• আইপিএল ২০২৪
  • " />

     

    অথচ দ্রুতগতির মায়াঙ্কের জন্য দিল্লিই ছিল অনেক দূর

    অথচ দ্রুতগতির মায়াঙ্কের জন্য দিল্লিই ছিল অনেক দূর    

    মায়াঙ্ক যাদব নিজেকে যখন ফাস্ট বোলার হিসেবে পরিচয় দিতেন, অনেকেই তা মানতেন না। এই লিকলিকে শরীরে পেস বোলিং? একটু খাবার-দাবার বেশি করে করো- এমন পরামর্শও শুনতেন হরহামেশাই। আইপিএলের মঞ্চে যখন আবির্ভাব ঘটলো, তখনও উঠে এলো তার হালকা-পাতলা গড়নের কথা। তবে তাতে জুড়ে রইলো মুগ্ধতা আর বিস্ময়- এই ছেলেটাই কীভাবে পারে এত জোরে বল করতে? 

    বোলিংয়ে সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১৫০ কিমিতে নিয়ে যাওয়াটাই যেখানে বিশাল কিছু, মায়াঙ্ক তা করে যান নিয়মিতই। আইপিএলে নিজের প্রথম দুই ম্যাচে এই ডানহাতি পেসার যা বল ছুড়েছেন, তার ৩৯ ভাগই ১৫০ গতি ছুঁয়েছে। প্রথম ম্যাচে তার ৯টি বলের গতি ১৫০ অতিক্রম করেছে, পরের ম্যাচে ১০টি। ১৫০ তবুও ছুঁতে পারেন অনেকে, কিন্তু ১৫৫ পারেন কজন! 

    পাঞ্জাবের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই ১৫৫ এর গণ্ডি পাড়ি দিয়েছিলেন মায়াঙ্ক। শুধু ওই একবারেই শেষ নয়। আগের ম্যাচে ১৫৫.৮ গতির বল করে রেকর্ড গড়েছিলেন, পরের ম্যাচেই তা ভেঙে দেন ১৫৬.৭ গতিতে। এ পর্যন্ত এ মৌসুমের দ্রুততম বল যেটি, আইপিএলের ইতিহাসে অবশ্য যা চতুর্থ সর্বোচ্চ। যদিও ১৫৫ গতির বল তার এরই মধ্যে করা হয়ে গেছে তিনটি। আনরিখ নরকিয়া, উমরান মালিক- গতির জন্য যারা খ্যাতি পেয়েছেন, তাদের কারো হাত থেকে এমন বল দুটির বেশি ছুটেনি। স্বাভাবিকভাবেই গতির ঝড় তোলা মায়াঙ্ককে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার বাকি নেই কেউই!

    যে ডেল স্টেইনকে আদর্শ মানেন, সেই স্টেইন প্রথম ম্যাচের পর যেন অবিশ্বাসেই লিখলেন, ‘এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলে তুমি!’ ব্রেট লি তখনই জানিয়ে দিলেন, ‘ভারত পেয়ে গেছে তাদের দ্রুততম বোলার।' ম্যাচশেষে স্টার স্পোর্টসের অনুষ্টানে স্টুয়ার্ট ব্রড বললেন, ‘আমি ইতোমধ্যে স্টিভেন স্মিথকে ম্যাসেজ করে দিয়েছি- ২০২৫ সালের বর্ডার-গাভাস্কার সিরিজে মায়াঙ্ককে মোকাবেলা করার জন্য তৈরি হয়ে যাও।’ পরে স্মিথও জানালেন, ‘আমি প্রস্তুত আছি ভারতের বিপক্ষে সিরিজে তার মুখোমুখি হতে।’

    এতক্ষণেই জাতীয় দলে তাকে দেখতে চাওয়া বহু লোকের মধ্যে একজন বীরেন্দর শেবাগও। টম মুডিও বলছেন, আইপিএলের পরপরই অনুষ্টিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপের কথাবার্তায়ও তিনি চলেই আসবেন। প্রতিপক্ষের মুখেও তো কম ঝরেনি তার জন্য প্রশংসা। পাঞ্জাবের অধিনায়ক শিখর ধাওয়ান যেমন বললেন, ‘আমি অবাক হয়ে গিয়েছি তার পেস দেখে।' আর ফাফ ডু প্লেসিকে পেস তো মুগ্ধ করেছেই, পেসের সাথে অ্যাকুরেসিটা দেখেই বেশি মুগ্ধ হয়েছেন ফাফ। আইপিএলের অভিষেকে মায়াঙ্ক যে হয়েছেন ম্যাচসেরা, পরের ম্যাচেও- তার মূলে সেই গতির সাথে অ্যাকুরেসিই। 

