ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ১
রঙে-বৈচিত্রে-উৎসবে আর দর্শকপ্রিয়তায় আন্তর্জাতিক ফুটবলীয় টুর্নামেন্টগুলোর মধ্যে বিশ্বকাপ অতুলনীয়। তবে বিশ্বকাপের ঠিক পরেই অবস্থান করে নেওয়ার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে থাকবে ইউরো। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ের মতো দলের অংশগ্রহণ নেই সত্যি, পেলে-ম্যারাডোনা-মেসিরাও খেলেননি, তবুও ইউরোর ইতিহাস যথেষ্ট বর্ণিল।
চলতি বছরের ১৪ জুন, জার্মানির মাটিতে শুরু হতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর। এই টুর্নামেন্ট শুরু আগে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের প্রথম পর্বে থাকছে ১৯৬০ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর প্রথম আসর আর সোভিয়েত ইউনিয়নের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।
Image Source: Getty Images
কেমন ছিল সেই ইউরো?
ইউরোর প্রথম আসরের সাথে বর্তমানের ইউরোর ফরম্যাটের রয়েছে বিস্তর ফারাক। বর্তমান ইউরোর দিকে তাকালে সেই ইউরোকে প্রায় চেনাই যায় না।
সেই সময়ে উয়েফার সদস্যসংখ্যা ছিল তেত্রিশ। এই তেত্রিশটা দেশের মধ্যে ষোলটা দেশই ইউরোর প্রথম আসরে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৫৭ সালে উয়েফার ভোটাভুটিতে পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলো অবস্থান নেয় ইউরোর বিপক্ষে। বাকি সতেরোটা দেশ রাজি হয় টুর্নামেন্টে অংশ নিতে, তাদের নিয়েই শুরু হয় টুর্নামেন্ট।
এই টুর্নামেন্টটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল নকআউট পদ্ধতিতে। প্রথম তিন রাউন্ড, অর্থাৎ প্রাথমিক রাউন্ড বা বাছাইপর্ব, রাউন্ড অব সিক্সটিন এবং কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল দুই লেগের। উভয় দলই নিজেদের এবং প্রতিপক্ষের মাটিতে একবার করে মুখোমুখি হতো। এরপর সেমিফাইনাল, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ও ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক লেগেই, ফ্রান্সের মাটিতে।
প্রাথমিক রাউন্ড, বা বাছাইপর্বে ‘বাই’ পেয়ে সরাসরি রাউন্ড অব সিক্সটিনে চলে গিয়েছিল আসরের পনেরোটি দল। ষোলতম জায়গাটার জন্য লড়তে হয়েছিল আয়ারল্যান্ড এবং চেকোস্লোভাকিয়াকে, যেখানে দুই লেগ মিলিয়ে আয়ারল্যান্ডকে ৪-২ ব্যবধানে পরাজিত করে সেরা ষোলোতে নিজেদের নাম লেখায় চেকোস্লোভাকিয়া। এরপর রাউন্ড অব সিক্সটিন এবং কোয়ার্টার ফাইনাল পেরিয়ে সেমিফাইনালের টিকেট নিশ্চিত করে চারটি দল: যুগোস্লাভিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ফ্রান্স। লক্ষ্যণীয়, চারটি দেশের মধ্যে কেবল স্বাগতিক ফ্রান্সই ছিল পশ্চিম ইউরোপের দেশ, এবং কেবল ফ্রান্সই এখনো ‘ফ্রান্স’ রূপে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছে।
ফাইনালে যুগোস্লাভিয়াকে পরাজিত করা সোভিয়েত ইউনিয়নের ওই দলের তিনজন খেলোয়াড় ছিলেন বর্তমান জর্জিয়ার, এর বাইরে প্রায় সবাই ছিলেন মূলত মস্কো বা এর আশেপাশের অঞ্চলের অধিবাসী। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে ফুটবলে স্বর্ণপদক জেতা দলটি ইউরোতেও এসেছিল ফেভারিট হিসেবেই। দলটির খেলোয়াড়রাও তখন ইউরোপ মাতাচ্ছেন, গোলরক্ষককে তো চেনেন প্রায় সবাই। লেভ ইয়াশিন।
ম্যানেজার
বর্তমান সময়ে ম্যানেজাররা পাদপ্রদীপের আলোতে যতটা আসেন, গত শতাব্দীতে ততটা আসতেন না। তবে মাঠের খেলার ধরন আর কৌশলে তাঁরা পিছিয়ে থাকতেন না, বরং মস্তিষ্কের লড়াই লড়তেন দারুণভাবে। মস্কোতে জন্মগ্রহণ করা সোভিয়েত ইউনিয়নের কোচ গাভ্রিল কাশালিন যেমন বল পায়ে রেখে খেলাকে প্রাধান্য দিতেন, পাশাপাশি অফ দ্য বল মুভমেন্টও বেশ গুরুত্ব পেত তাঁর কাছে। রক্ষণ আর আক্রমণ যে যথাক্রমে শুধুই ডিফেন্ডার আর ফরোয়ার্ডদের কাজ, এই তত্ত্বে একেবারেই বিশ্বাস ছিল না তাঁর, বরং খেলার সকল পরিস্থিতিতেই সকল খেলোয়াড়কে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাতেন তিনি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কোচ গ্যাভ্রিল কাশালিন; Image Source: Dutch National Archives
আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য নিজেদের মাঝে জুটি বেঁধে খেলাকে বেশ গুরুত্ব দিতেন কাশালিন। এজন্য সাধারণত ক্লাব পর্যায়ে জুটি বেঁধে খেলা ফরোয়ার্ডদের প্রতি সুনজর থাকতো তাঁর, দুজনের একজন চোটে পড়লে অপরজনকেও বেঞ্চে রাখতেন কাশালিন। খেলোয়াড়দের নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়ার প্রতি গুরুত্ব দিতেন কাশালিন।
ক্লাব পর্যায়েও বেশ সফল ছিলেন কাশালি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্লাব দিনামো তিবিলিসির হয়ে সাফল্য থাকলেও মূলত জাতীয় দলের হয়ে প্রাপ্ত সাফল্যই তাঁকে বাড়তি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ইউরো ১৯৬০ এর আগে অলিম্পিক জয়, এছাড়াও ‘৫৮-’৬২-’৭০-এ তিনটা বিশ্বকাপে দলকে কোচিং করানোর অর্জনও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
ট্যাকটিক্স
সোভিয়েত ইউনিয়ন দলটা খেলতো ক্লাসিক ‘ডব্লিউ-এম’ ফরমেশনে, আধুনিক ফুটবলে যাকে ৩-২-২-৩ বলা যেতে পারে। একই সাথে দলটার খেলার সাথে মিল রয়েছে পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির পজেশনভিত্তিক ফুটবলের সাথে।
“আমাদের দলের খেলার ধরনটা গড়ে উঠেছে আমাদের নিজেদের মতো করেই,” পরবর্তীতে কাশালিন বলেছিলেন, “ওই দলের খেলাটা গড়ে উঠতো রক্ষণ থেকে, এরপর আক্রমণটা হতো ওয়াইড ফরোয়ার্ড লাইন ধরে, দুই উইং দিয়ে।”
সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন ফরমেশন; Image Source: The Athletic
তবে দুই উইং ধরে আক্রমণ হলেও বিপজ্জনক রূপটা বেশি দেখা যেত ডান পাশ থেকে। রাইট উইঙ্গার স্লাভা মেত্রেভেলি ছিলেন দ্রুতগতিতে দৌড়াতে সক্ষম, ইনসাইড-রাইটে খেলা ভ্যালেন্টিন ইভানোভের সাথে তাঁর সমন্বয়টা ছিল দারুণ।
তবে ফাইনালে দলের কৌশল বদলে ফেলেছিলেন কাশালিন। ডব্লিউ-এম বা ৩-২-২-৩ এর কৌশলে একটু বদল আসে, অধিনায়ক ইগর নেত্তো তাঁর স্বাভাবিক হোল্ডিং মিডফিল্ডারের জায়গা ছেড়ে খেলতে থাকেন বেশ নিচে, বর্তমান যুগের সাপেক্ষে বলা যায়, প্রায় সেন্টারব্যাক রূপে। অর্থাৎ সোভিয়েতরা এক প্রকার ‘ব্যাক ফোর’ নিয়েই খেলতে থাকে, ওয়াইড ডিফেন্ডাররা তাতে ওপরে ওঠার স্বাধীনতা পান। ওদিকে টেকনিক্যালি বেশ ভালো হওয়ায়, জীবনের শুরুতে ডিফেন্ডার থেকে পরবর্তীতে মিডফিল্ডারে রূপান্তরিত হওয়া নেত্তোর জন্য আবার সেন্টারব্যাকে পরিণত হওয়াটা কঠিন ছিল না। তবে ফাইনালের দ্বিতীয়ার্ধে অনেকটা মিডফিল্ডার হিসেবেই খেলেছিলেন তিনি।
এই রূপান্তরিত ৪-২-৪ ফরমেশনের অন্যতম রূপকার ছিলেন কাশালিন। এই পথ ধরেই, এই ৪-২-৪ ফরমেশনে খেলে দুই বছর পরে অনুষ্ঠিত চিলি বিশ্বকাপে শিরোপা জিতেছিল ব্রাজিল।
মূল খেলোয়াড়
সহজ উত্তর। লেভ ইয়াশিন। সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক।
ট্রেনিংয়ে লেভ ইয়াশিন; Image Source: Getty Images
সময়ের অন্যান্য গোলরক্ষকদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন লেভ ইয়াশিন, আর সেটার ছাপ ছিল তাঁর গোললাইন ছেড়ে অনেকটা সামনে এসে খেলার ক্ষেত্রেও। প্রথম সোভিয়েত খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি’অরের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম এসেছিল তাঁর, শেষ পর্যন্ত পঞ্চম হয়েছিলেন তিনি। তবে এর তিন বছর পর তিনি ঠিকই ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন, এখন পর্যন্ত ইতিহাসের একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে এই কৃতিত্ব তাঁর। তাঁর নামের অনুসারেই এখন গোলরক্ষকদের জন্য ব্যালন ডি’অরের মঞ্চে ‘ইয়াশিন ট্রফি’ দেওয়া হয়।
কিন্তু এই সহজ উত্তরটাই কি সঠিক উত্তর?
সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল, এই দুই ম্যাচের ছোট্ট ‘স্যাম্পল সাইজ’ থেকে ইয়াশিনকে সেরা বলে রায় দেওয়াটা একটু কঠিন। ইয়াশিন নিজেও নিজের সেরা ফর্মে ছিলেন না। ফাইনালে কিছু দুর্দান্ত সেভ দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু কাছের পোস্টে প্রথম গোল হজমের ক্ষেত্রে তাঁর কিঞ্চিৎ দায় দেখেন অনেকে। ওই ম্যাচের শেষ দিকে ভাগ্যের কিছুটা সাহায্যও পেয়েছিলেন তিনি। তবে অন্যান্য গোলরক্ষকদের ভুলও ছিল, সেই ব্যাপারটাও এগিয়ে দিয়েছে ইয়াশিনকে। পাশাপাশি ইয়াশিনের বল ডিস্ট্রিবিউশনও ছিল দারুণ। তাঁর ওভারআর্ম থ্রোগুলোর সাথে গোলরক্ষকদের নয়, তুলনা করা যেতে পারে শটপুট থ্রোয়ারদের।
তবে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার লড়াইয়ে ইয়াশিনের সাথে টক্কর দিতে পারেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ইভানোভ। মার্সেইয়ে অনুষ্ঠিত সেমিফাইনালে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে জোড়া গোল করে সোভিয়েতদের ৩-০ ব্যবধানের বড় জয়ে অবদান রেখেছিলেন এই লেফট-ফুটেড মিডফিল্ডার, এ যুগের মার্টিন ওডেগার্ডের সাথে যাকে তুলনা করা যেতে পারে। বিশেষত দ্বিতীয় গোলটা ছিল দুর্দান্ত, দারুণ ড্রিবলিংয়ের পর গোলরক্ষককে পরাস্ত করে বলটা জালে জড়ান তিনি। ফাইনালের ম্যাচজয়ী গোলের অ্যাসিস্টও করেন তিনি।
(বাঁ থেকে) নেত্তো, মেত্রেভেলি এবং ইয়াশিন; Image Source: Getty Images
বড় টুর্নামেন্টগুলোতে ইভানোভের রেকর্ড ছিল ঈর্ষণীয়। ১৯৬০ ইউরো আর ১৯৬২ বিশ্বকাপে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোল সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ অলিম্পিকেও স্বর্ণপদক জিতেছিলেন তিনি। একই অলিম্পিকে জিমন্যাস্টিকসে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন তাঁর স্ত্রী লিদিয়াও। তাঁদের পুত্র ভ্যালেন্টিন পরবর্তীতে ফুটবল রেফারি হয়েছিলেন, ২০০৬ বিশ্বকাপের রাউন্ড অব সিক্সটিনে বিখ্যাত ‘ব্যাটল অব নুরেমবার্গ’ ম্যাচে রেফারিং করেছিলেন তিনি। পর্তুগাল ও নেদারল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে চারটা লাল কার্ড আর ষোলোটা হলুদ কার্ড দেখাতে বাধ্য হয়েছিলেন রেফারি।
ফাইনাল ম্যাচ
সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম যুগোস্লাভিয়া। শুধু মহাদেশীয় শ্রেষ্টত্বের ফাইনাল বলে নয়, ম্যাচটার গুরুত্ব ছিল রাজনৈতিকভাবেও।
বারো বছর আগে, পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সমাজতান্ত্রিক জোট ‘কমিনফর্ম’ থেকে বহিষ্কৃত হয় যুগোস্লাভিয়া, আর ওই জোটকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতো সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু, ওই জোটের সদর দপ্তর আবার অবস্থিত ছিল যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে। স্বাভাবিকভাবে দুই দেশের মধ্যে টেনশন বাড়তে থাকে।
ইউরোর ফাইনালটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ফ্রান্সের পার্ক দে প্রিন্সেসের ‘হাস্যকর’ রকমের কর্দমাক্ত মাঠে। অতিরিক্ত সময় শেষে ২-১ ব্যবধানে জয়লাভ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
