• আইপিএল ২০২৪
  • " />

     

    'সঠিক সময়' যেভাবে শিভাম দুবের দিন ফিরিয়ে দিল

    'সঠিক সময়' যেভাবে শিভাম দুবের দিন ফিরিয়ে দিল    

    ১৬ বলে ২৭ রান করে আউট হয়ে ফিরছেন ব্যাটসম্যান। কোচ কী বলবেন বলে আপনার ধারণা? কোচের কথা বাদ দিন। তিনে নামা ব্যাটার শিভাম দুবেরই আউট হয়ে আফসোস হচ্ছিল, আরও কিছু রান করতে পারলাম না। কিন্তু ড্রেসিংরুমে ফিরতেই সেই আফসোস উধাও। কোচ স্টিফেন ফ্লেমিং, ব্যাটিং কোচ মাইক হাসি- তারা বলছেন কিনা ‘ওয়েল প্লেড শিভ’, ‘গুড জব’, এমন কথা। দুবে তো অবাক। যখন বললেন, ‘আমি তো আরও রান আশা করেছিলাম’, তখন ফিরতি জবাব এলো- ‘তোমার কাছ থেকে যা আশা ছিল, তা তুমি করেছ’। ব্যস, আর কী লাগে। দুবে নিজেই বলেন, এই একটা ঘটনাই নাকি তার আত্মবিশ্বাসকে এক লাফে অনেক উপরে পাঠিয়ে দিয়েছিল! 

    চেন্নাইয়ের জার্সিতে দুবের সবচেয়ে বড় সম্বল এই আত্মবিশ্বাসটাই। চেন্নাইয়ে এসে তিনি যেভাবে তা পেয়েছেন, আর কোথাও পাননি। ঘটনাটা ২০২৩ আইপিএলে চেন্নাইয়ের দ্বিতীয় ম্যাচ পর। ওই মৌসুমের আগের আইপিএলে চেন্নাইয়ের ডেরায় পা রেখেছিলেন তিনি। এরপরই হলদে জার্সিতে অন্য এক দুবের দেখা পেল ভারত। স্পিনের যম রুপেই দেখা দিলেন তিনি! স্পিনে এতটাই ভয়ঙ্কর, ২০২৪ আইপিএলে এসে তো প্রতিপক্ষ অধিনায়ক তার সামনে স্পিনটা আড়াল করেই রাখতে চান। তাইতো চলতি আইপিএলে যা বল খেলেছেন দুবে, তার মধ্যে বিশ ভাগেরও কম ছিল স্পিনারদের। অথচ স্পিনে যে এত ভয়ানক তিনি, বেঙ্গালুরু কিংবা রাজস্থানের দুবেতে তার কোনও হদিস মেলেনি।

    ২০১৮ সালে মুম্বাই টি-টোয়েন্টি লিগে একসময় রাজস্থানের হয়ে খেলা প্রভিন তাম্বেকে এক ওভারেই পাঁচটা ছক্কা মেরে দিয়েছিলেন দুবে। সে বছর রঞ্জি ট্রফিতেও স্বপ্নীল সিংকে ওভারে পাঁচ ছক্কা হাঁকিয়ে শিরোনামের কারণ হয়ে উঠেন তিনি। এরপর ২০১৯ আইপিএলের নিলামে আনকোরা একজনকে নিয়েই দর কষাকষি চলে অবিরাম। শেষমেশ ৫ কোটি রুপিতে দুবেকে কিনে নেয় বেঙ্গালুরু। কিন্তু বেঙ্গালুরু্তে এরপর যে দুই মৌসুম কাটিয়েছেন- তাতে স্পিন কিংবা পেস, কিছুতেই কিছু করতে পারেননি। স্পিনারদের ৫৫ বল খেলে ৬২ রান আনতেই নিজের উইকেট খুইয়েছিলেন পাঁচবার। বেঙ্গালুরুর হয়ে স্পিনের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১১২ স্ট্রাইক রেটে, রাজস্থানের জার্সিতেও তার স্ট্রাইক রেট যায়নি ১৩৩ এর উপরে। সেই দুবেই চেন্নাইয়ের হয়ে ২০২২ ও ২০২৩ মৌসুমে স্পিনের বিপক্ষে খেললেন ১৫৯ স্ট্রাইক রেটে। স্পিনারদের সামনে তার গড় ছিল ৬২।

    চেন্নাইয়ে এসে যে রুপে দুবেকে দেখা গেল, সেটি তাহলে অন্য দুই ফ্র্যাঞ্চাইজি কেন বের করতে পারল না? চেন্নাইয়ে পাওয়া আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনতা, ভূমিকা নিয়ে স্বচ্ছতা- সেসব তো কাজে লেগেছে অবশ্যই। সেই সাথে চেন্নাই বাকি দুই ফ্র্যাঞ্চাইজির তুলনায় তাকে ব্যবহারও করেছে ভিন্নভাবে, সেটিরও প্রভাব যথেষ্ট।  

