বড় দলগুলোর বিপক্ষে কেন খুঁজে পাওয়া যায় না লিভারপুলকে?
এ বছরের শুরুর দিকেই এসেছিল ঘোষণাটা। আট বছর পর লিভারপুলের ডাগআউট ছাড়ছেন ম্যানেজার ইয়ুর্গেন ক্লপ। প্রিমিয়ার লিগে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে তখন দলটি, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ম্যানচেস্টার সিটি পাঁচ পয়েন্ট পিছিয়ে। প্রিমিয়ার লিগ, ইউরোপা লিগ, এফএ কাপ এবং লিগ কাপ, চার টুর্নামেন্টেই তখন বেঁচে আছে অলরেডরা, ‘কোয়াড্রপল’ হাতে তুলে ক্লপকে বিদায় জানানোর স্বপ্নটা তখনও জীবন্ত। অথচ ঠিক তিন মাস পরে, লিভারপুলের ঝুলিতে গেছে শুধু লিগ কাপের শিরোপা। এফএ কাপ আর ইউরোপা লিগ থেকে বিদায় হয়ে গেছে ইতোমধ্যে, প্রিমিয়ার লিগের স্বপ্নটাও আর রঙিন নেই। কেন হঠাৎ ভেঙে পড়লো মার্সিসাইডের ক্লাবটি? প্রিমিয়ার লিগে বড় দলগুলোর বিপক্ষে কেন এমন হতশ্রী লিভারপুলের? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে টোটাল ফুটবল অ্যানালাইসিস।
হতশ্রী লিভারপুল; Image Source: Getty Images
প্রথমেই একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে রাখা ভালো। বড় দল বলতে এখানে প্রিমিয়ার লিগের ‘বিগ সিক্স’ ক্লাবকে বোঝানো হয়েছে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল, চেলসি এবং টটেনহ্যামের বিপক্ষে চলতি মৌসুমে লিগে খেলা নয় ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জিতেছে ক্লপের শিষ্যরা। ছয়টি ম্যাচ শেষ হয়েছে অমীমাংসিতভাবে, আর দুটো পরাজয়। টটেনহ্যামের বিপক্ষে অ্যানফিল্ডের ম্যাচটা এখনো বাকি, তবে শিরোপাপ্রত্যাশী যেকোন দলের কাছ থেকে এমন পারফরম্যান্স নিঃসন্দেহে অপ্রত্যাশিত।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
Image Source: Total Football Analysis
ক্লপের লিভারপুলের একটা বড় বৈশিষ্ট্য বলের পজেশন রেখে খেলা। এই মৌসুমে প্রতি ম্যাচে গড়ে ৬০.৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বল থাকছে লিভারপুলের খেলোয়াড়দের পায়ে, যা প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সর্বোচ্চ। কিন্তু, কিছু কিছু ম্যাচে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে, বিশেষত বড় দলগুলোর বিপক্ষে।
স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে চেলসির বিপক্ষে ১-১ স্কোরলাইনে ড্র, ইতিহাদে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে ১-১ এ ড্র, অথবা টটেনহ্যামের মাঠে ২-১ ব্যবধানে পরাজয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ম্যাচে লিভারপুলের খেলোয়াড়দের পায়ে বল ছিল শতকরা ৪৫ শতাংশের কম ক্ষেত্রে। লক্ষ্যণীয়, তিনটাই ছিল লিভারপুলের জন্য অ্যাওয়ে ম্যাচ।
