• অন্যান্য
  • " />

     

    শামার জোসেফ: গায়ানার সিকিউরিটি গার্ড থেকে অ্যাডিলেডে স্বপ্নের অভিষেক

    শামার জোসেফ: গায়ানার সিকিউরিটি গার্ড থেকে অ্যাডিলেডে স্বপ্নের অভিষেক    

    অ্যাডিলেইডের ক্যাথিড্রাল এন্ড থেকে বল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক আনকোরা ক্যারিবিয়ান ছোকরা। সামনে আধুনিক যুগের টেস্ট ক্রিকেটের সেরাদের সেরা। অভিষেকেই স্টিভ স্মিথকে বল করতে গেলে মাথায় অনেক কিছুই ঘুরপাক খাওয়ার কথা; নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসার কথা; দৃষ্টিও হয়ত কিছুটা ঘোলাটে হয়ে এসেছিল এই পেসারের। রান-আপ পুরোটা নিয়েও শেষ মুহূর্তে আর বল ছুড়লেন না। স্মিথের বিপক্ষে প্রথম বলটা কেমন হওয়া উচিৎ সেটা ঠিক করতেই যেন হিমশিম খাচ্ছিলেন। তবে নিজেকে সামলে নিলেন, যেমনটা নিয়েছেন জীবনের প্রতি মুহূর্তেই।

    কিছুটা ধীর লয়ে শিকারির মত এগিয়ে এলেন তিন স্লিপ ও এক গালির আক্রমণ সাজিয়ে। গুড লেংথে, পঞ্চম স্টাম্পের লাইনে বল ফেললেন; আর স্মিথও বিষম খেয়ে গেলেন বলের বাউন্সে, ক্যাচ দিয়ে বসলেন দ্বিতীয় স্লিপে। স্মিথের টেস্ট ওপেনিংয়ের শুরুটা একেবারই মনমত হল না; কিন্তু ওই লাল চেরি হাতে দৌড়ে আসা ছোকরা? স্বপ্নকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বাস্তবে রূপ দিলেন। সেই ছোকরা - শামার জোসেফ - যার জন্য ক্রিকেটে আসাটাই কোনও এক চলচিত্রের গল্পের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। গায়ানার ৩৫০ ছুঁইছুঁই জনসংখ্যার বারাকারা গ্রাম থেকে এসে টেস্টের প্রথম বলেই উইকেট নেওয়া তো আর নেহায়েত মুখের কথা নয়!

    মুখেই বুলি ছুটিয়ে নিভিয়ে যাওয়ার পাত্র যে জোসেফ নন সেটা এতক্ষণে টের পেয়ে গিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্রেসিং রুম। দলের বিপদে শেষ ব্যাটার হিসেবে নেমেই অভিষেক এগার নম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েছেন। মিচেল স্টার্কের খুনে বাউন্সার তার হেলমেটের গ্রিল কাঁপিয়ে দিয়েছিল; তাতে অবশ্য তার বয়েই গেল! তাকে তো পরোয়া করেননি, জশ হেজলউডকেও পাঠালেন গ্যালারিতে। রেকর্ড সেই ইনিংস খেলে এসে ড্রেসিং রুমে ঘোষণা দিলেন - প্রথম বলেই আমি উইকেট পাব আজ। যেই বলা সেই কাজ! নবম ওভারে বল হাতে নিয়েই পেয়েছেন স্মিথের প্রতীক্ষিত উইকেট।

     

    *****

    তবে শুধু এই উইকেট নয়, ক্রিকেটের বাইশ গজের জন্যই ছিল তার বহুল প্রতীক্ষা, প্রচুর ত্যাগ-তিতিক্ষা। গায়ানার ছোট্ট গ্রাম বারাকারাতে কেউ সেই অর্থে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। হ্যাঁ, ক্ষুতপীড়িত কোনও গ্রাম সেটা নয়। তবে প্রত্যন্ত সেই গ্রামে খেটে খেতেই হয় বেশীরভাগকে। তবে ব্যাট-বলের নেশা ছোট শামারকে পেয়ে বসেছিল শুরু থেকেই। ওই গ্রামে ক্রিকেটের সরঞ্জাম পাওয়াই দুষ্কর; আর ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য আদর্শ কোনও জায়গা তো আরও! বাল্যকালের নেশা কী আর সেসবে হার মানে? শামারও তাই উপায় খুঁজে নিলেন। নিজের মত করেই নিজেকে ঝালিয়ে তুলতে থাকলেন। হাতে-কলমে শেখাটা অবশ্য তখন আর হয়ে উঠল না।

