লো ব্লক: নিন্দিত, তবে কার্যকর এক কৌশল
খুব নন্দিত না হলেও ফুটবলের কার্যকর কৌশলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো লো ব্লক। দর্শকপ্রিয়তার দিক থেকে পেছনের সারির হলেও ম্যাচের ফলাফল বের করে আনতে, পরাজয় এড়াতে বা কম সংখ্যক গোল হজম করতে কোচদের বেশ পছন্দ এটি। দিয়েগো সিমিওনে, হোসে মরিনহো, শন ডাইকরা তো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন এই লো ব্লককে। এই লো ব্লকের খুঁটিনাটি নিয়েই আলোচনা করেছে কোচেস ভয়েস।
লো ব্লক কী?
নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, লো ব্লক হলো ফুটবল খেলার রক্ষণ কাজের একটা বিশেষ ধরণ। দলগুলো নিজেদের ডিফেন্সিভ থার্ডকে প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য এই কৌশল অবলম্বন করে। মূলত বল পায়ে না থাকা অবস্থায় লো ব্লক ডিফেন্ডিং করা হয়। লো ব্লকের জন্য নিজেদের অর্ধে, নিজেদের পোস্টের কাছে অবস্থান করেন ডিফেন্ডাররা। বক্সের আশেপাশে প্রতিপক্ষকে কোনো রকম জায়গা না দেওয়ার প্রতি খেয়াল রাখেন তাঁরা। দলের ব্যাকলাইন অনেকটা নিচে অবস্থান করে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের মার্ক করার কাজ করেন। আর রক্ষণের ঠিক সামনে পর্যাপ্ত দূরত্ব রেখে দুটো সারিতে অবস্থান নেন যথাক্রমে মধ্যমাঠ ও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা।
লো ব্লককে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন সিমিওনে; Image Source: Getty Images
আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, লো ব্লকের ক্ষেত্রে দলগুলো নিজেদের পোস্টের কাছাকাছি অবস্থান করে, যা মিড ব্লক বা হাই প্রেসের চেয়ে ভিন্ন। লো ব্লকে দলগুলো মাঠের নিজেদের ডিফেন্সিভ থার্ডে বেশি মনোযোগ দেয়, মিড ব্লকের ক্ষেত্রে সেটা মাঝমাঠ, আর হাই প্রেসে দলগুলো বলটা জেতার চেষ্টা করে নিজেদের অ্যাটাকিং থার্ডেই। তবে হ্যাঁ, এই তিনটা কৌশলের ক্ষেত্রেই একটা ব্যাপার সাধারণ, তিনটা কৌশলই প্রয়োগ করা হয় বল হারানোর পরে, ডিফেন্সিভ ট্রানজিশনে।
পায়ে বল থাকা অবস্থায় লো ব্লকের কৌশল
লো ব্লক মূলত কোন দলের আউট-অব-পজেশন কৌশল। তবে বল পজেশন থাকা অবস্থায় কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আসে। সাধারণভাবে লো ব্লক খেলা দলটার সব খেলোয়াড়ই নিজেদের অর্ধে অবস্থান করে বিধায় প্রতিপক্ষ মাঠের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে প্রায় নির্বিঘ্নে বিচরণ করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপক্ষ দলটা চেষ্টা করতে থাকে লো ব্লকের বিরুদ্ধে আক্রমণের পর আক্রমণ করে গোল করার জন্য, এবং এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের অর্ধে অনেকটা জায়গা অরক্ষিত রাখতেও পিছপা হয় না তারা।
Image Source: Coaches' Voice
