যেমন কাটল মোস্তাফিজের এবারের আইপিএল
জিম্বাবুয়ে সিরিজের জন্য আজকের ম্যাচের পরেই দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন মোস্তাফিজুর রহমান। ফেরার আগে আইপিএল থেকে ১৪ উইকেট নিয়ে যৌথভাবে আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হিসেবেই ফিরেছেন। গত কয়েক মৌসুমে কিছুটা নিষ্প্রভ থাকলেও এবারের আইপিএলে পুরনো দুষ্পাঠ্য মোস্তাফিজকে ফিরিয়ে এনেছিলেন; হয়ে উঠেছিলেন 'দ্য ফিজ'। তবে ভালো-মন্দ মিলিয়েই কেটেছে এবারের আসর। শুরুটা যেমন দুর্দান্ত হয়েছিল, শেষটা সেই তুলনায় বেশ খারাপ হয়েছে বলা চলে। তবুও এবারের আইপিএলের মোস্তাফিজ যেন আশার পারদ আরেকটু উঁচু করেই দিয়েছ। মোস্তাফিজের এবারের সেই যাত্রাটায় তাই আরেকবার চোখ বুলিয়ে আসা যাক।
প্রতিপক্ষ, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (৪/২৯)
আসরের প্রথম ম্যাচেই এবার মোস্তাফিজ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সেই ২০১৬ সালে অভিষেকেই আইপিএল কাপানো মোস্তাফিজের কথা। সেই আসরের পর এই প্রথম সেদিন হয়েছিলেন ম্যাচ সেরাও। চীপকের উইকেটকে কাজে লাগানোর মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবেই নিলামে হয়ত তাকে দলে ভিড়িয়েছিল চেন্নাই। প্রথম ম্যাচেই মোস্তাফিজও তাদের দিলেন দুহাত ভরেই। আসরের প্রথম উইকেটটা এলো তার হাত ধরেই। ফাফ ডু প্লেসিকে ফেরানোর পর একে একে রজত পাটিদার, ভিরাট কোহলি ও ক্যামেরন গ্রিনকে ফিরিয়েছেন সেদিন। বিশেষ করে গ্রিনকে যেভাবে বোকা বানিয়ে স্টাম্প উপড়ে ফেলেছিলেন, সেই বলটায় নিজের কাটারের কার্যকারিতা আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। সাথে যেন দিয়েছিলেন সেই বার্তাটাও - ফিজ ফিরিয়ে যাননি, ফিজ উইল কাম ব্যাক!
প্রতিপক্ষ, গুজরাট টাইটানস (২/৩০)
দ্বিতীয় ম্যাচে মোস্তাফিজের কাজটা তুলনামূলক সহজও ছিল বলা চলে। ২০৮ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেওয়ার পর সেটা তো যথেষ্ট মনে হতেই পারে; তখনও যে বোঝা যায়নি এবারের আইপিএলে রানের বন্যা হতে চলেছে! সেদিন অবশ্য সেটা বুঝার সুযোগ দেয়নি পুরো চেন্নাই বোলিং ইউনিট। শুরুটা আগের দিনের মত মনঃপুত না হলেও শেষটায় আবারও ঝলক দেখালেন। শেষদিকে ঝড় তোলার জন্য সুখ্যাতি কুড়ানো রাহুল তেওয়াতিয়া ও রশিদ খানের কাউকেই সেদিন সুযোগ দেননি ফিজ। কাটারে তাদের জন্য ফাঁদ পাতলেও দুটো উইকেটের জন্যই রাচিন রবীন্দ্রকেও সেদিন হয়ত বিশেষ ধন্যবাদ দিয়েছিলেন দারুণ ক্যাচ দুটোর জন্য।
প্রতিপক্ষ, দিল্লি ক্যাপিটালস (১/৪৭)
