যেভাবে ক্লপ-গার্দিওলা বদলে দিয়েছেন ইংলিশ ফুটবলকে
সময়ের সবচেয়ে বড় ম্যানেজারিয়াল দ্বৈরথের সমাপ্তি দেখতে যাচ্ছি আমরা। আজ শেষবারের মতো প্রিমিয়ার লিগে মুখোমুখি হচ্ছেন লিভারপুল ম্যানেজার ইয়ুর্গেন ক্লপ ও ম্যান সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা। তার আগে জেনে যাওয়া যাক এই প্রিমিয়ার লিগে এই দুই দলের কোচের প্রভাব, তাদের হেড টু হেড এবং লিগ্যাসি কেমন।
প্রিমিয়ার লিগে প্রভাব
ক্লপ ও গার্দিওলা তর্কসাপেক্ষে এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দুই কোচ। একজন (ক্লপ) মধ্যম সারির এক ইংলিশ দলকে আবার শীর্ষ ক্লাবে রূপান্তরিত করেছেন। তাদেরকে ৩০ বছর পর এনে দিয়েছেন লিগ শিরোপা। জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, এফএ কাপসহ সম্ভাব্য সব শিরোপা। অপরজন (গার্দিওলা) ইংল্যান্ডের শীর্ষ একটি দলের দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে বানিয়েছেন 'সিরিয়াল উইনার'। সর্বশেষ ৬ মৌসুমে ৫টি লিগ শিরোপা, ৩টি লিগ কাপ, ২টি এফএ কাপ। গত মৌসুমে জিতেছেন অধরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাটিও।এই দুজনের বাইরে মাত্র একজন ম্যানেজারই কোনো ইংলিশ ক্লাবকে নিয়ে সম্ভাব্য সকল শিরোপা জিতেছেন। তিনি স্যার আলেক্স ফার্গুসন।
সুতরাং, আপনি বলতে পারেন ক্লপ-গার্দিওলার দ্বৈরথ সময়ের দুই শ্রেষ্ঠ কোচের দ্বৈরথ। এই দ্বৈরথ যেন 'ম্যানেজারদের মেসি-রোনালদো'।
হেড টু হেড
এই দ্বৈরথের শুরুটা আসলে জার্মানিতে। বায়ার্ন ম্যানেজার হিসেবে গার্দিওলার প্রথম ম্যাচই ছিল ক্লপের ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে। জার্মান সুপার কাপের সেই ম্যাচে ৪-২ গোলে জয় পেয়েছিল ক্লপের ছেলেরা। তবে জার্মানিতে মুখোমুখি লড়াইয়ে বেশি জয় পেয়েছেন গার্দিওলাই। ইংল্যান্ডে আবার ক্লপের জয় বেশি। সব মিলিয়েও এক ম্যাচ বেশি জিতেছেন এই জার্মান। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্লপ তার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ হেরেছেন গার্দিওলার বিপক্ষে। আর গার্দিওলা ক্লপের বিপক্ষে।
প্রতিযোগিতা |
ক্লপের জয় |
ড্র |
গার্দিওলার জয় |
বুন্দেসলিগা |
১ |
০ |
৩ |
ডিএফবি-পোকাল |
০ |
১ |
১ |
জার্মান সুপার কাপ |
২ |
০ |
০ |
প্রিমিয়ার লিগ |
৪ |
৬ |
৫ |
এফএ কাপ |
১ |
০ |
০ |
লিগ কাপ |
০ |
০ |
১ |
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ |
২ |
০ |
০ |
কমিউনিটি শিল্ড |
১ |
১ |
০ |
মোট |
১১ |
৮ |
১০ |
ফুটবল দর্শন
ক্লপ-গার্দিওলা ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই ফুটবল দর্শনের প্রতিনিধিত্ব করেন। ক্লপ প্রতিনিধিত্ব করেন জার্মানির প্রেসিং-নির্ভর ফুটবল, আর গার্দিওলা স্পেনের পজেশন-নির্ভর ফুটবল।