অর্থাৎ, যদি লো ব্লক করতে থাকা দলটা কোনভাবে বল জিততে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের সামনে সুযোগ থাকে দ্রুতগতির প্রতি-আক্রমণ করে প্রতিপক্ষের অর্ধে পৌঁছে যাওয়ার। এই প্রতি-আক্রমণটা দুই উইং ধরে ঘটার সম্ভাবনাই বেশি থাকে, কেননা লো ব্লকের বিপক্ষে আক্রমণের জন্য প্রতিপক্ষের দুই ফুলব্যাককে মাঠের ওপরের দিকে অবস্থান করে। তবে এটাও সত্য, লো ব্লকে থাকা দলটা বল পুনরুদ্ধার করার সুযোগ পায়ে নিজেদের ডিফেন্সিভ থার্ডে, আর সেখান থেকে প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের দূরত্ব অনেক বেশি। তাই প্রতি-আক্রমণে সফল হতে হলে গতির সাথে প্রয়োজন হয় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার। পাসিং, ড্রিবলিং, সুইচ অব প্লে, বল পায়ে বা বল ছাড়াই দৌড়, যেটাই হোক না কেন, খুব দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে হয়। সেন্টার ফরোয়ার্ডকে নিজেদের রক্ষণ কর্তৃক ক্লিয়ার করা বলটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভালোভাবে হোল্ড করতে জানতে হয়, যতক্ষণে অন্যান্য খেলোয়াড়রা আক্রমণের জন্য মাঠের ওপরের দিকে উঠে আসতে পারে।
পায়ে বল না থাকা অবস্থায় লো ব্লকের কৌশল
এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু গোল বাঁচানো, তাই নিজেদের পোস্টের সামনে তিনটা রেখা তৈরি করে রক্ষণের কাজ সামলান খেলোয়াড়রা। ডিফেন্ডারদের ওপরে ওঠার অনুমতি তেমন একটা দেওয়া হয় না। রক্ষণে কোন রকম জায়গা তৈরি হলে সাথে সাথে সেটা পূরণের দায়িত্ব থাকে মিডফিল্ডার ও উইঙ্গারদের। প্রতিটা খেলোয়াড়দের অখণ্ড মনোযোগ দরকার হয় এই কৌশলে। নিজেদের জায়গা থেকে সরে গিয়ে বল উদ্ধারের চেষ্টা করতেও নিষেধ করেন কোচ। এর অন্যথা হলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় জায়গা পেয়ে যুতসই আক্রমণ করতে পারেন।
এছাড়া, নিজেদের রক্ষণরেখাগুলোর মধ্যে কিছুটা দূরত্বও বজায় রাখতে হয়। দুটো রক্ষণরেখার মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ও থাকতে হয়। প্রতিপক্ষ আক্রমণের পর আক্রমণ করবে, এটা ধরে নিয়েই মনোযোগের সাথে ডিফেন্ড করে যেতে হয়। প্রতিপক্ষের ক্রস আটকাতে হয়, শট ব্লক করতে হয়, বলকে দ্রুত বিপদমুক্ত করতে হয়।
লো ব্লকের উদাহরণ
দিয়েগো সিমিওনে (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ)
Image Source: Coaches' Voice
লো ব্লকের ব্যাপারে আলোচনা হবে আর দিয়েগো সিমিওনের নাম আসবে, সেটা অসম্ভব। লো ব্লককে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন এই আর্জেন্টাইন কোচ। তাঁর অধীনে নিয়মিত লো ব্লক কৌশলে খেলেছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, সাফল্যও পেয়েছে। সাধারণত বল পায়ে না থাকা অবস্থায় দলকে ৪-৪-২ ফরমেশনে খেলান সিমিওনে। মিডফিল্ডের চারজনের মধ্যে একটা সময়ে সাউল, কোকে, মার্কোস লরেন্তের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ মিডফিল্ডাররা সুযোগ পেয়েছেন নিয়মিত, এর সাথে ছিলেন রদ্রি, হেক্টর হেরেরা, জিওফ্রে কন্ডোগবিয়া, থমাস পার্টে, গাবি, কারাস্কোরা। গত