ম্যাচের শুরুটা বেশ ভালোভাবেই করেছিল যুগোস্লাভিয়া। কিন্তু অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটের নিয়মের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল তাদের। তখনো এই অতিরিক্ত সময়ের ধারণাটা বেশ নতুন, আর দলের অনেক খেলোয়াড়ও প্রথমবারের মতো খেলছিলেন এই বাড়তি ত্রিশ মিনিট। আর তখনকার ফুটবলে সাবস্টিটিউশনের নিয়ম ছিল না, তাই স্বাভাবিকভাবেই খেলার গতি কমতে থাকে সময়ের সাথে সাথে।
তবে ম্যাচে যুগোস্লাভিয়ানরা কম সুযোগ পেয়েছিল, এমন কথা বলার সুযোগ নেই। বিশেষ করে নির্ধারিত সময়ের প্রথমার্ধে, তাদের একমাত্র গোলটাও এসেছিল এই সময়েই। তবে বিরতির পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের খেলা বদল যায়। মাঝমাঠে আরো বেশি প্রভাব রাখতে শুরু করেন নেত্তো, ওদিকে সোভিয়েতের খেলায় উন্নতি হতে থাকে। এক্ষেত্রে একটা কিংবদন্তিও শোনা যায়, বিরতির সময়ে বুটের সমতল তলায় নাকি ‘স্টাড’ লাগিয়ে নিয়েছিলেন সোভিয়েতরা, কর্দমাক্ত মাঠেও দ্বিতীয়ার্ধে বেশ পারফর্ম করতে সক্ষম হন তাঁরা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গোল শোধ করে ফেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাইট উইঙ্গার মেত্রেভেলির আপাত নিরীহদর্শন লং রেঞ্জ শটটা ঠেকাতে ব্যর্থ হন যুগোস্লাভিয়ার দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক ব্লাগোজে ভিদিনিচ। নিয়মিত গোলরক্ষক মিলুতিন সসকিচের শেষ মুহূর্তের ইনজুরির কারণে একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন ভিদিনিচ, কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেননি তিনি।
তবে বেশ বাজে মাঠেও সব মিলিয়ে দুই দলের পারফরম্যান্স বেশ ভালো ছিল। কর্দমাক্ত মাঠের কারণে ক্রসগুলোর ওপরে বেশি নির্ভরশীলতা ছিল দুই দলের। একই কারণে প্রচুর লং রেঞ্জ শটও নিতে দেখা গিয়েছিল দুই দলকে। তবে এর মাঝেও, দুই দলের দুই মূল প্লেমেকার, সোভিয়েতের ইভানোভ আর যুগোস্লাভিয়ার দ্রাগোস্লাভ সেকুলারাচের পারফরম্যান্স ছিল নজরকাড়া। দারুণ সব পাস আর কৌশলে বাকিদের চেয়ে একটু এগিয়ে ছিলেন তাঁরা।
ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত
ফাইনালে দুই দলের মধ্যে ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল অতিরিক্ত সময়ের একটি মুহূর্ত, যেখানে একটি ‘প্রথাগত সেন্টার ফরোয়ার্ডের গোল’ই শিরোপাটা লিখে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নামে। বাম পাশ থেকে ইভানোভের উঁচু ক্রসে মাথা লাগিয়ে বলটা জালে জড়িয়ে দিয়েছিলেন স্ট্রাইকার ভিক্টর পোনেডেলনিক। ১১৩ মিনিটের ওই গোলটা এখনো ইউরোর ফাইনালের ইতিহাসে সবচেয়ে দেরিতে হওয়া গোল, আর তাতেই নিশ্চিত হয়ে যায়, প্রথম শিরোপাটা যাবে সোভিয়েতের ঘরে।
ভিক্টর পোনেডেলনিক; Image Source: AFP
“ফাইনাল ম্যাচটা শুরু হয়েছিল রবিবারে, মস্কোর সময় অনুসারে তখন রাত দশটা। ম্যাচটা যখন অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়, ততক্ষণে মধ্যরাত পেরিয়ে মস্কোতে সোমবার হয়ে গেছে,” পোনেডেলনিক বললেন, যাঁর ডাকনাম “মানডে”, “এরপর যা ঘটলো, তাতে সাংবাদিকদের শিরোনাম লিখতে খুব সুবিধাই হয়েছে!”