    শেষের দিকে এসে ঝড় তুলবেন, ফিনিশিংয়ের দায়িত্ব সামলানোটা কঠিন কাজের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু প্রথমবারের মতো আইপিএলের মঞ্চে পা রাখা দুবেকে সেই ভূমিকায়ই দেখেছিল বেঙ্গালুরু। ২০১৯ ও ২০২০ সাল, কোহলির দলে কাটানো দুই মৌসুমে তাকে বেঙ্গালুরু প্রায় ৭০ শতাংশ ম্যাচেই পাঠায় ইনিংসের দ্বিতীয় অর্ধে। ঘুরেফিরে পজিশন ৫, ৬ ও ৭ হলেও বেশিরভাগ ইনিংসেই তাকে ব্যাটিং শুরু করতে হয়েছে দশ ওভারের পর। আর ১৩ ইনিংসের মধ্যে যে ৪ ইনিংসে তিনি নেমেছেন দশ ওভারের আগে, তাতেও ছয়-সাতের আগে পজিশন উঠে এসেছিল মাত্র এক ম্যাচেই। অর্থাৎ বেঙ্গালুরু তাকে দেখেছে লেট-মিডল অর্ডারের পাওয়ার হিটার হিসেবেই।

    রাজস্থান আবার তাকে সম্পুর্ণ ভিন্ন ভূমিকায় দেখেছে। ২০২১ আইপিএলে যে নয় ইনিংসে ব্যাট করেছেন দুবে, তার মধ্যে ৮ ইনিংসেই তাকে নামিয়েছে আট ওভারের আগে। চারেই বেশিরভাগ ম্যাচে খেলেছেন তিনি। ওই মৌসুমে রাজস্থান বেশ কয়েক ম্যাচে দ্রুত উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল, সেজন্য তাকে পাওয়ারপ্লেতেই ব্যাট করতে হয়েছে ছয়টি ইনিংসে। রাজস্থান যেখানে তাকে পাওয়ারপ্লেতে পাঠাতেও দ্বিধাবোধ করেনি, চেন্নাই করেছে তার উল্টো। 

    পাওয়ারপ্লের পরই দুবের ব্যাট হাতে অন্তর্ভুক্তি ঘটবে, চেন্নাই তা নির্দিষ্ট করেই দিয়েছিল। এতে ব্যাটিং অর্ডারে তারা এদিক-সেদিক করতেও কোনও আপত্তি দেখায়নি। মহেন্দ্র সিং ধোনি আগেই বলে রেখেছিলেন, ‘তুই প্রস্তুত থাকিস, পাওয়ারপ্লের পরেই যাবি।’ দুবের সামর্থ্য তো ফুটে উঠেছিল ২০২২ ও ২০২৩ আইপিএলেই। তো ওই দুই মৌসুমে ২৫ ইনিংসে ব্যাট করেছেন এই বাঁহাতি, তার মধ্যে মাত্র তিন ম্যাচেই তাকে চেন্নাই নামিয়েছিল পাওয়ারপ্লেতে। সেটিও পাওয়ারপ্লেতেই দুটি ম্যাচে চার ও পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ায়। এর বাইরে তার পজিশনে তিন থেকে সাত পর্যন্ত গিয়েছে, কিন্তু চেন্নাই পাওয়ারপ্লের পরই স্পিন মোকাবিলায় যত দ্রুত সম্ভব ক্রিজে পাঠিয়ে দিয়েছে দুবেকে। 

    ৭২ শতাংশ ইনিংসই তার শুরু হয়েছে পাওয়ারপ্লের পর থেকে ১৩ ওভার পূর্ণ হওয়ার আগেই। আর ইনিংস শুরু হওয়ার সময় পাওয়ারপ্লে থেকে ১৫তম ওভার পর্যন্ত ধরলে, ২৫ ইনিংসের ২১টিই শুরু হয়েছিল তখন। শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র এক ম্যাচে ব্যাট করতে হয়েছে তাকে, সেটিতেও পজিশন ছিল না পাঁচের নিচে। অর্থাৎ মাঝের ওভারে স্পিনে আক্রমণ চালানোর যে দায়িত্ব দিয়েছিল চেন্নাই, তার জন্য সঠিক সময় দেওয়ায় নিশ্চিত করেছিল তারা। আর ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে আক্রমণাত্মক খেলার অবাধ স্বাধীনতা তো দেওয়া ছিলই! 