যে নয় ম্যাচের কথা বলা হলো আগে, এর মধ্যে মাত্র একবার, অ্যানফিল্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইডের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্রয়ের ওই ম্যাচেই কেবল নিজেদের গড় পজেশনের চেয়ে বেশি পজেশন নিয়ে ম্যাচ শেষ করতে পেরেছে লিভারপুল।
Image Source: Total Football Analysis
কিন্তু শুধু কম পজেশন রাখা মানেই তো আর খারাপ পারফরম্যান্স না। অনেক ম্যাচেই, ম্যাচের নির্দিষ্ট সময়ে, ম্যানেজার তাঁর কৌশল বদল করে কম পজেশন রেখে খেলতে চাইতেই পারেন। লিভারপুলের ক্ষেত্রেও সবসময়ে ব্যাপারটা তেমন নয়। লিভারপুলকে আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে প্রতিপক্ষের অর্ধে তাদের পারফরম্যান্স দিয়ে। ম্যাচে লিভারপুল কতটা স্বচ্ছন্দ, কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছে প্রতিপক্ষের খেলার ধরণের সাথে, এর একটা বড় নির্দেশক হলো প্রতিপক্ষের বক্সে অলরেডদের পারফরম্যান্স। ক্লপ যে ট্যাকটিক্স নিয়েই নামুন না কেন, তাঁর দল সাধারণত প্রতিপক্ষের রক্ষণের ওপর ছড়ি ঘোরাতেই পছন্দ করে।
এবার আসা যাক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে লিভারপুলের লিগের এই মৌসুমের দুটো ম্যাচে। হোম এবং অ্যাওয়েতে যথাক্রমে ০-০ ও ২-২ এ ড্র হওয়া ম্যাচদুটোতে লিভারপুল সর্বমোট শট নিয়েছে ৫৬টা, ওদিকে ইউনাইটেড শট নিতে পেরেছে দশবার। নিজেদের নেওয়া ৫৬ শটের মধ্যে মাত্র দুবার বল জালে জড়িয়েছে অলরেডদের। বোঝাই যাচ্ছে, বড় ম্যাচে শটের পর শট নিলেও, এক্সপেক্টেড গোল বা এক্সজি অনেক বেশি থাকলেও, গোল পাওয়াটা একটু কষ্টই হয়ে যাচ্ছে ক্লপের শিষ্যদের জন্য।
শুধু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নয়, বরং অন্যান্য অ্যাওয়ে ম্যাচেও এই ব্যাপারে ভুগেছে লিভারপুল। এই মৌসুমে লিগে প্রতি নব্বই মিনিটে লিভারপুল গড়ে শট নেয় ১৮.৮৮টা, এক্সজি থাকে ২.৪। কিন্তু বড় দলগুলোর বিপক্ষের নয় ম্যাচের পাঁচবারই শট আর এক্সজিতে পিছিয়ে ছিল লিভারপুল, এর মধ্যে অ্যাওয়ে ম্যাচেই চারবার।
Image Source: Total Football Analysis
তবে শুধু শট আর এক্সজি নয়, ক্লপের লিভারপুলের আরো একটা বৈশিষ্ট্য আছে। পায়ে বল না থাকলেও দারুণ এনার্জি, ইন্টেনসিটি আর আগ্রাসন নিয়ে খেলতে পারে দলটি। প্রতিপক্ষের অর্ধে হাই প্রেস করে খেলতেও অভ্যস্ত দলটি, ৮.০৬ পিপিডিএ-এর হিসাব সেটাই বলছে। (পিপিডিএ বা পাসেস পার ডিফেন্সিভ অ্যাকশন হলো প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট থেকে মাঠের ষাট শতাংশ জায়গায় প্রতিপক্ষের খেলা পাসের সংখ্যা এবং প্রেস করতে থাকা দলের ডিফেন্সিভ অ্যাকশন তথা ফাউল-ইন্টারসেপশন-ডিফেন্সিভ ডুয়েল জয়-স্লাইডিং ট্যাকেলের যোগফলের অনুপাত।)