গার্দিওলা টেকনিকালি গিফটেড খেলোয়াড়দের প্রাধান্য দেন। মিডফিল্ডে একাধিক প্লেমেকার খেলান। ফলস নাইন, ইনভার্টেড ফুলব্যাক, এমনকি বল প্লেয়িং কিপার; এরকম অনেক ইনোভেটিভ প্লেয়িং পজিশনকে জনপ্রিয় করেছেন গার্দিওলা।
দর্শনের দিক থেকে এই দুই ম্যানেজার বিপরীত মেরুর। গার্দিওলার মূল দর্শন হচ্ছে পজেশন ধরে রাখা। আর ক্লপের মূল দর্শন হচ্ছে পজেশন হারানোর পর আগ্রাসী হওয়া। গার্দিওলা তার দলে বেশি প্লেমেকার খেলান, এদিকে ক্লপ বলে থাকেন 'গ্যাগেনপ্রেসিং ইজ দা বেস্ট প্লেমেকার'। মাঠের এডভান্স এরিয়ায় দ্রুত বল জিতলে আপনি কুইক ট্রানজিশনের মাধ্যমে গোল দিতে পারবেন। ক্লপের ফুটবল বেশ ডিরেক্ট ও আকর্ষণীয়। তিনি লিভারপুলে যোগ দেওয়ার পর গত নয় বছরে প্রিমিয়ার লিগে প্রেসিং ফুটবল বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এখন সব দলই তাদের খেলায় একরকম প্রেসিং রাখার চেষ্টা করে।
পূর্বে আমরা আরও অনেক ম্যানেজারিয়াল রাইভালরি দেখেছি। ফার্গুসন-ওয়েঙ্গার, মরিনহো-ওয়েঙ্গার বা মরিনহো-বেনিতেজ; এদের কোনোটিই ঠিক আইডিয়ার ক্ল্যাশ ছিল না।
ক্লপ ও গার্দিওলা শুধু তাদের আইডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করেই থামেননি। নিজেদের ফুটবলকে ইম্প্রুভ করার জন্য একে অপরের কাছ থেকে আইডিয়া চুরিও করেছেন। গার্দিওলা তার ফুটবলে প্রেসিং ইন্টিগ্রেট করেছেন। মিডফিল্ড কন্ট্রোলার হিসেবে গুন্দোগানকে কিনেছেন, যে ক্লপের সাবেক শিষ্য।
লিগাসি
তারা সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে সফল দুই কোচ। তাদের ট্রফি কেবিনেট ঈর্ষণীয়। । বর্তমানে ইউরোপের টপ ফোর লিগের লংগ্রেস্ট সার্ভিং দুই কোচ তারা। ঐতিহাসিকভাবেও, ফার্গুসন ও ওয়েঙ্গার বাদে আর কোনো কোচ এতদিন টেকেননি ইংলিশ ক্লাব।
তারা ইংলিশ ফুটবলকেও বদলে দিয়েছেন। লিগের প্রায় দলের মাঝেই এখন আমরা গ্যাগেনপ্রেসিং ও টিকি-টাকার মিক্সড এক ফুটবল দেখতে পাই। ইংল্যান্ড দলের দিকেও যদি আমরা তাকাই। ‘১৮ বিশ্বকাপে সাউদগেট মিডফিল্ডে দুজন ক্রিয়েটিভ এইট খেলিয়েছেন- ডেলে আলী ও লিংগার্ড। যেই আইডিয়া গার্দিওলার। সেই বিশ্বকাপে হেন্ডারসনকে সিক্স হিসেবে খেলানো হয়েছে। ক্লপই প্রথম হেন্ডারসনকে এই পজিশনে খেলিয়েছেন। এখন ট্রেন্ট ইংল্যান্ডের মিডফিল্ডে খেলে, যেটাও ক্লপের দেখানো পথেই। রিকো লুইস লেফটব্যাক থেকে ইনভার্টেড করে সেন্টার-মিডে আসছেন। এটা গার্দিওলার ট্যাকটিক্স।
দুই ম্যানেজারই অসংখ্যা তারকা তৈরি করেছেন। গার্দিওলা যেরকম ডি ব্রুইনা, এডারসন, ফিল ফোডেন, আর্লিং হালান্ড বা জন স্টোনস। ওদিকে সালাহ, ভ্যান ডাইক, ট্রেন্ট, অ্যালিসন। এবং বর্তমান বাচ্চা-কাচ্চারা।
সবচেয়ে বড় লিগাসি হয়তো তাদের মধ্যকার কনটেস্ট। ইংলিশ ফুটবল এরকম ইন্টারটেইনিং রাইভালরি কখনো দেখেনি। প্রায় ম্যাচই শ্বাসরুদ্ধকর, এবং তাদের মাঝখানকার প্রতিটি ম্যাচই বলতে গেলে টাইটেল-ডিসাইডিং।