দুই মৌসুম ধরে রদ্রিগো ডি পলও অ্যাটলেটিকোর মাঝমাঠের পরিচিত মুখ। মূলত রক্ষণরেখার ওপরে আরেকটা রেখা তৈরি করা, প্রতিপক্ষের জন্য মাঠের মাঝের অংশকে সংকুচিত করে বল দখলের লড়াইয়ে যাওয়া, এরপর দ্রুত বল পুনরুদ্ধার করে আক্রমণে ওঠাই ছিল এই মিডফিল্ডারদের কাজ। তবে ২০২০-২১ মৌসুম থেকে সিমিওনে তাঁর কৌশলে কিছুটা বদল এনেছেন। তিনজন সেন্টারব্যাকের সাথে দুইজন উইংব্যাক এবং তিনজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার নিয়েই এখন একাদশ সাজান তিনি।
হোসে মরিনহো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, টটেনহ্যাম এবং ইন্টার মিলান)
দিয়েগো সিমিওনের মতো হোসে মরিনহোও তাঁর লো ব্লকের জন্য বিখ্যাত। তবে নিজের কোচিং ক্যারিয়ারের পুরোটা জুড়েই তিনি লো ব্লক ব্যবহার করেননি, বরং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, টটেনহ্যাম ও ইন্টার মিলানের কোচিং করাওর সময়ে মাঝেমধ্যে লো ব্লক ব্যবহার করতে দেখা গেছে তাঁকে। রক্ষণকে আরো বেশি জমাটবদ্ধ করতে উইঙ্গারদেরও ট্র্যাকব্যাক করার নির্দেশনা দিতেন তিনি, দলের ‘ব্যাক ফোর’ তাই সময়ে সময়ে হয়ে যেত ‘ব্যাক সিক্স’।
Image Source: Coaches' Voice
টটেনহ্যামের কোচ থাকাকালীন ব্যাক সিক্সে উইঙ্গারদের বদলে দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে নেমে আসার নির্দেশনা দিতেন। ৪-২-৩-১ ফরমেশনটা কার্যত হয়ে যেত ৬-৩-১। উইঙ্গাররাও অবশ্যই ইচ্ছামতো দৌড়ানোর স্বাধীনতা পেতেন না, তাঁরাও মাঠের ভেতরের দিকে সরে এসে তিনজনের ওই দ্বিতীয় লাইনটা তৈরি করতেন।
শন ডাইক (বার্নলি)
Image Source: Coaches' Voice
বার্নলির কোচ থাকার সময়ে শন ডাইক ন্যারো ৪-৪-২ ফরমেশনে খেলাতেন দলকে। প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকার জন্য লো ব্লকই ছিল তাঁর প্রধান কৌশল। তাঁর উইঙ্গাররা ট্র্যাকব্যাক করে নিচে নেমে এসে মাঝমাঠে চারজনের একটা রেখা তৈরি করতেন। ফুলব্যাকরা তেড়েফুঁড়ে প্রেস করতে বল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে, আর তাঁদের পেছনে তৈড়ি হওয়া জায়গাটা পূরণ করার চেষ্টা করেন উইঙ্গাররা। বেন মী আর জেমস টারকোস্কির মতো লম্বা ও শারীরিকভাবে শক্তিশালী সেন্টারব্যাকদের দিয়ে নিজেদের পেনাল্টি এরিয়া রক্ষার কাজটা চালিয়ে নিতেন শন ডাইক, সাথে নির্দেশনা থাকতো বলটাকে যেকোন উপায়ে দ্রুত দূরে পাঠানোর।
টটেনহ্যামে কন্তের লো ব্লক; Image Source: Coaches' Voice
অন্যান্য কোচদের মধ্যে টটেনহ্যামে আন্তোনিও কন্তে, উলভারহ্যাম্পটনে নুনো এস্পিরিতো সান্তোস এবং ক্রিস্টাল প্যালেসে রয় হজসনও বিভিন্ন সময়ে দলকে লো ব্লকে খেলিয়েছেন।
লো ব্লকের সুবিধা