তো পরিসংখ্যান যেটা বলছে, বড় ম্যাচে লিভারপুলের পিপিডিএ বেড়ে যায় তাদের গড় পিপিডিএ-এর চেয়ে, অর্থাৎ লিভারপুলের খেলোয়াড়দের প্রতিটা ডিফেন্সিভ অ্যাকশনের মাঝে বেশি সংখ্যক পাস খেলার সুযোগ পায় প্রতিপক্ষ। অ্যানফিল্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচটা বাদে প্রতিটা বড় ম্যাচেই দেখা গেছে এই চিত্র। অর্থাৎ পায়ে বল না থাকা অবস্থায় যে আগ্রাসন আর হাই প্রেসের জন্য বিখ্যাত ক্লপের শিষ্যরা, তার খুব কম অংশই দেখা গেছে এই মৌসুমের বড় ম্যাচগুলোতে।
ওপরের গ্রাফে একই সাথে লিভারপুলের বিপক্ষে দলগুলোর পিপিডিএ-এর হিসাবটাও দেখা যাচ্ছে। এটাও পরিষ্কার, লিভারপুলের প্রেসিংটা তাদেরকেই ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে ম্যানসিটি আর টটেনহ্যাম, দুটোই নিজেদের মাঠে।
পজেশন আর আগ্রাসনের স্বল্পতা
আগেই বলা হয়েছে, এই মৌসুমের বড় ম্যাচগুলোতে বল পজেশন কমে গেছে লিভারপুলের, আবার হাই প্রেস এবং আগ্রাসনও ঠিকঠাক আগের মতো হচ্ছে না। ব্যাপারটা আরেকটু বিস্তারিত দেখা যাক।
Image Source: Total Football Analysis
ম্যানচেস্টার সিটি এবং ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষের ম্যাচে লিভারপুলের ডিফেন্সিভ অ্যাকশনের এলাকা বা টেরিটরি দেখা যাক। ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষের ম্যাচটা বেছে নেওয়া হয়েছে, কেননা এই দলটার বিপক্ষে লিভারপুলের পিপিডিএ অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। অন্যদিকে হোমে হোক বা অ্যাওয়েতে, ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে খেলাটা সবসময়েই কঠিন।
দুটো ছবির মধ্যে কিছু বড়সড় পার্থক্য আছে। প্রথমত, সিটির বিপক্ষে লিভারপুলের ডিফেন্সিভ লাইন শুরু হয়েছে অনেকটা নিচে, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা লিভারপুলের অর্ধে একটু বেশি বিচরণ করার সুযোগ পেয়েছেন। এর পাশাপাশি, সিটির অর্ধে লিভারপুলের ডিফেন্সিভ অ্যাকশনও বেশ কম।
Image Source: Total Football Analysis
প্রতিপক্ষের অর্ধে লিভারপুলের এই ডিফেন্সিভ অ্যাকশনের ঘাটতিটা শুধু সিটির বিপক্ষেই লক্ষ্যণীয় নয়, একই ব্যাপার দেখা গেছে টটেনহ্যামের বিপক্ষেও। ওই ম্যাচের রেফারিং নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে, কিন্তু লিভারপুলও নিজেদের চেনা রূপে ছিল না সেদিন। বল পজেশন কম, প্রতিপক্ষের পোস্টে শট কম, বল হারালে তা পুনরুদ্ধারের জন্য আগ্রাসন আর তাড়নাও ছিল কম। ওদিকে স্পার্স ছিল একেবারেই বিপরীত। হাই ইন্টেনসিটি, কাউন্টারপ্রেসিং, মাঠের ওপরের দিকে বল পুনরুদ্ধার, সবদিক থেকেই এগিয়ে ছিল টটেনহ্যাম।
সুযোগ গ্রহণ না করা