    রাজস্থানও তাকে উপরে খেলার যোগ্য ভেবেছে, তবে রাজস্থান অধিকাংশ ইনিংসেই দ্রুত উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল। সেকারণে দুবেকে শুরু থেকেই চাপে পড়ে কিছুটা খোলসে থেকে স্বভাববিরুদ্ধ খেলতে হয়েছে। রাজস্থানে সেভাবে পারফরম্যান্স হয়নি, তবে দুবের কাছে মনে হয় সেখানে তিনি ওই আত্মবিশ্বাসটা পেয়েছেন যে উপরেও তিনি খেলতে পারেন। আর তার সামর্থ্য আরও ডাল-পালা মেলেছে চেন্নাই তাকে সঠিক সময়, সঠিক ভূমিকায় ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছে বলে। সুপার কিংসের জার্সিতে ওই দুই মৌসুম মিলিয়ে ১৫৭ স্ট্রাইক রেট ও ৩৫ গড়ে করেন ৭০৭ রান।

    স্পিনের সামনে ত্রাসরুপে তো আবির্ভাবই হয়েছিল তার। দুবেকে তাহলে কীভাবে থামানো যায়? উত্তরে পেসের আনাগোনাই বেশি হতো। পেসারদের বিপক্ষে ওই দুই মৌসুমে ১৫৭ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করলেও তার গড় যে ছিল ২৬। তবে মূল ব্যাপার, শর্ট বলে অস্বস্তি ধরা পড়েছিল তার ব্যাটিংয়ে। ২০২৪ আইপিএলে যখন ব্যাট হাতে নামলেন দুবে, তখন তার স্পিনের সর্দারির কথা সকলেই জানে। কিন্তু নতুন দুই বাউন্সারের নিয়মটা দুবের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিবে কিনা, সেই প্রশ্নই তখন তাকে ঘিরে। 

    গুজরাটের বিপক্ষে এরপর প্রথম ম্যাচে যখনই ইনিংস শুরু করতে গেলেন, ক্যামেরন গ্রিন তাকে স্বাগত জানালেন বাউন্সার দিয়েই। গ্রিনের পর মোহাম্মদ সিরাজ ও আলজারি জোসেফ- সবমিলিয়ে দুবের সামনে পেসাররা যে ২৫ বল করলেন, তার ১৮টিই পড়ল শর্ট লেংথে। অতিরিক্ত বাউন্সের কারণে আরও তিনটা হল ওয়াইড। কিন্তু দুবে এমনই ব্যাট করলেন, ওই এক ম্যাচেই সব প্রশ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। শর্ট বলে দারুণ নিয়ন্ত্রণে খেলতে থাকলেন। বেশ নিপুণভাবে ফাইন লেগ ও স্কোয়ার লেগের ফাঁকে চার বের করলেন কয়েকটা।

    ২৮ বলে ৩৪ রানের ইনিংসে সব রানই এসেছিল ওই একের পর এক শর্ট বল করে যাওয়া পেসারদের বিপক্ষেই। ইনিংসটা আহামরি মনে হয় না স্কোরকার্ডে। তবে শর্ট বলের পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ ওই ম্যাচেই দেখে ফেলেছিল প্রতিপক্ষ দলগুলো। এরপর এভাবে আর কোন দলকেই একচেটিয়া শর্ট লেংথের কৌশলে যেতে দেখা যায়নি। 

    এই সাফল্যটা যে এমনি এমনি আসেনি, তা তো বলে দিতে হয় না। ২০২২ সালের আইপিএল শেষ হওয়ার পরই তাকে চেন্নাই ম্যানেজমেন্ট বলে দিয়েছিল, বাউন্সার তথা শর্ট বলে কাজ করতে হবে। ওই আসরে চেন্নাইয়ের খেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল যেদিন, তার পরদিনই দুবে নেমে পড়েছিলেন অনুশীলনে। ভাবতে পারেন? দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা একটি মৌসুম শেষ করেই কেবল ফিরলেন। এসে কোন আরাম-আয়েশে মন নেই, শুরু কাজ। সাইডআর্ম, মেশিন, বোলার। প্রতিদিন ১০০-১৫০ শর্ট বল। নির্দিষ্ট করে তার শর্ট বল মোকাবেলার প্রস্তুতি চলে মাস তিন-চারেক ধরে। 

    ২০২৩, এরপর ২০২৪ সালে এসে সেসব পরিশ্রমের ফলই তো ফুটে উঠল তার ব্যাটে। এবার যখন প্রতিপক্ষ অধিনায়কেরা স্পিন তার থেকে দূরে রাখা শুরু করলেন, তখন দুবে তার পেসের বিরুদ্ধে উন্নত খেলাও দেখিয়ে দিলেন। যথেষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলা দুবে তাই দরজা ভেঙেই ঢুকে গেলেন ভারতের বিশ্বকাপ দলে। সময় আসবে, তোমার কাজ তুমি চালিয়ে যাও- মহেন্দ্র সিং ধোনি তাকে বলতেন ভারত স্বপ্নের ব্যাপারে। সেই সময় আগেও এসেছিল, তবে এবার তো বিশ্বকাপের মতো বড়মঞ্চে। সে যাত্রায় চেন্নাইয়ের দেওয়া ‘সঠিক সময়ে সঠিক ভূমিকা’র অবদানও যথেষ্টই।