    এর আগে আইপিএলে নিজের প্রথম দুই ম্যাচেই ম্যাচসেরা হতে পারেননি আর কেউই। ২১ বছর বয়সেই এমন কীর্তি। তারপরও যখন মায়াঙ্ক অভিষেকে ম্যাচসেরার পুরস্কার নিতে এসে বললেন, ‘আমি লক্ষ্য রেখেছিলাম, তরুণ বয়সে যদি অভিষেক হয়, তাহলে অনেক ভালো লাগবে।’ তার ক্যারিয়ারের গতিপথ যদি দেখেন, তাহলে একটু খটকাই লাগবে কথাটায়। এবং এই কথাটাই তার চরিত্রেরও অনেকটুকুই জানিয়ে দেয়। 

    ভারতের বেশিরভাগ উদীয়মান তারকাদের উঠে আসার গল্পে আপনি দেখতে পান, বয়সভিত্তিক দলের সিঁড়ি বেয়ে তারা উপরে উঠেছেন। মায়াঙ্ক অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ তো পরে, দিল্লির অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬ দলে পর্যন্ত সুযোগ পাননি। এসব দলে না থাকলে দিল্লির অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও জায়গা মেলে না, এমন কথা আসত তার কানে প্রায়শই। ভুল প্রমাণ করবেন কী, অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও তো প্রথমবার ট্রায়ালে জায়গা পাননি। দিল্লির ছেলের জন্য দিল্লি যখন সত্যি সত্যিই অনেক দূর মনে হচ্ছিল, দ্বিতীয়বার ট্রায়াল দেওয়ার আগে তিনি নিলেন বড়সড় সিদ্ধান্ত। চার মাস ছুটি চাইলেন স্কুলে। শুধু ট্রায়ালের প্রস্তুতির জন্য স্কুলের ছুটি না দেওয়াটাই স্বাভাবিক। মায়াঙ্ক তখন ঘরে বলে বসলেন, আমি যাব না স্কুলে। 

    সফলতার স্পষ্ট ছবি দেখা যাচ্ছে না মায়াঙ্কের পথচলায়, পরিবারে তা নিয়ে তাই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলই। মায়াঙ্ক যদিও অবিচল, ‘বাবা আমাকে ছয় মাস সময় দাও, যদি না পারি তাহলে যা বলবে তাই করবো।’ মায়াঙ্ক কোন ক্লাসে পড়েন তখন জানেন? দশম শ্রেণি। অনূর্ধ্ব-১৯ দিল্লি দলে এরপর জায়গা বানিয়েই ছাড়লেন ১৭ বছর বয়সী মায়াঙ্ক, কিন্তু জাতীয় দলে ডাক পাওয়া হয়নি। 

    ক্যারিয়ারের এমন অবস্থায়ই দারুণ একটা সুযোগ হাজির হলো তার ঘরে। ৫০ হাজার রুপি বেতন, নৌবাহিনীতে চাকরি, মূলত খেলাই কাজ। সার্ভিসেস দলের হয়ে খেলবেন ঘরোয়া ক্রিকেটে, সব ফরম্যাটে খেলারও নিশ্চয়তা থাকছে। রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ মিলছে, কিন্তু মায়াঙ্কের মনে ভিন্ন লক্ষ্য- তিনি আরেকবার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে চেষ্টা চালিয়ে দেখবেন। 