খেলোয়াড়ি জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরে একজন বিখ্যাত সাংবাদিক হয়েছিলেন পোনেডেলনিক। ইউরোর শিরোপার হাতে তাঁর একটা ব্রোঞ্জ মূর্তিও তৈরি করা হয়েছিল, সেটা স্থাপন করা হয়েছিল তাঁর হোম স্টেডিয়াম রোস্তোভ-ইন-ডনের বাইরে।
জেনে অবাক হবেন যে…
এখানে আরো একটা গল্প না বললেই নয়। আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং স্পেন। স্বাভাবিকভাবে দুই দল হোম এবং অ্যাওয়েতে মুখোমুখি হবে এবং অ্যাগ্রিগেটে এগিয়ে থাকা দলটিই সেমিফাইনালে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্প্যানিশ শাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মনে তখন তখন অন্য ভয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পেনের মাটিতে এসে স্পেনকে হারিয়ে দিতে পারে, এই ভয়টা গ্রাস করে নেয় তাঁকে। এর আগে, ১৯৬০ সালের মে মাসে, প্রীতি ম্যাচে পোল্যান্ডকে ৭-১ উড়িয়ে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, সেখান থেকেই ফ্রাঙ্কোর ভয়ের জন্ম। স্পেনের মাটিতে সোভিয়েতদের পতাকা উড়বে, জাতীয় সঙ্গীত বাজবে, এরপর স্পেনকেই বড় ব্যবধানে পরাজিত করবে তারা, এমনটা তো হতে পারে না।
কিন্তু স্পেন দলটা তখন একেবারে দুর্বল নয়। মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টকে ৭-৩ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, আর সেই রিয়াল মাদ্রিদ দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই রয়েছেন স্প্যানিশ দলটিতে। তবুও জেনারেল ফ্রাঙ্কো তাঁর অবস্থানে অনড় থাকেন, আর তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ম্যাচে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে স্পেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কি সত্যিই ইউরোপের সেরা দল ছিল?
এই বিচার করাটা এত সহজ নয়। আলফ্রেডো ডি স্টেফানো আর লুইস সুয়ারেজের স্পেন দলটাও বেশ ভালো ছিল। এর পাশাপাশি ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডের মতো দলগুলোও টুর্নামেন্টে অংশ নিতে আপত্তি জানায়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাই অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থাই অতিক্রম করতে হয়েছে, পেরোতে হয়েছে পূর্ব এবং উত্তর ইউরোপের দলগুলোর পাশাপাশি ফ্রান্স, নরওয়ে আর ডেনমার্কের মতো গুটিকয়েক পরাশক্তি দলকে।
চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেমিফাইনাল ম্যাচের একটি মুহূর্ত: Image Source: Getty Images
তবে হ্যাঁ, সোভিয়েত ইউনিয়নকে সহজ পথ পেরোতে হয়েছে সত্যি, কিন্তু দল হিসেবেও তারা বেশ ভালো ছিল। আক্রমণাত্মক ফুটবল, চমৎকার ট্যাকটিকস আর দারুণ ফিজিক্যালিটির ফলাফলই ছিল তাদের শিরোপা জয়। এবং এই শিরোপা জয়ের প্রভাবটা এমনই, ফাইনালের পরই রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যু চেয়েছিলেন এই দলের পাঁচজনের সাথে দেখা করতে এবং নিজের দলে ভেড়াতে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন গোলরক্ষক লেভ ইয়াশিন, অধিনায়ক নেত্তো, প্লেমেকার ইভানোভ, রাইট উইঙ্গার মেত্রেভেলি, এবং শিরোপা নির্ধারণী গোল করা পোনেডেলনিক।
মাত্রই পঞ্চম ইউরোপিয়ান কাপ জিতে ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে নিজেদের অমরত্ব নিশ্চিত করা রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফাইনালের পরপরই যে দলটার পাঁচজন খেলোয়াড়কে নিজের দলে ভেড়ানোর তোড়জোড় করেন, সেই দলটাকে বিশেষ না বলে আর উপায় আছে!