বার্সেলোনায় জাভি-যুগ: শুরুর আগেই শেষের পথে
এমন কোন একটা সিদ্ধান্ত যে আসতে পারে, সেটা একেবারে অকল্পনীয় ছিল না। বরং সর্বশেষ কিছুদিনে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার যে মাঠের পারফরম্যান্স, তাতে সিদ্ধান্তটা কোন পক্ষ থেকে আসবে, সেটাই ছিল কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা এলো ম্যানেজার জাভির তরফ থেকেই। মৌসুম শেষেই শৈশবের ক্লাবের কোচিংয়ের দায়িত্ব থেকে থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিয়েছেন জাভি।
“সিদ্ধান্তটা আমি বেশ কিছুদিন আগেই নিয়েছি। আমার মাথায় কয়েকদিন ধরেই ছিল এটা। আমার মনে হয়, এখন সেটা সবার সামনে জানানোর সময় এসে গেছে। আমি ক্লাবের জন্য কোন সমস্যা তৈরি করতে চাই না, আমি হতে চাই সমস্যার সমাধান।”
-জাভি হার্নান্দেজ, ম্যানেজার, ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা
[জাভি হার্নান্দেজ; ছবি: গেটি ইমেজেস]
সংবাদ সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তটা বেশ কিছুদিন আগেই নেওয়ার কথাটা জাভি বলছেন বটে, তবে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষের ম্যাচের ৮৪ থেকে ১০২তম মিনিটের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যে তাতে ভূমিকা রাখেনি, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। ১৯ মিনিটের ঝড়ে, ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা বার্সেলোনা ম্যাচটা হেরে বসে ৩-৫ ব্যবধানে। এরপরই হতাশ জাভির অমন সিদ্ধান্ত।
চলতি মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের গ্রুপে রয়্যাল অ্যান্টোয়ার্প আর শাখতার দোনেৎস্কের বিপক্ষে পরাজিত হয়েছে বার্সেলোনা। লা লিগায় চার গোল হজম করে হেরেছে জিরোনার কাছে, স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালে সমসংখ্যক গোল করেছে রিয়াল মাদ্রিদও। এরপর তো ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে ঐ পাঁচ গোল হজম। সোমবারের পয়েন্ট তালিকা অনুসারে, বার্সেলোনা রয়েছে লা লিগার তিন নম্বরে, রিয়াল মাদ্রিদ ও জিরোনার থেকে যথাক্রমে আট ও ছয় পয়েন্ট পিছিয়ে। এর বাইরে কোপা দেল রের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেও বিদায় নিয়েছে বার্সেলোনা, সেটিও অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে চার গোল হজম করে।
[ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে বড় হারের পরই জাভি ঘোষণা দিয়েছেন বিদায়ের; ছবি: গেটি ইমেজেস]
কিন্তু, গত মৌসুমেই লিগ আর সুপার কাপ জেতা বার্সেলোনার এই দশা কেন?
উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করেছে অপ্টা অ্যানালিস্ট।
১. চোট এবং দলবদল
চলতি মৌসুমে বার্সার শিবিরে একের পর এক চোট আঘাত হেনেছে।
নিয়মিত গোলরক্ষক মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগানের কথাই ধরা যাক। গত মৌসুমে বার্সেলোনার লিগ জয়ের পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল এই জার্মানের। অপ্টার এক্সপেক্টেড গোলস অন টার্গেট (এক্সজিওটি) এর হিসেবে, ৯.১৫টা গোল আটকে দিয়ে বার্সাকে শিরোপার পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন টের স্টেগান, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে অন্তত ৫০০ মিনিট খেলা সকল গোলরক্ষকের মধ্যে যা পঞ্চম সেরা। চলতি মৌসুমেও দারুণ ফর্মে ছিলেন তিনি, ১,১৭০ মিনিট খেলে ১.৩৪টি গোল আটকেছিলেন। এরপরই পড়লেন পিঠের ইনজুরিতে, মাঠের বাইরে চলে গেলেন কয়েক মাসের জন্য।
[ছবি: অপ্টা অ্যানালিস্ট]
টের স্টেগানের পরিবর্তে বার্সার গোলবার সামলানোর দায়িত্ব ছিল যার ওপর, সেই ইনাকি পেনা কেবল প্রমাণ রাখলেন নিজের অনভিজ্ঞতার। লা লিগায় বার্সার পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে, প্রথম ৮১০ মিনিটেই তিনি হজম করেছেন ১৬টি গোল, অপ্টার এক্সজিওটি মডেলের চেয়ে যা ২.৯টি বেশি। অর্থাৎ যেকোন সাধারণ গোলরক্ষক যেখানে ১৩.১টি গোল হজম করবেন, ইনাকি পেনা সেক্ষেত্রে হজম করেছেন ১৬টি গোল। সব মিলিয়ে চলতি মৌসুমে বার্সেলোনা হজম করেছে ২৯টি গোল, লা লিগার ১২টি দল এর চেয়ে কম গোল হজম করেছে।