    সার্ভিসেস দলের বড় কর্মকর্তা একজন রীতিমতো তার পেছনেই লেগে ছিলেন। প্রথম প্রস্তাবেই না করে দেওয়ার পর মায়াঙ্কের কোচের কাছে ফোন গিয়েছিল, তারাক সিনহার নির্দেশে পরে মায়াঙ্ক ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলেন। পরে সেখানে নির্বাচিত হয়ে গেলেও তিনি সিদ্ধান্তে অনড়ই থাকেন। ওদিকে ওই কর্মকর্তা তাকে বুঝিয়েই যেতে থাকেন। শেষমেশ এমন ঘটনাই ঘটেছিল যে- ওই কর্মকর্তা কথা বলছিলেন, আর পেছন দিয়ে দৌড় মেরে পালিয়ে যান মায়াঙ্ক। এরপরও হয়েছে অনেক কথাবার্তা, কিছুই তাকে আর গলাতে পারেনি। 

    মায়াঙ্কের কপালের মন্দ, কোভিড-১৯ এর কারণে অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্টই পরে আর হয়নি সেসময়। মায়াঙ্ক তখন নেমে পড়লেন নতুন লক্ষ্যে- আইপিএলের আবহে ঢুকতে চাই, নেট বোলার কিংবা স্কোয়াডের খেলোয়াড় হয়ে। সার্ভিসেস দলের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই দিল্লির ঘরোয়া দলে সুযোগ পাওয়া কঠিন। আবার ক্যারিয়ারের গতিপথে চোখ রাখলে তার জন্য তা আরও কঠিনই ভাববেন যে কেউ। কিন্তু মায়াঙ্ক কঠিন পথ বেছে নিয়ে বড় লক্ষ্য দেখতে পিছপা হননি একটুও।

    ব্যস, প্রস্তুতি চলল। কিন্তু ক্যাম্পে ডাক পেলেও জায়গা হলো না মূল স্কোয়াডে। পরে নাবদীপ সাইনির ভারত ‘এ’ দলে ডাক পাওয়ায় খুলে গেল তার কপাল। ২০২১ সালের বিজয় হাজারে ট্রফিতে দিল্লির হয়ে খেললেন দুটি একদিনের ম্যাচ, যার একটি ছিল উত্তর প্রদেশের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে প্রতিপক্ষের কোচ ভিজয় ধাইয়া, যিনি আবার লখনউ সুপার জায়ান্টসের তখনকার সহকারী কোচ। ম্যাচের আগে পাশের নেটে বোলিং করতে দেখে তাকে ধাইয়ার মনে এতটাই ধরলো যে, লখনউর সেসময়ের মেন্টর গৌতম গম্ভীরকে সেদিনই বললেন, ‘এখানে একটা ছেলে পেয়েছি, এই ছেলেটাকে আমাদের নিলামে কিনতেই হবে।’ মাত্র দুটি ঘরোয়া ম্যাচ খেলা মায়াঙ্ককে ২০২২ আইপিএলের নিলামে এরপর কিনেও নিল লখনউ। 

    ওই আসরেই অভিষেকও হয়ে যেত তার। এমনকি একটি ম্যাচের আগেরদিন একাদশে তাকে রাখার কথাও জানানো হয়েছিল, পরে আরেকজনের ইনজুরিতে কম্বিনেশনের অদল-বদলে তা হয়নি। পরের মৌসুমে, অর্থাৎ ২০২৩ আইপিএলে প্রথম ম্যাচ থেকেই তাকে নামানোর সিদ্ধান্ত ছিল লখনউর। কিন্তু টুর্নামেন্টের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে পা পিছলে পড়ে যান ইনজুরিতে। পুরো মৌসুমেই ছিটকে পড়া মায়াঙ্কের তাই অভিষেকের সুগন্ধ পেয়েও স্বাদ নেওয়া হয়নি।

    শেষমেশ অভিষেকে বল হাতে কুইন্টন ডি ককের ভাষায় ‘রকেট’ই ছুড়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে নানান ডাকনাম পাওয়াও হয়ে গেছে তার। সঞ্জয় মাঞ্জরেকার যেমন বললেন, রাজধানী এক্সপ্রেস। আরও নাম জুড়ে যাবে তার সঙ্গে। তবে মায়াঙ্কের তাতে কোনও আপত্তি থাকবে না, যদি তা গতিময় হয়। রকেট হোক, বিমান হোক, কিংবা সুপারবাইকস- দ্রুতগতিটাই যে তার প্রিয়।