    সেই ক্রিকেট দীক্ষা না পাওয়াতে বাস্তবতাও তখন কিছুটা গ্রাস করে বসেছে। রোজ খাওয়ার জন্য মাছ ধরতে হত, বাড়ির পাশের ক্ষেতে সবজি ফলাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেই হত। পরিবারের রুটি-রুজির হাল ধরার বয়সটাও কিছুদিন পর দরজায় কড়া নাড়ল। বাস্তবতা মেনে নিয়েই শামার তাই চাকরি নিলেন এক সিকিউরিটি ফার্মে। তবে ওই সিকিউরিটি গার্ডের নৈশকালীন চাকরির পাশাপাশি বাইশ গজ মাড়ানোটা কিন্তু থামালেন না। আর তার এই কঠোর অধ্যবসায় চোখ এড়াল না গায়ানার ক্রিকেট পরিচালকদের। শুধু তো খেলাটার প্রতি অসামান্য নিবেদন নয়, ছেলেটার হাতে গতিও রয়েছে। গায়ানার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাই ডাক পড়ল শামারের। স্বপ্নের গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলার পথটা শুরু সেখান থেকেই।

     

    *****

    চলার পথে ক্রিকেটে তো এখন সুযোগের কমতি নেই; শুধু লুফে নেওয়ার পালা। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দৌরাত্ম্যে বোলারদের হাত ঘোরানোর ডাকতো অহরহই পড়ে। শামারকেও ডাকা হল গায়ানা অ্যামাজন ওয়ারিওর্সের নেট বোলার হিসেবে। ওমা! একজন নেট বোলার নিয়মিত ১৪৫কিমি./ঘণ্টার আশেপাশেই বল দিয়ে যাচ্ছে; ব্যাটারদের দম ফেলার সুযোগ দিচ্ছে না। নির্বাচকদের তো চক্ষু ছানাবড়া! ছেলেটাকে সিপিএলে সেবারই নামিয়ে দিতে দুবারও ভাবলেন না তারা। ২০২৩ ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে হুট করেই সুযোগ পেয়ে গেলেন। বদলি বোলার হিসেবে দলে ভেড়ানো হলেও ২ ম্যাচে নামার সুযোগও পেয়ে গেলেন। উইকেটের খাতা খুলতে না পারলেও গতিটা নজর এড়ায়নি কারও।

    সেই গতির সুবাদেই এরপর ডাক পড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ দলে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেকেই তিন উইকেট নিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন লাল বলটাকে বেশ কথা বলাতে পারেন তিনি। বারাকারায় তার হয়ে গলা ফাটিয়েছেন অনেকেই; ক্রিকেটটা ঠিক তাদের গ্রামের সাথে না গেলেও পাশে পেয়েছেন এলাকার মানুষদের। তাই ওই ছোট একটা বলকে পোষ মানাতে আর কতক্ষণই বা লাগবে তার! তার ওপর ছোট্ট শামার তো স্বপ্নই দেখতেন হাল না চরিয়ে ক্রিকেটের বাইশ গজ চরানোর। স্বপ্নের সেই দিনটাও চলে এল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নজর কাড়ার পর। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টের জন্য স্কোয়াড ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনায় চলে এলেন শামার। এরপরের গল্পটা তো এতক্ষণে জেনেই গিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা চার বোলারের চোখে চোখ রেখে লড়েছেন, প্রথম বলেই আধুনিক ক্রিকেটের সেরাদের একজনকে ফিরিয়েছেন, এরপর ফিরিয়েছেন সাবেক এক নম্বর লাবুশেনকেও। সিকিউরিটি গার্ডের দায়িত্বের সেই দিনগুলো থেকে ক্যারিবিয়ানদের হয়ে লাল বলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া শামার অবশ্য এখন বলতেই পারেন - একটু সবুর করুন, সবে তো গল্পের শুরু; ছবি তো এখনও বাকি আছে, বন্ধু!