[ছবি: অপ্টা অ্যানালিস্ট]
গোলরক্ষণ ছেড়ে এবার আসা যাক মাঝমাঠে। জাভির সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাবলো গাভি চোটে পড়লেন মৌসুমের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, ছিটকে গেলেন পুরো মৌসুমের জন্য। অথচ গাভির মতো একজন মিডফিল্ডার যে জাভির সিস্টেমে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝা গিয়েছিল মৌসুমের প্রথম এল ক্লাসিকোতে। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে, বিশেষত দারুণ ফর্মে থাকা জুড বেলিংহামের বিরুদ্ধে, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন গাভি। নিজের অসাধারণ নৈপুণ্যে ঐ ম্যাচে জোড়া গোল পেয়েছিলেন বেলিংহাম, তবে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে গাভির প্রশংসনীয় কার্যকারিতা তাতে মিথ্যা হয়ে যায় না।
শুধু গাভি বা টের স্টেগান নন, চোট আঘাত হেনেছে জাভির একাদশের আরেক অপরিহার্য অংশ, আলেহান্দ্রো বালদেকেও। এই টের স্টেগান, গাভি এবং বালদেই ছিলেন বার্সেলোনার হয়ে গত মৌসুমে সর্বোচ্চ গেমটাইম পাওয়া পাঁচজনের মধ্যে। অপরদিকে, ২০২২-২৩ মৌসুমে সহস্রাধিক মিনিট খেলা সার্জিও বুসকেটস, জর্দি আলবা, ওসমান ডেম্বেলে, এরিক গার্সিয়া, আনসু ফাতিরা এই মৌসুমে দল ছেড়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই, দলের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে বারবার।
২. বুসকেটসের অনুপস্থিতি
সর্বশেষ মৌসুমের শেষেই বার্সেলোনা ছেড়ে ইন্টার মায়ামিতে যোগ দিয়েছেন সার্জিও বুসকেটস। শেষ দিকে নিজের সেরা ফর্মে তিনি ছিলেন না সত্যিই, তবুও বুসকেটসের রিপ্লেসমেন্ট খুঁজতেই হতো বার্সেলোনাকে। আর চলতি মৌসুমটা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে বলেই দেওয়া যায় যে সেই কাজে বার্সা আপাতত ব্যর্থ।
[ওরিয়ল রোমেউ, মোটাদাগে ব্যর্থ; ছবি: গেটি ইমেজেস]
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ৩২ বছর বয়সী ওরিয়ল রোমেউকে দলে টেনেছিল বার্সেলোনা, তবে তার কাছ থেকে পায়নি আশানুরূপ পারফরম্যান্স। এখন পর্যন্ত মাত্র ৭১৬ মিনিট খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। যে দশটা ম্যাচে শুরুর একাদশে ছিলেন, প্রতিটিতেই তাকে সাব আউট করেছেন কোচ। ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে তো ম্যাচের মাঝ বিরতিতেই তাকে তুলে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং এবং পেদ্রিকে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে ব্যবহার করেন জাভি।
[ছবি: অপ্টা অ্যানালিস্ট]
গত মৌসুমে প্রতি নব্বই মিনিটে গড়ে ৯৩.১ বার বলে স্পর্শ করেছিলেন ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, এই মৌসুমে সেটা বেড়ে হয়েছে ১১০.৫-এ। কারণটাও স্বাভাবিক, বুসকেটস না থাকায় রক্ষণের কাছে থেকে খেলা তৈরিতে বাড়তি ভূমিকা রাখতে হচ্ছে ফ্রেঙ্কিকে। তবুও, এখনো বুসকেটসের ‘রিপ্লেসমেন্ট’ হতে পারেননি ফ্রেঙ্কি, বরং বুসকেটসের মতো কারো পাশে খেলতেই যেন তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ।
[ছবি: অপ্টা অ্যানালিস্ট]
এই সমস্যাটা যে হবে, সেটা অনুমিতই ছিল। মার্টিন জুবিমেন্দি বা ইয়োশুয়া কিমিখের মতো দারুণ হোল্ডিং মিডফিল্ডাররা গত মৌসুমে বার্সেলোনার নজরে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায় বার্সেলোনার অর্থনৈতিক সমস্যাটাই। বুসকেটসের জুতো পরার জন্য সাবেক লা মাসিয়ান ওরিয়ল রোমেউকেই বেছে নিতে বাধ্য হয় বার্সেলোনা। ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, ইলকায় গুন্দোয়ানদের দিয়েও কখনো কখনো চেষ্টা করেছেন জাভি, কিন্তু বুসকেটসের জায়গাটা বুসকেটসের মতো করে নিতে পারেননি কেউই।
৩. অরক্ষিত রক্ষণ