ভালো প্রস্তুতি নিয়ে লো ব্লকের কাজটা ঠিকভাবে করতে পারলে প্রতিপক্ষের জন্য গোল করাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়। পোস্টের কাছাকাছি অনেক বেশি খেলোয়াড়ের উপস্থিতির কারণে প্রতিপক্ষ জায়গা খুঁজে পায় না। একই সাথে বল নিয়ে পোস্ট বরাবর মাঠের মাঝামাঝি অংশে অবস্থান করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে। লো ব্লকের কারণে গোলরক্ষক আর রক্ষণের মাঝে জায়গা খুবই কমে আসে, প্রতিপক্ষ তাই লং বল খেলেও সুবধা করতে পারে না। আবার খেলোয়াড়ের আধিক্যের কারণে প্রতিপক্ষের থ্রু বলগুলোও খুঁজে পায় না অভিষ্ট খেলোয়াড়কে। প্রতিপক্ষের জন্য তখন একটাই পথ খোলা থাকে, দুপাশ থেকে অনবরত ক্রস করতে থাকা, এবং একটা অন টার্গেট হেডের জন্য প্রার্থনা করা। তবে হ্যাঁ, ঠিকঠাক লো ব্লক করতে পারলে দুপাশ থেকে ভেসে আসা ক্রসও রুখে দেওয়া অসম্ভব না।
লো ব্লকে খেলার আরো একটা সুবিধা আছে। হাই প্রেসিং ফুটবল যতটা শক্তিক্ষয়ী ও ক্লান্তিকর, লো ব্লক ততটা নয়। খেলোয়াড়রা তাই খুব দ্রুতই ক্লান্ত হন না, পুরো এনার্জি নিয়ে রক্ষণে মনোযোগ দিতে পারেন। তাই এগিয়ে থাকা দলের স্কোরলাইন অটুট রাখতে লো ব্লক বেশ ভালো ও কার্যকর কৌশল।
লো ব্লকের অসুবিধা
লো ব্লক খেলার অর্থ মাঠের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে নিজেরা বিচরণ করা এবং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা প্রতিপক্ষের জন্য ছেড়ে দেওয়া। একই সাথে এটাও মেনে নেওয়া, যে বল পজেশনের বেশিরভাগটা প্রতিপক্ষের কাছেই থাকবে।
লো ব্লক দিয়ে বার্সাকে পরাস্ত করে মরিনহোর সেই উন্মাতাল দৌড়: Image Source: Getty Images
লো ব্লকের ক্ষেত্রে বল পুনরুদ্ধার করার পরে প্রতিপক্ষের পোস্টের দূরত্ব অনেক বেশি থাকে, কিন্তু অন্যান্য রক্ষণাত্মক কৌশল, যেমন মিড ব্লক এবং হাই প্রেসে তত বেশি দূরত্ব থাকে না। লো ব্লকে খেলা দলটি তাই গোল করতে চাইলে প্রয়োজন হয় দ্রুতগতির খেলোয়াড়দের, একই সাথে দ্রুত রিকোভারির পর বল নিয়ে প্রতিপক্ষের পোস্টের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট এনার্জির প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি, লো ব্লকে অনেকক্ষণ ধরে রক্ষণ কাজটা করার প্রয়োজন হয় বলে অখণ্ড মনোযোগটাও দরকার। মনোসংযোগে সামান্যতম চিড়, কোন ডিফেন্ডারের একটা ছোট্ট ভুল, দলীয় রক্ষণের ভুল পজিশনিং, এর যেকোন একটি গোল হজমের জন্য যথেষ্ট হতে পারে, যে ভুলগুলো হয়তো মিড ব্লক বা হাই প্রেসের ক্ষেত্রে অতটা ভয়ঙ্কর নাও হতে পারে।
লো ব্লকের ক্ষেত্রে দলের এগারোজন খেলোয়াড়কেই ব্যক্তিগত স্বার্থ ভুলে দলের জন্য খেলতে হয়। আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দেরও নিজেদের স্বাভাবিক খেলার বদলে রক্ষণে অধিক সাহায্য করতে হয়। দলের কোচকে তাই লো ব্লকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই ব্যাপারটাও বিবেচনা করতে হয়।
লো ব্লকের বিকল্প
আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, লো ব্লকের বিকল্প হিসেবে মিড ব্লক বা হাই প্রেসিং ফুটবল খেলানো যেতে পারে। তবে প্রতিটি ধরণই যেহেতু ভিন্ন, কোচকে অবশ্যই তাঁর দলের সক্ষমতা এবং শক্তি ও দুর্বলতা অনুসারে খেলার ধরণ বিবেচনা করতে হবে।