বেন স্টোকস নাকি জো রুট: কার নেতৃত্বে বেশি সফল ইংল্যান্ড?
সতেরো ম্যাচে এক জয়!
স্টোকস-ম্যাককালাম যুগের ইংল্যান্ডের প্রত্যেকটা ব্যর্থতার উত্তর হয়ে এসেছে এই বাক্যটি। সত্যিই তো। স্টোকস-ম্যাককালাম যুগ শুরুর আগের সতেরো টেস্টের মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড দল, এর চেয়ে খারাপ আর কী-ই বা হতে পারে! তবুও, বেন স্টোকসের কাছে জো রুটের অধিনায়কত্ব ছাড়ার দুই বছর পরে দাঁড়িয়ে দুই অধিনায়কের পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করাই যায়। আর সেই আলোচনার জন্য উইজডেন বেছে নিয়েছে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দুই যুগের দুটো সিরিজ করে মোট ছয়টি সিরিজকে। তবে হ্যাঁ, উল্লেখিত ছয়টা সিরিজ দিয়ে রুট বা স্টোকস, কারোর অধিনায়কত্বের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। একটা তুলনামূলক চিত্রই পাওয়া যায় কেবল।
ম্যাককালাম-স্টোকসের হাত ধরে নতুন যুগের সূচনা করেছে ইংল্যান্ড: Image Source: Getty Images
এটা মানতেই হবে, স্টোকসের অধীনে ইংল্যান্ডের সূচনাটা ছিল দুর্দান্ত। মনোমুগ্ধকর সাহসী বাজবলের সাথে মাঠের ফলাফল, প্রথম ১৪ টেস্টের ১২টাতেই জয়। তবে উড়ন্ত বাজবলে ধাক্কা হয়ে এসেছে সর্বশেষ দুটো সিরিজ: ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাশেজ জিততে ব্যর্থ হওয়া, এরপর ভারতের মাটিতে সিরিজ হার। প্রশ্নটা তাই উঠেই যায়, মাঠের ক্রিকেটের মতো ফলাফলেও কি বড়সড় পরিবর্তন আনতে পেরেছে স্টোকস-ম্যাককালামের বাজবল ক্রিকেট?
নিউ জিল্যান্ড সিরিজ (হোম) ২০২১ বনাম ২০২২
পরপর দুই গ্রীষ্মে ইংল্যান্ড সফর করেছিল ব্ল্যাকক্যাপসরা। ২০২১ সালের দুই ম্যাচের সিরিজটা নিউ জিল্যান্ড জিতে নিয়েছিল ১-০ ব্যবধানে। দলের বেশ কয়েকজন মূল খেলোয়াড় আইপিএলে অংশগ্রহণ করায় ওই ইংল্যান্ড দলটাও একটু দুর্বল ছিল, আর তাতেই হয়তো এজবাস্টন টেস্টে আট উইকেটের বড় জয় পাওয়াটা সহজ হয়েছিল কিউইদের জন্য। লর্ডস টেস্টের শেষ দিনে অবশ্য ইংল্যান্ডের জন্য ২৭৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন নিউ জিল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন, তবে কোন ঝুঁকি না নিয়ে ড্রয়ের পথেই হেঁটেছিলেন স্বাগতিকরা।
এক বছরের ব্যবধানে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ পুনরুদ্ধার করলো ইংল্যান্ড; Image Source: Getty Images
এবার আসা যাক ২০২২ এর সিরিজে। লর্ডসে, সিরিজের প্রথম টেস্টে, দারুণ লড়াইয়ের পর শেষ হাসি হাসে তিন সিংহের দল। দ্বিতীয় টেস্টে, ট্রেন্ট ব্রিজে ইংল্যান্ড দল দেখায় বাজবলের স্বরূপ। প্রথম ইনিংসে ওভারপ্রতি চারের ওপরে রান তুলে স্কোরবোর্ডে জমা করে ৫৩৯ রান। ওই টেস্টেরই শেষ সেশনে ১৬০ রান চেজ করে ইংলিশরা, তাও অনেকটা সময় হাতে রেখে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৯২ বলে ঝড়ো ১৩৬ রান করা জনি বেয়ারস্টো জ্বলে ওঠেন পরের টেস্টেও। প্রথম ইনিংসে ১৫৭ বলে ১৬২, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৪ বলে অপরাজিত ৭১। সাত উইকেটে হেডিংলি টেস্ট জিতে তিন ম্যাচের সিরিজে নিউ জিল্যান্ডকে ধবলধোলাই করে ইংল্যান্ড।
অর্থাৎ, এক্ষেত্রে রুটের তুলনায় স্টোকসের অধীনে দৃশ্যমান উন্নতি ঘটেছে ইংল্যান্ড দলে।
দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ (হোম) ২০১৭ বনাম ২০২২