চেন্নাইয়ের বাইরে প্রথম ম্যাচ খেলতে যেয়ে সেদিন বেশ খাবি খেয়েছেন মোস্তাফিজ। বল হাতে বিশাখাপত্তনমে নিজের সাবেক সতীর্থ ডেভিড ওয়ার্নারের কাছে হেনস্থা হয়েছিলেন। তবে পরে তার উইকেটটা পেয়েছিলেন ঠিকই; ওয়ার্নার সুইচ হিটে শর্ট থার্ড ম্যান পার করতে চাইলে উড়ে গিয়ে পাথিরানা যেই ক্যাচটা সেদিন নিয়েছিলেন সেটা হয়ত নিজেই বহুদিন মনে রাখবেন মোস্তাফিজ।
প্রতিপক্ষ, কলকাতা নাইট রাইডার্স (২/২২)
চেন্নাইয়ে ফিরে আবারও ফর্মে ফিরেছিলেন এদিন মোস্তাফিজ। ডেথ ওভারে তখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সেরা ইকোনমি রেট ও সর্বোচ্চ উইকেট তার। নিজেকে আবারও শেষাংশে প্রমাণ করে শেষ ওভারে হানলেন জোড়া আঘাত। উইকেটে বেশ কিছুক্ষণ থাকলেও ধুঁকতে থাকা শ্রেয়াস আইয়ারকে ফেরানোর পর দুটো ডট বল দিয়ে পরে ফেরালেন মিচেল স্টার্ককেও। দারুণ সেই শেষ ওভারে কলকাতার মনোবলটাও যেন অনেকাংশেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন সেদিন।
প্রতিপক্ষ, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস (১/৫৫)
আসরের সবচেয়ে খারাপ ম্যাচ দুটোর একটা এদিনের ম্যাচেই কেটেছে তার। ওয়াঙ্খেড়ের উইকেট এমনিতেই রান প্রসবা। তার উপর লক্ষ্য বেঁধে দিয়ে বোলিংয়ে নামা মোস্তাফিজ সেদিন বল হাতে একেবারেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। মাথিশা পাথিরানার দুর্দান্ত স্পেলে সেদিন চেন্নাই জয় পেয়েছে ঠিকই; তবে মোস্তাফিজকে নিয়ে সেদিন প্রশ্নও কম ওঠেনি। অবশ্য ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাউন্ডারিতে সূর্যকুমার যাদবের দারুণ এক ক্যাচ নিয়েছিলেন, রান তাড়ার শেষদিকে চোখ রাঙাতে শুরু করে টিম ডেভিডকেও ফিরিয়েছিলেন - জয়ে তার ভুমিকাও সেদিন তাই একেবারেও কম ছিল না।
প্রতিপক্ষ, লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টস (১/৪৩)
শেষদিকে কাটারে বোকা বানিয়ে যেই নাম কুড়িয়েছিলেন সেটা এই ম্যাচে কিছুটা হলেও পণ্ড হয়েছিল বলা চলে। বরং লক্ষ্য তাড়ায় লক্ষ্ণৌকে মাঝেই আটকানোর কিছুটা সুযোগ করে দিয়েছিলেন ফিফটি পেয়ে যাওয়া কুইন্টন ডি কককেও ফিরিয়ে। অবশ্য ১৩৪ রানের ওপেনিং জুটি গড়ে ভিতটা ততক্ষণে গড়েই দিয়েছিলেন এই দক্ষিণ আফ্রিকান। মোস্তাফিজও তাই শেষটায় কোনো জাদু দেখাতে পারেননি সেদিন।
প্রতিপক্ষ, লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টস (১/৫১)
