• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    সান সিরোতে কাল ছিলেন ওঁরা ষোলজনও

    সান সিরোতে কাল ছিলেন ওঁরা ষোলজনও    

    গায়ে রোনালদোর গোলাপি টি-শার্ট, সামনের দেয়ালে জিদানের পোস্টার। সে দেয়ালেই বসানো বড় টিভি পর্দায় চোখ, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলতে মাঠে নামছে তাঁর প্রিয় দল রিয়াল মাদ্রিদ। দৃশ্যটা ইরাকের বালাদ শহরের এক মাদ্রিদ ফ্যান ক্লাবের ভিতরের। এ পর্যন্ত পড়ে পাঠকের মনে আল-ফুরাত ক্যাফের যে উৎসবমুখর ছবিটা ভেসে উঠতে পারে, বাস্তবের সাথে তার মিল নেই বললেই চলে। আলী কায়েস যে সোফাটায় বসে খেলা দেখছেন, ওটার পিছনেই আছে দু’ দুটো বুলেটের গর্ত। মেঝেতে রক্তের দাগ পুরোপুরি শুকোয় নি, বাতাসে লাশের গন্ধটাও এখনও নাকে এসে লাগার মতো। আর গুমোট পরিবেশটায় আর যাই হোক, উৎসবের লেশমাত্র নেই।

     

    তবু আলী কায়েসরা জড়ো হয়েছেন এই ক্লাবেই, চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল দেখবেন বলে, সপ্তাহ দুয়েক আগেই যেখানে আইএস-এর হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন মাদ্রিদ সমর্থক। ওরা তো চেয়েছিলই এভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ক্লাবটার অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে। এরপর ভয়ে ঘরে বসে থাকাটা তো তাদের উদ্দেশ্য সফল করবারই শামিল। কায়েসরা তা হতে দেবেন কেন? “আজকের রাতটা স্রেফ একটা ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য নয়, (এই রাত) দায়েশের (আইএস-এর আরবি নাম) উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার”, কায়েসের কণ্ঠে ঝাঁঝটা বেশ স্পষ্ট।

     

     

    নিজের মনেই বলে চলেছেন ২৯ বছর বয়সী ভদ্রলোক, “আমি নিশ্চিত এই ঘটনার আগে রোনালদো বালাদের নাম শোনে নি। আজ সে আমাদের শহীদদের স্মরণে কালো ব্যাজ পরে (লা লিগার শেষ ম্যাচে) মাঠে নামছে।”

     

    প্রিয় ক্লাবের তরফে এমন সাড়ায় আপ্লুত সাত বছর বয়সী ফ্যান ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা কাশেম ইসাও। তাঁর কাছেও গতকালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল ওই মৃত্যুপুরীতে বসে দেখার উদ্দেশ্য ছিল শোককে শক্তিতে পরিণত করা, “হামলার আগে তো অবশ্যই আমাদের এখানে ফাইনাল দেখা নিয়ে মহাপরিকল্পনা ছিল। কী থেকে কী হয়ে গেলো...এরপর একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত জেদ চেপে গেলো, এখানেই কাটাবো বিকেলটা, আমরা যে ভেঙে পড়ি নি সেটা বোঝাতেই।”

     

    ম্যাচের আগে ক্লাব প্রাঙ্গণে হয় নিহতদের স্মরণে শোকসভা। বাহারি রঙয়ের বাতি আর নিহতদের ছবি সম্বলিত পোস্টার-ব্যানারে মোড়ানো হয় পুরো ক্লাব। কড়া পুলিশি প্রহরার মাঝে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত নিহতদের প্রিয়জনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে বাতাস।

     

    সেদিন নিজের ১৭ বছর বয়সী ছেলে আর ভাইকে হারানো ফিরাস হাতেফ জানেন না কী তাঁদের অপরাধ ছিল, “খবর পেয়ে নিজের বন্দুকটা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ক্লাবে ঢুকেই প্রথম নজরে এলো মেঝেতে পড়ে থাকা ছেলের নিথর দেহটা। মাথায় একটা গুলি, আরেকটা ঘাড়ে। আমার এক ভাইকেও হারিয়েছি। কিন্তু কেন এসব? স্রেফ আমাদের দলের খেলা দেখতে ভালোবাসি বলে?”

     

    ওই ভালোবাসাটুকুই হয়তো শক্তি। জীবন তো আর ফিরিয়ে দেয়ার নয়, দেয়া যায় ভালোবাসাটুকুই। রিয়াল মাদ্রিদ সেটা শতগুণেই দিতে চাইছে। খেলোয়াড়দের কালো ব্যাজ ধারণ, ক্লাবের তরফে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি, র‍্যামোসদের টুইট; সর্বশেষ ক্লাব প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপাটাই উৎসর্গ করে দিলেন সেদিনের নিহতদের উদ্দেশ্যে, “এই জয় আমি আমাদের ইরাকি সমর্থকদের উৎসর্গ করতে চাই।”

     

    গত রাতের সান সিরোর গ্যালারিতে তাই সেই ষোলজনও ছিলেন, সশরীরে না হোক, প্রেরণা হয়ে নিশ্চিতভাবেই।