উভয় সিরিজের মধ্যে দূরত্বটা পাঁচ বছরের, দুই প্রতিপক্ষেও পার্থক্য ব্যাপক। ২০১৭ সালের সিরিজে খেলা কেশব মহারাজ, ডিন এলগার আর কাগিসো রাবাদা ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার দুই দলে কোন ‘কমন’ খেলোয়াড়ই ছিলেন না ’২২-এর সিরিজের প্রথম টেস্টে। ’১৭-এর ওই চার ম্যাচের সিরিজে ৩-১ ব্যবধানে জিতেছিল ইংল্যান্ড।
পাঁচ বছরের ব্যবধানে দুই বার দক্ষিণ আফ্রিকাকে টেস্ট সিরিজে পরাজিত করলো ইংল্যান্ড; Image Source: Getty Images
বাইশের সিরিজটা ছিল একটু ব্যতিক্রমী। তিন ম্যাচের কোনটাতেই পরাজিত দল তেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি, পরাজয়ের ব্যবধান তাই ছিল বড়। ইনিংস ও ১২ রান, ইনিংস ও ৮৫ রান, এবং ৯ উইকেট। বোলারদের প্রাধান্যের এই সিরিজে দুই দলের ব্যাটসম্যানরাই ধুঁকেছেন, দুই শতাধিক দলীয় সংগ্রহ হয়েছে মাত্র দুইবার। তবে সতেরোর সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইন আরেকটু শক্তিশালী ছিল, দলীয় সংগ্রহগুলো আরেকটু ‘ভদ্রস্থ’ দেখাচ্ছিলো।
তবে সব মিলিয়ে, বাইশের দক্ষিণ আফ্রিকা দলের পালাবদলের ব্যাপারটা মাথায় রাখলে, ইংল্যান্ডের জন্য দুটো সিরিজের ফলাফলে আহামরি পরিবর্তন আসেনি।
পাকিস্তান সিরিজ ২০১৫ (সংযুক্ত আরব আমিরাত) বনাম ২০২২ (অ্যাওয়ে)
সাত বছরের ব্যবধানে দুটো সিরিজ, স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপক্ষ পাকিস্তান পাল্টে গিয়েছিলো খোলনলচে। দুটো সিরিজেই খেলেছেন, এমন একজন পাকিস্তানি খেলোয়াড়কেই খুঁজে পাওয়া যায়: আজহার আলী। ইংল্যান্ডের জন্য অ্যাওয়ে হলেও, দুটো সিরিজের ভেন্যুও ভিন্ন। ২০১৫ সালের সিরিজটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে, বাইশের সিরিজটা পাকিস্তান আয়োজন করে নিজেদের আঙিনাতেই। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা ছয় টেস্টেই জয়হীন ইংল্যান্ড বাইশে এসে সিরিজটা জিতে নেয় ৩-০ ব্যবধানে।
২০১৫ এর ব্যর্থতা ২০২২-এ ঘুচিয়ে ফেললো স্টোকসের ইংল্যান্ড; Image Source: Getty Images
এখানে তুলনার স্বার্থে অস্ট্রেলিয়া দলকে একটু টেনে আনতে হচ্ছে। ২০২২-এ পাকিস্তানের মাটিতে অনুষ্ঠিত তিন ম্যাচের সিরিজে ভালো খেলেও অস্ট্রেলিয়াকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় ১-০ ব্যবধানের জয়ে। অপরদিকে, একই রকম ফ্ল্যাট পিচে, স্টোকসের ইংল্যান্ডের কাছে ধবলধোলাইয়ের শিকার হয় স্বাগতিক পাকিস্তান। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে, পাকিস্তান ওই সিরিজটা খেলেছিল দুই মূল পেসার শাহীন আফ্রিদি এবং নাসিম শাহকে ছাড়াই।
তবে সব বিবেচনা করে, স্টোকসের ইংল্যান্ডকে যোজন যোজন এগিয়ে রাখতেই হচ্ছে।
নিউ জিল্যান্ড সিরিজ (অ্যাওয়ে) ২০২৩ বনাম ২০১৯
নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে অ্যাওয়ে টেস্ট সিরিজগুলো বরাবরই ইংল্যান্ডের জন্য ভয়ের কারণ। ২০০৮ থেকে ২০২৩, মাঝের চৌদ্দ বছরে নিউ জিল্যান্ডের মাটি থেকে একটা টেস্টও জিতে ফিরতে পারেননি ইংরেজরা। তিনটা সফরেই জয়হীন অবস্থায় দেশের বিমানে উঠতে হয়েছে তাদের।
অবশেষে 'কিউই-ফাঁড়া' কাটালো ইংল্যান্ড; Image Source: Getty Images
দুই হাজার তেইশে এসে চিত্রটা বদলালো। শুধু বদলালো বললে ভুল হবে, দুই ম্যাচের সিরিজটা ইংল্যান্ডের পক্ষে ২-০ হতেই পারতো। কিন্তু প্রথম ম্যাচে ২৬৭ রানে জয়ী ইংরেজরা দ্বিতীয় টেস্টে কিউইদের ফলোঅনে বাধ্য করেও ম্যাচটা হেরে গেল মাত্র এক রানের ব্যবধানে। তবে ২০১৯ এর সাপেক্ষে এই ফলকে দুর্দান্ত বলতেই হচ্ছে, কেননা সেবার দুই ম্যাচের সিরিজের এক ম্যাচে ড্র হলেও অপর ম্যাচে ইনিংস ও ৬৫ রানে জয়ী হয় নিউ জিল্যান্ড।