চলতি মৌসুমে বার্সেলোনার আরো একটা বড় সমস্যার জায়গা হলো ডিফেন্ডিং ট্রানজিশন। গোল হজমের দিক থেকে বার্সা (২৪.৬) রয়েছে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে ৩০তম অবস্থানে, এবং হজমকৃত গোলের একটা বড় অংশই এসেছে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে। প্রতিপক্ষ প্রতিআক্রমণে গেলেই নড়বড়ে মনে হয়েছে কাতালানদের।
বল পায়ে রাখার দিক থেকে বার্সেলোনা (৬৫.১%) পিছিয়ে নেই, স্বাভাবিকভাবেই। তবে নিজেদের জালে বল জড়ানো থেকে সবসময়েই যেন মাত্র একটা প্রতিআক্রমণ দূরে থাকছে বার্সেলোনা। ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষেই যেমন, ২০ মিনিটের ‘কাউন্টার অ্যাটাক ঝড়ে’ তিনবার নিজেদের জাল থেকে বল কুড়োতে হলো ইনাকি পেনাকে, সাথে সাথে লেখা হয়ে গেল জাভির ভাগ্যও।
[এই মৌসুমে বিবর্ণ আরাউহো-কুন্দে; ছবি: গেটি ইমেজেস]
এই মৌসুমে লা লিগায় বার্সার বিপক্ষে কাউন্টার অ্যাটাক হয়েছে ৪০টি, লিগের হিসেবে যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। এই কাউন্টার অ্যাটাক থেকে মোট ৫টি গোল হজম করতে হয়েছে বার্সাকে, ভিয়ারিয়ালের (৬) পর যা সর্বোচ্চ।
জাভি নিজে যখন পেপ গার্দিওলার অধীনে খেলেছেন, বার্সেলোনা তখন রক্ষণের কাজটা করতো নিজেদের পায়ে বল রেখে। কিন্তু কোচ জাভির অধীনে বার্সা সেই কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছে, অন্তত এই মৌসুমে তো বটেই।
৪. সুযোগ আসে, সুযোগ যায়
বার্সেলোনার দুঃসময়টা শুধু নিজেদের অর্ধেই নয়, চলছে প্রতিপক্ষের পোস্টের সামনেও।
এক্সপেক্টেড গোলের হিসাবে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের বার্সেলোনার (৫০.৯) এর চেয়ে এগিয়ে শুধু বায়ার্ন মিউনিখ (৫৩.৫)। জিরোনা (৪০.০), রিয়াল মাদ্রিদ (৩৮.১), অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ (৩৮.০) সহ লা লিগার অন্যান্য দলগুলোও বার্সার চেয়ে রয়েছে যোজন যোজন পিছিয়ে। কিন্তু কাতালানদের প্রত্যাশিত গোল আর গোলসংখ্যার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। প্রত্যাশিত গোলের চেয়ে পুরো ৬.৯টা গোল কম করেছে বার্সেলোনা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের সাথে যদি তুলনা করা হয়, প্রত্যাশিত গোলের চেয়ে ৬.৯টা গোল বেশি করেছে লস ব্লাঙ্কোসরা। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলতে যা বোঝায়!
চলতি মৌসুমে লা লিগায় মোট ৮২টা ‘বিগ চান্স’ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বার্সেলোনা, ইউরোপের শীরষ পাঁচ লিগের হিসেবে এক্ষেত্রেও বার্সেলোনার চেয়ে এগিয়ে শুধু বায়ার্ন মিউনিখই (৮৫)। এই ৮২টা সুযোগের মধ্যে ৫৫ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে বার্সা, যা অবশ্যই ইউরোপের সেরা লিগগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। মাত্র ৩২.৯ শতাংশ ক্ষেত্রে সুযোগ কাজে লাগিয়েছে বার্সেলোনা, সেরা পাঁচ লিগের গড় (৩৯.২ শতাংশ) মানের চেয়ে যা অনেকটাই কম।
[ছবি: অপ্টা অ্যানালিস্ট]
এত এত সুযোগ অপচয়ের পেছনে প্রধান ‘অপরাধী’ অবশ্যই বার্সেলোনার নম্বর নাইন, রবার্ট লেওয়ানডস্কি। চলতি মৌসুমে লেওয়ানডস্কি প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন মাত্র ২৮.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে, অন্তত বিশটা সুযোগ পেয়েছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে এক ডারউইন নুনেজ (২০ শতাংশ) ছাড়া তার পেছনে নেই আর কেউ। প্রাপ্ত ২১টা সুযোগের মধ্যে ১৫টাই হাতছাড়া করেছেন লেওয়ানডস্কি, গোল করেছেন বাকি ছয় ক্ষেত্রে।
[ছবি: অপ্টা অ্যানালিস্ট]
মাঠের উভয় প্রান্তে এমন ব্যর্থতা জাভির কোচিংকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার, সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন জাভি। স্বাভাবিকভাবেই এই মৌসুমে এনে দিতে পারেননি প্রত্যাশিত ফলাফল, আর ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন চলতি মৌসুম শেষে বিদায় নেওয়ার।
[সকল তথ্য ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত]