠেছিল। অজিদের পরবর্তী ওপেনার হিসেবে স্টিভেন স্মিথের সাথে শোনা যাচ্ছিল ক্যামেরন ব্যানক্রফটের নামও। তবে আজ প্রধান নির্বাচক জর্জ বেইলি জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার পরবর্তী টেস্ট ওপেনার স্মিথই। উইন্ডিজের বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট থেকেই ওপেন করবেন স্মিথ, জানান বেইলি। 

    ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে ওপেনিংয়ে ব্যাট করা স্মিথের জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জই। এর আগে টেস্টে কখনো ওপেন করেননি ডানহাতি এই ব্যাটার। ১০৫ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৬৭ ম্যাচেই স্মিথ ব্যাট করেছেন চার নম্বর পজিশনে। 

    চার নম্বরে স্টিভেন স্মিথ 

    ম্যাচ : ৬৭ 

    ইনিংস : ১১১

    রান : ৫৯৬৬ 

    গড় : ৬৪.৫০

    সেঞ্চুরি : ১৯ 

    ফিফটি : ২৬

    ওপেনার স্মিথ কেমন করবেন সেটা সময়ই বলবে। অবশ্য টেস্ট ক্রিকেটে এর আগে দেখা গেছে এমন অনেক মেইকশিফট ওপেনারকে, যারা উঠে এসেছিলেন টপ বা মিডল অর্ডার থেকে। 

    অস্ট্রেলিয়াতেই আছে এমন অনেক উদাহরণ আছে। গেল ৭০ বছরে মেইকশিফট ওপেনার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ব্যাট করেছেন আটজন। বব সিম্পসন থেকে শুরু করে উসমান খাওয়াজা; মাঝে আছেন কিথ স্ট্যাকপোল, ডেভিড বুন, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, সাইমন ক্যাটিচ, শেন ওয়াটসনের মতো বড় নাম। অস্ট্রেলিয়ার বাইরে হিসেব করলে সনৎ জয়সুরিয়া, মারভান আত্তাপাত্তু, ডেনিস অ্যামিস, বীরেন্দ্র শেবাগদের, রোহিত শর্মাদের নামও আসবে এই তালিকায়।

    মেইকশিফট ওপেনারদের কে কেমন? 


    সাইমন ক্যাটিচ

    অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের স্বর্ণযুগে টেস্ট অভিষেক সাইমন ক্যাটিচের। যখন একটা পজিশনের জন্য যোগ্য ক্রিকেটার ছিল কয়েকজন। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে ক্যাটিচ টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন আদর্শ মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে। ২০০৮ সালে প্রথমবার ওপেনিংয়ে নামার আগে তার ব্যাটিং অর্ডার উঠানামা করেছে তিন থেকে সাত নম্বর পজিশনে। ব্যাটিং অর্ডার নির্দিষ্ট না থাকায় পারফর্ম্যান্সেও পড়েছিল প্রভাব। ক্যারিয়ারের প্রথম সাত বছরে খেলেছিলেন মাত্র ২৩ ম্যাচ। 

    অবশ্য ২০০৮ সালে ম্যাথু হেইডেনের সাথে ইনিংস ওপেন করেছিলেন প্রথমবার। মেইকশিফট ওপেনার হিসেবে সব মিলিয়ে খেলেছেন ৩৩ ম্যাচে। দুই বছর ওপেনিং করে তার ব্যাটিং গড় পেরিয়েছিল পঞ্চাশের ঘর। ৬১ ইনিংসে ৫০.৪৮ গড়ে তুলেছেন ২৯২৮ রান। অজি ওপেনারদের ব্যাটিং গড়ের হিসেবে বিচার করলে ক্যাটিচের নাম ওপরের দিকেই থাকবে। 

    সনৎ জয়সুরিয়া

    ১৯৯৬ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল লংকানরা। সেই বছরই ক্যারিয়ারের সেরাটা দেয়ার শুরু করেছিলেন সনৎ জয়সুরিয়া। ওয়ানডে তো বটেই, বিশেষত টেস্ট ক্রিকেটে ওপেনার হিসেবে নিজের সত্তা খুঁজে পান বাঁহাতি এই ব্যাটার। ১৯৯১ সালে মিডল অর্ডারে ক্যারিয়ার শুরু করা জয়সূরিয়া  প্রথম পাঁচ বছর নিজের জায়গাই পাক করতে পারেননি টেস্ট দলে। মূলত খেলতেন অলরাউন্ডার হিসেবে। যে লোয়ার অর্ডারে কিছু রান করে দেবে সাথে বোলিং তো থাকছেই। 

    সেই প্লেইং রোলে তার ব্যাটিং অত কার্যকরী না হওয়ায় তৎকালীন অধিনায়ক অরভিন্দ ডি সিলভা একটা জুয়া খেলে বসেন জয়সূরিয়াকে নিয়ে। রোশান মাহানামার বদলে ওপেনিং করতে পাঠিয়েছিলেন তাকে। ব্যস! এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। সুযোগ পেয়ে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেন ১১২ রানের ইনিংস। সেখান থেকেই শুরু। সব মিলিয়ে তার করা ১৪ টেস্ট সেঞ্চুরির ১৩টিই এসেছে ওপেনার হিসেবে। টেস্ট  ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ওপেনার হিসেবে শ্রীলংকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও ব্যাটিং গড় নিয়ে।

    মারভান আতাপাত্তু 

    মারভান আতাপাত্তুর টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল দুঃস্বপ্নের। চার বছরের ব্যবধানে খেলেছিলেন  প্রথম পাঁচ টেস্ট। সেই পাঁচ টেস্টের  ছয় ইনিংসেই ছিল তার ডাক। এমন দুর্দশাগ্রস্ত পারফরম্যান্সের কারণে টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ে যান তিন বছরের জন্য। ১৯৯৪ তে বাদ পড়ে ১৯৯৭ সালে দলে ফেরার পর তাকে খেলানো হয় তিন নম্বরে। সেখানেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি।

    তবে তাকে নিয়ে অর্জুনা রানাতুঙ্গার ধরা বাজিটা কাজে লেগে গিয়েছিল। বলা চলে এক সিদ্ধান্তেই ঘুরে গিয়েছিল আতাপাত্তুর ক্যারিয়ারের মোড়। ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজে রানাতুঙ্গা তাকে পাঠান ওপেনিংয়ে। সেই টোটকাতেই লাল বলের ক্রিকেটে সফল আতাপাত্তু। ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ওপেনার হিসেবে শ্রীলংকার তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে। ওপেনার হিসেবেই আছে ছয়টি ডাবল সেঞ্চুরি। যার ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল হোঁচট খেয়ে মিডল অর্ডারে, সেই আতাপাত্তুই লংকান ক্রিকেটের সেরাদের একজন। 

    বীরেন্দ্র শেবাগ

    অভিষেক টেস্টে মাখায়া এনটিনি-শন পোলকদের পিটিয়ে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বীরেন্দ্র শেবাগ। তা ছয় নম্বরে নেমে। বিনোদনদায়ী ব্যাটিংয়ে ফ্যান ফেভারিট হয়ে উঠলেও সেরা একাদশে তাকে জায়গা করে দিতে তখন হিমশিমই খেয়েছিল ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট। কারণ মিডল অর্ডারে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মনের মতো প্রতিষ্ঠিত সব নাম। সেই অবস্থা থেকে ভারতকে তুলে আনেন তৎকালীন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। ছয় টেস্ট খেলা শেবাগকে পাঠিয়ে দেন ওপেনিংয়ে। 

    এরপর ওপেনার হিসেবে ৫০.২৪ গড়ে শেবাগ করেছেন ৮১২৪ রান। ওপেনারদের তালিকায় ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ও ব্যাটিং গড়ের সাথেই ক্যারিয়ার শেষ করেছেন তিনি। 

    উসমান খাওয়াজা

    ডেভিড ওয়ার্নারের বাল্যবন্ধু ও দীর্ঘদিনের ওপেনিং সঙ্গী উসমান খাওয়াজা ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন টপ অর্ডার ব্যাটার হিসেবে।বে ৬৯ টেস্টের ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ ম্যাচেই ব্যাট করেছেন এই পজিশনে। চারে-পাচ-ছয়েও দেখা গেছে বাঁহাতি এই ব্যাটারকে। দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকায় পারফরম্যান্সের গ্রাফও উঠানামা করেছে নিয়মিত।  তবে ওপেনার হিসেবে বলার মতো সফলতা পেয়েছেন ২০২২ সালের অ্যাশেজ থেকে। ক্যারিয়ারের একটা পুনর্জন্মই হয়েছে তার সেবারের ঘরের মাঠের অ্যাশেজে। 

    ওপেনার হিসেবে কতটা সফল খাওয়াজা?  ভিন্ন পজিশনে ব্যাট করে খাওয়াজা ২৬৪১ রান করেছেন ৩৯.৪১ গড়ে। কিন্তু ওপেনার হিসেবে তার ব্যাটিং গড় অস্ট্রেলিয়ারই সর্বোচ্চ এখন। ২৯ ম্যাচে ২৫৮৩ রান করেছেন ৫৭.৪০ গড়ে। 

    রোহিত শর্মা

    রোহিত শর্মার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে। একই ব্যাটিং পজিশন অর্থাৎ ছয় নম্বরে ব্যাট করে প্রথম দুই টেস্টেই পেয়েছিলেন টানা সেঞ্চুরি। সাদা বলের ক্রিকেটে তাকে ওপেনার হিসেবে প্রোমোশন দিয়েছিলেন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। সেই টোটকা কাজে লেগেছে বেশ। ভারতের সাদা বলের ওপেনারদের তালিকায় রোহিতের নাম থাকবেই। 

    কিন্তু ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত  লাল বলের ক্রিকেটে মিডল অর্ডারে ব্যাট করায় ওপেনার রোহিতের স্কিলসেট আড়ালেই ঢাকা ছিল। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর বিরাট কোহলির সিদ্ধান্তে রোহিতকে নিয়ে আসা হয় ওপেনিংয়ে। এবং প্রথমবার ওপেন করতে নেমেই টানা দুই ইনিংসে করেছেন সেঞ্চুরি। একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরিটিও রোহিত পেয়েছেন ওপেনার হিসেবেই। 

    এখন পর্যন্ত খেলা  ৫৪ টেস্টের ২৭টিতেই রোহিত ব্যাট করেছেন মিডল অর্ডারে। যেখানে ২৭ ম্যাচে রোহিতের ১৪৭৮ রান, ব্যাটিং গড় ৪২.২২। ওপেনার হিসেবে ২৭ ম্যাচের ৪৫ ইনিংসে ২১৫২ রান করেছেন রোহিত ৫১.২৩ গড়ে। ১০ সেঞ্চুরির সাতটাই ওপেনার হিসেবে ব্যাট করে। 

    মেইকশিফট ওপেনার হিসেবে খেলানোয় রোহিতের টেস্ট ক্যারিয়ারও পেয়েছে নতুন জীবন। ৩২ বছর বয়সে ২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিশাখাপাটনাম টেস্টের সেই দুই ইনিংসের পর রোহিতের ব্যাটিং অর্ডার নির্দিষ্ট হয়ে গেছে ওপেনিংয়েই।

    টেস্ট ক্রিকেটে আগে কখনোই ওপেনিং না করা স্মিথ চাইলে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন আতাপাত্তু-জয়সূরিয়াদের কাছ থেকে। যাদের মধ্যে দ্বিতীয়জনের শুরু হয়েছিল বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে মিডল অর্ডারে। স্মিথও টেস্ট আঙিনায় এসেছিলেন লেগ স্পিনার হয়ে। সেখান থেকে ব্যাটিংয়ে উন্নতি করে হয়েছেন বর্তমানের সেরাদের একজন। তার ব্যাটিং প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক বলেছেন, স্মিথ হয়তো ভেঙে দিতে পারেন ব্রায়ান লারার ৪০০ রানের রেকর্ডও। সেটা হবে কিনা, নিশ্চিত নয়। তবে ক্যারিয়ারের নতুন এক অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে স্মিথের ৩৪ বছর বয়সে। ওপেনার হিসেবে তার শুরুটা কেমন হবে? তার জন্য অপেক্ষা এবার ১৭ জানুয়ারির অ্যাডিলেড টেস্টের।