টি-টোয়েন্টি যেভাবে বদলে দিয়েছে মাঠের ক্রিকেটকে: শেষ পর্ব
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নবীন ও সংক্ষিপ্ততম বিশ ওভারের এই ফরম্যাটটা কীভাবে বদলে দিলো আমাদের একসময়ের চেনাজানা মাঠের ক্রিকেটকে, দ্যা ক্রিকেট মান্থলিতে উঠে এসেছে সেই গল্পগুলোই। আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
ম্যাক্সওয়েল-ওয়ার্নার, টি-টোয়েন্টির দুই বিজ্ঞাপন; Image Source: Getty Images
দুর্দান্ত ক্যাচিং, চনমনে ফিল্ডিং
গত শতাব্দীর ক্রিকেট ম্যাচগুলোর হাইলাইটসে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। ফিল্ডিংয়ের ব্যাপারে খুব কম দলই সচেতন ছিল সে সময়ে। ক্যাচ মিস, আউটফিল্ডে ‘হাস্যকর’ ফিল্ডিংয়ের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি, পক্ষান্তরে বাউন্ডারি বাঁচানোর জন্য কোন ফিল্ডারকে ডাইভ দিতে প্রায় দেখাই যেত না।
সময়ের সাথে সাথে খেলাটায় পেশাদারিত্ব বেড়েছে, টি-টোয়েন্টি তাতে দিয়েছে নতুন মাত্রা। “টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা দলগুলোর ফিল্ডিংয়ের প্রতি মনোভাবে বেশ পরিবর্তন এনে দিয়েছে,” পল কলিংউড বলেন।
রিলে ক্যাচের দেখা মেলে নিয়মিতই; Image Source: Getty Images
রিলে ক্যাচের ব্যাপারটা ক্রিকেটে এখন খুবই ‘কমন’ একটা ব্যাপার, দলগুলো ট্রেনিংয়েও এর অনুশীলন করে ইদানীং। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ফিল্ডারদেরকে এখন মাঠে ‘লুকিয়ে’ রাখার সুযোগ নেই বললেই চলে, প্রত্যেককেই সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হয় ফিল্ডিংয়ে। অতীতে পেসাররা অনেক ক্ষেত্রেই ফিল্ডিংয়ে নিজেদের পুরোটা দিয়ে চেষ্টা করতেন না, কিন্তু এখন রিস টপলি-মাইকেল নেসার-ট্রেন্ট বোল্টরা নিয়মিতই দুর্দান্ত সব ক্যাচ নেন আন্তর্জাতিক ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে।
উদ্ভাবনী কিপিং
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলোতে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল, বিশেষজ্ঞ উইকেটরক্ষকরা হয়তো বাড়তি কদর পাবেন এই ফরম্যাটে। ব্যাটিংয়ের চেয়ে হয়তো স্ট্যাম্পের পেছনে তাঁদের দস্তানার কাজেই বেশি গুরুত্ব দেবে টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু আদতে ঘটনা ঘটলো উল্টো, বিশেষজ্ঞ উইকেটরক্ষকদের তুলনায় ‘মূলত ব্যাটসম্যান, সাথে টুকটাক কিপিং করেন’ এমন উইকেটরক্ষকদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দলগুলো। যেন ব্যাটিংটা আগে ভালোমতো করে দাও বাছা, স্ট্যাম্পের পেছনে কোন মতে বল ঠেকাতে পারলেই চলবে!
তড়িৎগতিতে স্ট্যাম্পিং করতে অতুলনীয় ধোনি; Image Source: Getty Images
কিপিংয়ের ধরনেও এসেছে পরিবর্তন। ‘সফট হ্যান্ড কিপিং’ টেকনিকটা বদল হয়ে ‘স্ট্রং হ্যান্ড কিপিং’-এর প্রচলন ঘটেছে। মহেন্দ্র সিং ধোনির বিদ্যুৎগতির স্ট্যাম্পিং বা ‘নো লুক‘ রান আউট, অথবা পেসার ভুবনেশ্বর কুমারের বোলিংয়ে শিখর ধাওয়ানের বিপক্ষে হেনরিখ ক্লাসেনের স্ট্যাম্পের কাছে দাঁড়িয়ে কিপিং এবং পরবর্তীতে স্ট্যাম্পিং করার ঘটনা এর উদাহরণ।
ধাওয়ানকে স্ট্যাম্পড করলেন ক্লাসেন; Image Source: Getty Images
‘ম্যাচ আপ’ এখন সেকেলে ধারণা?
ম্যাচ আপের ধারণাটা ক্রিকেটে নতুন নয়। বর্তমান সময়ের মতো এই রূপে ম্যাচ আপের প্রয়োগ ছিল না আগে, তবে ‘ম্যাচ আপ’ ব্যাপারটা ছিল সবসময়েই। ১৯৩২-৩৩ অ্যাশেজে ডন ব্র্যাডম্যানের বিপক্ষে যে ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলিং পরিচালনা করেছিলেন ডগলাস জার্ডিন, সেটাও এক ধরনের ম্যাচ আপ। তবে ম্যাচ আপের প্রয়োগটা বেশি ঘটেছে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। ঠিক ব্যাটসম্যানের বিপরীতে ঠিক বোলারকে দিয়েই বোলিংটা করাতে চান অধিনায়কেরা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এই ব্যাপারটাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।
পরিসংখ্যান যেটা বলছে, সাধারণত ব্যাটসম্যানরা নিজেদের দিকে টার্ন করা বলগুলো ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারেন, টার্ন করে বেরিয়ে যাওয়া বলগুলোর তুলনায়। “আপনি যদি একজন ফিঙ্গার স্পিনার হন, বাঁহাতি স্পিনার বা ডানহাতি অফ স্পিনার, আপনাকে জানতে হবে কীভাবে বলটা ব্যাটসম্যানদের থেকে টার্ন করিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়া যায়। তবেই দলগুলো জেনুইন বোলার হিসেবে একাদশে জায়গা দেওয়ার জন্য আপনার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারবে,” দিনেশ কার্তিক বলেন।
Image Source: ESPN Cricinfo
২০১৮ থেকে ২০২০ সালের আইপিএলের পরিসংখ্যান যেমনটা বলছে, ডানহাতি ব্যাটসম্যানরা স্লো লেফট আর্ম বোলার ও লেগ স্পিনারদের বিরুদ্ধে একটু বেশি সংগ্রাম করেন। অপর দিকে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানরা অফব্রেক বোলারদের বিরুদ্ধে ততটা স্বচ্ছন্দ নন, যতটা স্বচ্ছন্দ থাকেন স্লো লেফট আর্ম বোলারদের বিরুদ্ধে।
উইকেটের কোন মূল্যই নেই!