পরের ম্যাচেই আবারও একই প্রতিপক্ষ - এবার অবশ্য চীপকে, যেখানে তখন পর্যন্ত আসরে অপরাজিত চেন্নাই, যেখানে মোস্তাফিজ নিজেও উজ্জ্বল। অথচ এদিন মুদ্রার উলটো পিঠটাতো দেখলেন ঠিকই, সেটাও কী করুণ দশায়! ম্যাচটায় যেন বেরিয়ে গেল তার হাত ধরে। ২১১ রানের লক্ষ্য বেঁধে দিয়ে চীপকে জয়ের আশাই দেখছিল চেন্নাই। পঞ্চম ওভারেই লক্ষ্ণৌ অধিনায়ক রাহুলকে ফিরিয়ে সেই আশার পালে জোর হাওয়া লাগিয়েছিলেন মোস্তাফিজ নিজেই। এরপরেই মার্কাস স্টয়নিস রুদ্রমূর্তি ধারন করলেন। হাল্ক নামে সুপরিচিত এই অস্ট্রেলিয়ান পেশির জোর দেখালেন পুরোদমেই। বেধড়ক পিটুনিতে ততক্ষণে নিজের প্রথম আইপিএল সেঞ্চুরি পেয়ে গিয়েছেন স্টয়নিস। শেষ ওভারে তাদের প্রয়োজন ১৭ রান - এমতাবস্থায় মোস্তাফিজকে গুরুদায়িত্ব দিলেন গায়কোয়াড। মোস্তাফিজকে নিজের জায়গা বুঝিয়ে দিতে মোটে তিন বল নিলেন স্টয়নিস। ওভার দ্য উইকেটে বল করতে এসে ফুলার লেংথে বল দিয়ে মাথার ওপর দিয়ে বল উড়ে যেতে দেখলেন টানা দুই বলে। পরের বলে তো সকলের চক্ষু চড়কগাছ; পুরো খেই হারিয়ে দিলেন নো বল, ব্যাটের কানায় লেগে স্টয়নিস পেয়ে গেলেন বাউন্ডারিও। পরের বলেই ফ্রি হিটে আরেকটা বাউন্ডারি বের করে মোস্তাফিজকেও যেন রেহাই দিয়েছিলেন স্টয়নিস; দুরন্ত এক রান তাড়ায় অবশ্য মোস্তাফিজের সেদিন ঘুমটা হওয়ার কথা না।
প্রতিপক্ষ, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ (২/১৯)
আগের দুই ম্যাচেই বল হাতে বেহাল দশার পর এই ম্যাচে তাকে রাখা হবে কি না সেটা নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন - বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যখন একের পর এক ব্যাটিং রেকর্ড গড়তে থাকা হায়দরাবাদ। ঘরের মাঠে ঠিকই একাদশে জায়গা পেলেন মোস্তাফিজ। সকল প্রশ্নকে তুড়ি মেরে নিজেকে ঠিকই মেলে ধরলেন মোস্তাফিজ। লক্ষ্য তাড়ায় সেদিন একেবারেই সুবিধা করতে পারেনি কামিন্সের দল; বরণ করতে হয়েছে মৌসুমের সবচেয়ে বড় পরাজয়গুলোর একটা। সেই সাথে হায়দরাবাদকে মাত্র ১৩৪ রানে গুটিয়ে দিতে শেষ দুটো উইকেটই সেদিন নিয়েছেন মোস্তাফিজ।
প্রতিপক্ষ, পাঞ্জাব কিংস (০/২২)
মৌসুমে নিজের শেষ ম্যাচে এসেই উইকেট শুন্য থাকলেন মোস্তাফিজ। পাঞ্জাবের বিপক্ষে সংগ্রহটা মনমত হয়নি চেন্নাইয়ের। সেই সাথে বোলিং ইউনিটটাও ঠিক জ্বলে উঠতে পারেনি এদিন। মোস্তাফিজ অবশ্য নিজের কাজটা ঠিকঠাক করার চেষ্টা করেছেন। ম্যাচ যখন হাতের মুঠো থেকে প্রায় বেরিয়েই গিয়েছে তখন ১৫তম ওভারে এসে মেইডেন দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য টাইম আউটের পরে নিজের স্পেলের শেষ ওভারে দিয়ে বসলেন চারটা ওয়াইড! মোটামুটি মিতব্যয়ী এক স্পেল করলেও আইপিএলের এবারের যাত্রাটা তাই পরাজয় দিয়েই শেষ হল মোস্তাফিজের।