অর্থাৎ এটা নিশ্চিত, স্টোকসের ইংল্যান্ড এক্ষেত্রে উন্নতি করেছে।
অ্যাশেজ ২০২৩ বনাম ২০১৯
কাগজে কলমে দুটো সিরিজের মধ্যে তেমন পার্থক্য হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। দুটো সিরিজই শেষ হয়েছে অমীমাংসিতভাবে, ২-২ এ। দুটো ক্ষেত্রেই বৃষ্টির কারণে একটি টেস্ট ড্র হয়, যেখানে এগিয়ে ছিল ইংল্যান্ড দল। তবে মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তিতে তেইশের অ্যাশেজকে এগিয়ে রাখতেই হচ্ছে।
উনিশ-তেইশের অ্যাশেজ অমীমাংসিতই রইলো; Image Source: Getty Images
তেইশের অ্যাশেজের পরাজিত দুটো ম্যাচেই একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, দুটো ক্ষেত্রেই লম্বা সময় ধরে লাগামটা ছিল ইংরেজদের হাতেই। মাত্র দুই উইকেট এবং ৪৩ রানের ব্যবধানে যথাক্রমে এজবাস্টন ও লর্ডস টেস্টে পরাজিত হয় ইংল্যান্ড। জয়ী ম্যাচগুলোর ক্ষেত্রেও ব্যবধান প্রায় একই ছিল: ৩ উইকেট এবং ৪৯ রান। অপরদিকে, ২০১৯ এর অ্যাশেজের দিকে যদি তাকানো হয়, জো রুটের দলের পরাজিত দুটো ম্যাচের ব্যবধান ছিল ২৫১ রান ও ১৮৫ রান। এর বাইরে হেডিংলিতে স্টোকস-বীরত্বের সেই ম্যাচে ১ উইকেটে জিতেছিল ইংল্যান্ড, আর ওভালে অনুষ্ঠিত শেষ টেস্টটা ইংরেজরা জেতে ১৩৫ রানে।
অর্থাৎ, উনিশের তুলনায় তেইশের অ্যাশেজে দুই দলের কাছ থেকেই অধিক প্রতিদ্বদ্বিতা চোখে পড়েছে, যদিও শেষ পর্যন্ত মাঠের ফলাফল রয়ে গেছে অপরিবর্তিত।
ভারত সিরিজ (অ্যাওয়ে) ২০২৪ বনাম ২০২১
২০২১ এর ভারত সফর দিয়েই শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডের “সতেরো ম্যাচে এক জয়”-এর ধারা, যার শেষটা হয় জো রুটের অধিনায়কত্বের অবসান দিয়ে। একুশ আর চব্বিশ, দুটো সিরিজই দারুণ জয় দিয়ে শুরু করেছিল ইংল্যান্ড, তবে সেই আনন্দ মিলিয়ে যেতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। একুশের প্রথম ম্যাচে, চেন্নাইতে ২৭৭ রানের জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড, এরপরের তিন টেস্টে পরাজিত হয় যথাক্রমে ৩১৭ রান, ১০ উইকেট এবং ইনিংস ও ২৫ রানের ব্যবধানে।
দুটো সিরিজেই হেরেছে ইংল্যান্ড, তবে পরেরটাতে ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছাপ; Image Source: Getty Images
চব্বিশের প্রথম টেস্টেও একই চিত্র। হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে ২৮ রানে জিতলেও পরের চার টেস্টে যথাক্রমে ১০৬ রান, ৪৩৪ রান, ৫ উইকেট এবং ইনিং ও ৬৪ রানে পরাজিত হয় ইংরেজরা। তবে পরাজয়ের ব্যবধানগুলোই যেমনটা বলছে, একুশের তুলনায় চব্বিশে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে ইংল্যান্ড, রাজকোট আর রাঁচি টেস্টের অনেকটা সময় জুড়ে লড়েছে স্বাগতিকদের সাথে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু এটাও সত্য, খুবই অনভিজ্ঞ একটা স্পিন-আক্রমণ নিয়ে ভারতের মাটিতে ভারতকে পরাস্ত করা প্রায় অসম্ভব। হ্যারি ব্রুক আর জ্যাক লিচের অনুপস্থিতিও ভুগিয়েছে ইংল্যান্ডকে।
সব মিলিয়ে, স্কোরলাইন একই হলেও, ভারতের বিপক্ষে রুটের ইংল্যান্ডের তুলনায় স্টোকসের ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্স ছিল তুলনামূলক ভালো।
জো রুটের দলের প্রথাগত টেস্ট ক্রিকেট থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণাত্মক বাজবল ক্রিকেট খেলানোর জন্য স্টোকস বাড়তি কৃতিত্ব পেতেই পারেন, মাঠের ফলাফলও তাঁর দিকেই কিছুটা হেলে রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাজবল ক্রিকেট কতটা কার্যকর হবে, সাম্প্রতিক ব্যর্থতার পরে সেই প্রশ্নটা উঠতে বাধ্য।