সিটির ভুলের ছড়াছড়ি আর রিয়াল মাদ্রিদের আভিজাত্য
গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফিটা গিয়েছিল ইতিহাদ স্টেডিয়ামে, এর আগেরটা সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। ম্যানচেস্টার সিটি আর রিয়াল মাদ্রিদই নিশ্চিতভাবে ইউরোপের গত দুই-তিন মৌসুমের সেরা দুটো দল। আর এই দুই দল যখন মুখোমুখি হয়েছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের এই আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে, ধ্রুপদী এক লড়াইয়ের আশা করেছিলেন ফুটবল সমর্থকেরা। দল দুটোও হতাশ করেনি। দুই লেগ মিলিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা লড়াইয়ের পরও পাওয়া গেল না সেরা দলটাকে। অতঃপর টাইব্রেকার, আর তাতে গোলরক্ষক আন্দ্রিই লুনিনের বীরত্বে সেমিফাইনালে নাম লেখালো চৌদ্দবারের চ্যাম্পিয়নরা। ইতিহাদের সবুজ ঘাসে ম্যানচেস্টার সিটির জন্য পড়ে রইলো শুধুই হাহাকার। কিন্তু বিষাদের নীল রঙ গায়ে মাখতে মাখতে সিটিজেনরা দোষারোপ করতে পারে শুধু নিজেদেরই।
সেমিতে পৌঁছে গেল রিয়াল মাদ্রিদ; Image Source: Getty Images
যদি টাইব্রেকারে বার্নার্দো সিলভা অমন্য ‘ভুতুড়ে’ পেনাল্টি না নিতেন! যদি কোভাচিচের শটটা ফাঁকি দিতো লুনিনকে! যদি রুডিগারের শটটা ফিরে আসতো পোস্টে লেগে! টাইব্রেকারে কী হলে কী হতো, সেই আলোচনা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়, কেননা প্রাপ্ত সুযোগগুলো ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে এই ম্যাচ টাইব্রেকারেই গড়ায় না। ম্যানচেস্টার সিটির ব্যর্থতার টেকনিক্যাল ও ট্যাকটিক্যাল ব্যবচ্ছেদ করেছে দ্য অ্যাথলেটিক।
রদ্রিগোর গোলেই লস ব্লাঙ্কোসদের এগিয়ে যাওয়া; Image Source: Getty Images
হ্যাঁ, রদ্রিগোর গোলে ম্যাচের ১২ মিনিটেই এগিয়ে গিয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। সেই গোলের সমতা ফেরাতে ম্যানচেস্টার সিটিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৭৬ মিনিট পর্যন্ত। রুডিগারের ভুলে দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৪ সমতা নিয়ে আসেন কেভিন ডি ব্রুইনা। এর আগেপরে নিজেদের রক্ষণে দারুণ পারফর্ম করেছে দানি কারভাহাল, নাচো আর আন্দ্রিই লুনিন। তবে বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, তাঁদের জন্য কাজটা সহজ করে দিয়েছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড়রাই।
ম্যাচে সিটির আক্রমণের সিংহভাগই এসেছে দুই উইং ধরে। পেপ গার্দিওলার পরিকল্পনাটা এমনই ছিল। যেহেতু মাদ্রিদের দুই সেন্টারব্যাক, নাচো এবং রুডিগার, ব্যস্ত ছিলেন আর্লিং হাল্যান্ডকে আটকাতে, গার্দিওলা নিজেদের রাইট উইংয়ে রেখেছিলেন ফিল ফোডেনকে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল ফোডেনের মাধ্যমে ফারলাঁ মেন্দিকে তাঁর জায়গা থেকে সরিয়ে এনে কেভিন ডি ব্রুইনার জন্য জায়গা তৈরি করে দেওয়া।