নয়টা বড় ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটাতে জিতেছে লিভারপুল। সত্য। কিন্তু তার মানে এই নয় যে লিভারপুল প্রতিটা ম্যাচেই সমান বাজে খেলেছে বা একেবারেই সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। বেশ কিছুক্ষেত্রেই লিভারপুল অনেক সুযোগ তৈরি করেছে, কিন্তু সাথে সাথে অপচয়ও করেছে সেগুলো।
Image Source: Total Football Analysis
ম্যান ইউনাইটেডের বিপক্ষে ২-২ ড্রয়ের ম্যাচটাই দেখা যাক। ক্লপের দলের পজেশন ছিল ৫৯.৬৩ শতাংশ, এক্সজি ৪.৭৫, ২৪টা শট, কিন্তু তবুও ম্যাচটা শেষ হলো অমীমাংসিতভাবে। হ্যাঁ দুটো গোল এসেছে সত্যি, কিন্তু পরিসংখ্যানের বিচারে গোল আসার কথা আরো বেশি।
ওই ম্যাচে লিভারপুল মূলত চেষ্টা করেছিল মাঝ বরাবর আক্রমণ করার, ওপরের ছবিতে যেমনটা দেখা যাচ্ছে। এক্সপেক্টেড অ্যাসিস্টও ছিল ২.৬৩, কিন্তু লিভারপুল অ্যাসিস্ট করতে পেরেছে নিজেদের একটা মাত্র গোলে। এর কারণ, সোজা বাংলায়, সুযোগ কাজে না লাগাতে পারা।
কিন্তু এই গোল মিসের মহড়ায় দায়ী কে বা কারা?
Image Source: Total Football Analysis
ডারউইন নুনেজের নামটাই আসছে সবার আগে। এই স্ট্রাইকার গোল-অ্যাসিস্টে অবদান রাখেন সত্যি, কিন্তু সুযোগও মিস করেন প্রচুর, লিভারপুলকে সময়ে সময়ে ভোগায় বিষয়টা। তবে হ্যাঁ, গোল মিসের মহড়ায় তিনি একাই দায়ী নন। ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে সহজ সুযোগ নষ্ট করেছিলেন কার্টিস জোনস, পরবর্তীতে দলও তার খেসারত দেয় ম্যাচ হেরে।
লিভারপুলের পাঁচ ফরোয়ার্ড, লুইজ ডিয়াজ, কোডি গাকপো, দিয়োগো জোটা, মোহামেদ সালাহ এবং ডারউইন নুনেজ, প্রত্যেকেই শট নেওয়ার দিক থেকে প্রিমিয়ার লিগের গড় মানের ওপরে অবস্থান করছেন, কিন্তু গোল কনভার্সনের হারে গড় মানের ওপরে রয়েছেন কেবল দুইজন; দিয়োগো জোটা এবং মোহামেদ সালাহ। অর্থাৎ অনেক অনেক শট নিচ্ছেন প্রত্যেকেই, কিন্তু গোল আসছে না সেই অনুপাতে।
অনেকেই বলতে পারেন যে, এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দিয়োগো জোটারই দলের প্রথম পছন্দের স্ট্রাইকার হওয়া উচিত, কিন্তু ডারউইন নুনেজ তাঁর গতিসহ অন্যান্য গুণাবলি দিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সে যে ভীতিকর অবস্থাটা তৈরি করতে পারেন, সেটা খুব কম স্ট্রাইকারই পারেন।
বড় ম্যাচে গোল মিসের মহড়ায় নামেন লিভারপুলের ফরোয়ার্ডরা; Image Source: Getty Images
মোদ্দা কথা এই, পায়ে বল থাকুক বা না থাকুক, বড় দলের বিরুদ্ধে এই মৌসুমে বেশ ভুগেছে ক্লপের শিষ্যরা। হাই প্রেসিং ফুটবলের প্রয়োগ ঘটেনি ভালোমতো, বল পজেশন কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে, আক্রমণভাগে প্রাপ্ত সুযোগগুলো কাজে লাগেনি ঠিকঠাক। এই কারণেই ইয়ুর্গেন ক্লপকে ‘কোয়াড্রপল’ নয়, সম্ভবত একটা লিগ কাপ জিতেই বিদায় জানাতে হবে অলরেডদের।