Image Source:The Athletic
ম্যাচের শুরু থেকেই এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন ফোডেন, ডি ব্রুইনা এবং আকাঞ্জি। রাইট টাচলাইনের কাছে বল পেয়ে ফোডেন অপেক্ষা করেছেন মেন্দির উপরে উঠে আসার জন্য।
Image Source:The Athletic
এরপর আকাঞ্জির মাধ্যমে তিনি দ্রুত বল পাঠিয়ে দিয়েছেন ডি ব্রুইনার কাছে।
Image Source:The Athletic
ডি ব্রুইনা সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি। নিজের সেরা ফর্মে তিনি ছিলেন না। একটা গোল পেয়েছেন সত্যি, কিন্তু ম্যাচে তাঁর খেলা ১১২ মিনিটের মধ্যে ২১টা ক্রস করেও বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়েছেন কাজে লাগাতে। আর গত কিছুদিনের বিবেচনায় ফিল ফোডেনই সিটির আপাতত সেরা খেলোয়াড়, যদিও গার্দিওলা প্লে মেকিংয়ের মূল ভরসাটা রাখতে চেয়েছিলেন কেভিন ডি ব্রুইনার ওপর। ডি ব্রুইনা চেষ্টা করেছেন সর্বোচ্চ, কিন্তু সেই অনুপাতে সাফল্য আসেনি।
Image Source:The Athletic
আক্রমণের বাম দিকের পরিকল্পনাটাও প্রায় একই ছিল। এই অংশের মূল দায়িত্ব ছিল বার্নার্দো সিলভার ওপর। কিন্তু ম্যাচে বার্নার্দোকে আটকানোর কর্তব্য মাথায় নিয়ে নেমেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের পরিশ্রমী মিডফিল্ডার ফেডে ভালভার্দে। দ্রুত ট্র্যাকব্যাক করে তিনি বারবার আটকে দিয়েছেন বার্নার্দোকে। জায়গা দেননি একেবারেই।
Image Source:The Athletic
জ্যাক গ্রিলিশের সামনে তখন সুযোগ এসেছিল। তাঁকে থামানোর দায়িত্ব ছিল দানি কারভাহালের। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রিলিশও ব্যর্থ হয়েছেন।
ম্যাচের খুব চেনা একটা দৃশ্য ছিল এমন: গ্রিলিশ কারভাহালকে কাটানোর চেষ্টা করার বদলে বল পায়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন, এরপর কারভাহালকে সামনে রেখেই ক্রস করার চেষ্টা করছেন বক্সে।
Image Source:The Athletic
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার ক্রস করেননি তিনি, ব্যাক পাস দিয়ে বলের দখলটা নিজেদের কাছেই রেখেছেন।
Image Source:The Athletic
অর্থাৎ এটা মোটামুটি নিশ্চিত, যে গার্দিওলা বাঁ দিকে খুব বেশি ঝুঁকি নিতে চাননি। কারভাহালকে কাটিয়ে সামনে এগোতে গেলে বল হারানোর শঙ্কা থাকে, আর সেখান থেকে কাউন্টার অ্যাটাক, সেই ঝামেলায় যেতেই চাননি গার্দিওলা। গ্রিলিশ তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছেন, বার্নার্দোর সাথে সমন্বয় করে আক্রমণ করতে চেয়েছেন, কিন্তু খুব একটা সফল হননি। যদি বেঞ্চে থাকা ডকুকে শুরুর একাদশে নামাতেন গার্দিওলা, যদি উইংয়ে আরেকটু আক্রমণ করতে পারতেন কারভাহালকে, কে জানে, ম্যাচের ফলাফল ভিন্নও হতে পারতো।
Image Source:The Athletic
তবে একেবারেই যে ভিন্ন পরিস্থিতি হয়নি, তেমন নয়। কারভাহালকে ড্রিবলিং করে কাটিয়ে যেতে গিয়ে ফাউলের শিকার হয়েছিলেন গ্রিলিশ। রেফারি হলুদ কার্ড দেখিয়েছিলেন কারভাহালকে। এরপরই, দ্বিতীয়ার্ধে কৌশলে সামান্য পরিবর্তন আনেন কার্লো আনচেলত্তি। রক্ষণে একেবারে ডানপ্রান্তে নিয়ে আসেন ফেডে ভালভার্দেকে, কারভাহাল চলে আসেন ভেতরের দিকে। ডি ব্রুইনাও দ্বিতীয়ার্ধে বাঁ দিকে সরে আসেন, তৈরি হওয়া ওই জায়গাটা কাজে লাগানোর জন্যই।
ম্যানচেস্টার সিটির গতকালের ম্যাচে আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়: মাদ্রিদের বক্সের কোণাগুলোতে নিজেদের ডিফেন্ডারদের উপস্থিতি। তবে বল পায়ে তাঁরা খুব একটা স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। পেপ গার্দিওলার অন্যতম প্রিয় কৌশল এইটা, গত মৌসুমে ট্রেবলও এসেছে এই কৌশলে কিন্তু মাদ্রিদের বিপক্ষে এই কৌশলটা খুব একটা কাজে লাগেনি।
Image Source:The Athletic
এই ছবিতেই যেমনটা দেখা যায়, বার্নার্দোর কাছ থেকে বলটা পেলেন জোস্কো ভার্দিওল, স্বাভাবিকভাবে পরের পাসটা তিনি দেবেন ডানে দাঁড়ানো রদ্রিকে। কিন্তু এই সহজতম পাসটা দিতে ভুল করে ফেললেন তিনি, তাতে প্রতি-আক্রমণের সুযোগ পেয়ে গেল রিয়াল মাদ্রিদ।
Image Source:The Athletic
Image Source:The Athletic
প্রথমার্ধের শেষের দিকে আরো একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে।
Image Source:The Athletic
ভার্দিওলের সামনে পাস দেওয়ার অনেকগুলো বিকল্প ছিল। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন ভুল বিকল্পটাই। বলটা ফেডে ভালভার্দের বিপদমুক্ত করতে কোন সমস্যাই হয়নি।
Image Source:The Athletic
তবে রদ্রি খুব দ্রুতই বলটা পুনরুদ্ধার করে ফেললেন।
Image Source:The Athletic
বল পাঠানো হলো ডান পাশে, এবারও সেই একই ঘটনা। ফোডেনের পাস গেল আকাঞ্জির কাছে।
Image Source:The Athletic
আকাঞ্জি পাস দিতে গিয়ে বল হারালেন। প্রতি-আক্রমণে ওঠার সুযোগ পেয়ে গেল মাদ্রিদ।
এইটাই হওয়ার কথা ছিল। একটা দলের আক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে যদি থাকেন ডিফেন্ডাররা, বিশেষত সেন্টারব্যাকরা, সেক্ষেত্রে এমনটাই ঘটবে। গত আসরের ফাইনালেও গার্দিওলার দলের আক্রমণের বড় অংশ জুড়ে ছিলেন অ্যাটাকিং রাইটব্যাক হিসেবে খেলা জন স্টোনস। তাঁর ভুল পাস আর বাজে বল কন্ট্রোল থেকে বেশ কয়েকবারই আক্রমণের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল ইন্টার মিলান।
রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষের ম্যাচে ফেরা যাক। ম্যাচে মাদ্রিদের একটা কর্নারের বিপরীতে সিটি পেয়েছিলো আঠারোটি কর্নার। এর প্রায় সবগুলোই ফেলা হয়েছিল পোস্টের সামনের ছয়গজি বক্সে, আন্দ্রিই লুনিনের জন্য সেগুলো ঠেকানো খুব কঠিন কিছু ছিল না। এর আগে গার্দিওলার দলকে শর্ট কর্নার নিতে দেখা যেত প্রচুর, কম্বিনেশনাল প্লে-ই ছিল তাঁর দলের মূল কৌশল।
এই ম্যাচে আর্লিং হাল্যান্ডের পারফরম্যান্সও সিটির পরাজয়ের অন্যতম কারণ। দুজন সেন্টারব্যাকের দ্বারা হাল্যান্ডকে মার্ক করেছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। তাই মাদ্রিদের বক্সের মধ্যে হাল্যান্ড খুব বেশি কিছু করার সুযোগ পাননি, কিন্তু আঠারো-গজের বক্সের বাইরেও তিনি ছিলেন নিষ্প্রভ।
Image Source:The Athletic
Image Source:The Athletic
গার্দিওলার সেন্টার ফরোয়ার্ড নিচে নেমে দলকে সাহায্য করছেন না, এমনটা অকল্পনীয়। কিন্তু হাল্যান্ড করেছেন সেটাই, মাঠের নব্বই মিনিটে মোটে সাতটা পাস দিতে পেরেছেন তিনি। তাঁর পরিবর্তে অতিরিক্ত সময়ে মাঠে নামা আলভারেজ পাস দিতে পেরেছিলেন মোট দশটি। মাদ্রিদের দুই সেন্টারব্যাকের পজিশনিংয়ের ভালো পরীক্ষাও নিয়েছিলেন আলভারেজ।
Image Source:The Athletic
গার্দিওলার আরেক সাবস্টিটিউশন, জেরেমি ডকুর অবদান ছিল সিটির একমাত্র গোলে। বাঁ দিক থেকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়া ডকুর শটটা ঠিকমতো ক্লিয়ার করতে পারেননি আন্তোনিও রুডিগার। ফিরতি শটে ডি ব্রুইনা বলকে জড়িয়ে দেন জালে।
ম্যাচে সমতা ফিরিয়েছিলেন ডি ব্রুইনা; Image Source: Getty Images
দ্বিতীয়ার্ধে ফোডেন আর বার্নার্দোর জায়গাও অদলবদল করে দেন গার্দিওলা। মাঠের মাঝের দিকে ফোডেনকে বল পায়ে আরো বেশি দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।
সব মিলিয়ে, ম্যানচেস্টার সিটির সামনে খুব ভালো সুযোগ ছিল নিজেদের মাটিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই রিয়াল মাদ্রিদকে পরাজিত করার। মাদ্রিদের খেলোয়াড়রা খুব বেশিক্ষণ পায়ে বল রাখতে পারছিলেন না, ইনজুরি আর সাসপেনশনে পুরো শক্তির দলও ছিল না তাঁদের। কিন্তু সিটিজেনরা কাজে লাগাতে পারেননি প্রাপ্ত সুযোগগুলো। সেন্টারব্যাকদের ব্যবহার করতে গিয়ে আক্রমণের ধার হারানো, ডি ব্রুইনার সেরা ফর্মে না থাকা, দুই উইংয়ে গ্রিলিশ-ফোডেনের সমন্বয়ের অভাব আর সবার সামনে অকার্যকর হাল্যান্ড, ম্যানচেস্টার সিটির পরাজয়ের পেছনে দায়ী এর সবগুলোই।
রিয়াল মাদ্রিদ... আরো একবার; Image Source: Getty Images
উল্টো দিকে, এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও ম্যাচ বের করে আনাটা রিয়াল মাদ্রিদের ডিএনএর মধ্যেই আছে। তাই তো ম্যাচের প্রথম সুযোগেই দলকে এগিয়ে নেন রদ্রিগো, এরপর দাঁতে দাঁত চেপে রক্ষণকাজটা সম্পন্ন করেন সবাই মিলে। তুলির শেষ আঁচড় দিয়ে বীর হয়ে যান রিয়াল মাদ্রিদের তৃতীয় পছন্দের গোলরক্ষক আন্দ্রিই লুনিন। বার্নার্দো আর কোভাচিচের শটদুটো এসে থেমে যায় তাঁর জাদুকরী গ্লাভসে। ইতিহাদ-ফাঁড়া কেটে যায় রিয়াল মাদ্রিদের। আরো একবার নিজেদের আভিজাত্য দেখিয়ে দেয় মাদ্রিদের রাজারা।