“নিজের উইকেটের মূল্য বুঝতে চেষ্টা করুন।”
ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশ্যে ক্রিকেট বিশ্লেষকরা এমন কথা প্রায়শ বলে থাকেন। তবে আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সম্ভবত এই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের সাথে বিশ ওভারের ক্রিকেটের পার্থক্যটাও গড়ে দিচ্ছে এই ব্যাপারটা। ওয়ানডেতে গড়ে প্রতি তিনটা ওয়ানডে ইনিংসের মধ্যে একটা ক্ষেত্রে ব্যাটিং দল অলআউট হয়, টি-টোয়েন্টিতে হিসাবটা পাঁচ ইনিংসে একবার। অর্থাৎ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের সামনে আক্রমণাত্মক হওয়ার সুযোগটা বেশি থাকে, কম থাকে নিজের উইকেট হারানোর ভয়। নিজের উইকেট বাঁচানোর জন্য ব্যাটিং না করে ব্যাটসম্যানরা দলের রান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন, এ কারণে উইকেট পতনের হারটাও একটু বেশি থাকে। এ যুগের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলির দিকেই তাকানো যাক, আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে গড়ে প্রতি ৬৩ বলে একবার আউট হয়েছেন তিনি, আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রতি ৩৭ বলে।
Image Source: ESPN Cricinfo
ব্যাপারটা আবার একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাখ্যা করা যায়। ফর্মে না থাকা বা মাঠে ধুঁকতে থাকা ব্যাটসম্যান আউট না হলেই অনেক ক্ষেত্রে খুশি হন প্রতিপক্ষের বোলাররা। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ২১ বলে ১১ রানের এক ‘অদ্ভুতুড়ে’ ইনিংস খেলেন যুবরাজ সিং। তাঁর এই ইনিংসের কারণে পরে নেমে মহেন্দ্র সিং ধোনি মাত্র সাত বল খেলার সুযোগ পান, আর সুরেশ রায়না তো সুযোগই পাননি ব্যাটিংয়ের। শ্রীলঙ্কাও অনায়াসে পৌঁছে যায় ১৩১ রানের লক্ষ্যমাত্রায়, ১৩ বল হাতে রেখেই।
ব্যাটসম্যানরা নিজেদের উইকেটের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেন দ্রুত রান তোলায়; Image Source: Getty Images
এই ব্যাপারটারও সমাধান করা সম্ভব। ২০২২ আইপিএলের একটি ম্যাচে দলীয় ট্যাকটিকাল কারণে নিজেই ‘রিটায়ার্ড আউট’ হয়ে মাঠের বাইরে চলে যান রবিচন্দ্রন অশ্বিন। একটা নজিরও স্থাপন করেন তিনি, ট্যাকটিকাল কারণে পরবর্তী ব্যাটসম্যানকে নামানো যেতেই পারে।
মুদ্রার পিঠে ভাগ্য লেখা
“টসে জিতলে ব্যাটিং নিন। যদি এই ব্যাপারে সন্দেহ হয়, তাহলে চিন্তা করুন, এবং ব্যাটিং নিন। যদিও তাতেও সন্দেহ না কাটে, তাহলে সতীর্থদের সাথে পরামর্শ করুন, এবং ব্যাটিং নিন।”
ক্রিকেটের অমর বুড়ো ডব্লিউ জি গ্রেসের এই অমৃতবচনটা অবশ্য বর্তমানের ক্রিকেটের সাপেক্ষে খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়। ক্রিকেটের বিবর্তনের সাথে টসটা এখন আর কেবলই আগে ব্যাটিং করার ছুতো নয়, বরং টস এখন ভূমিকা রাখে ম্যাচ এবং টুর্নামেন্টের গতিপথে। ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার খেলানোর এই যুগে, আইপিএলে এখন দলগুলো একাদশ ঘোষণা করে টসের পরে। আগে ব্যাটিং করতে হবে নাকি বোলিং, সেই হিসেবে নির্ধারিত হয় একাদশ। বিগ ব্যাশে তো টস হিসেবে মুদ্রাই নিক্ষিপ্ত হয় না এখন, এর বদলে শূন্যে ছোঁড়া হয় একটা ব্যাট।
টস জিতলেই ম্যাচ জয়, ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আপ্তবাক্য; Image Source: Getty Images
টসের গুরুত্বও বেড়েছে এখন, বিশেষত ম্যাচের ফলাফলে। যেসব ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ফ্লাডলাইটের আলোতে, সেগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই দুই ইনিংসে পিচ ও কন্ডিশনের আচরণ থাকে দুই ধরনের। আর কন্ডিশন এবং টার্গেট জানা থাকে বিধায় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অনেক ক্ষেত্রেই চেজ করা দল বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্ব থেকে বাকি ৩৩ ম্যাচের মধ্যে পরে ব্যাট করা দলগুলো জিতেছিল ২২টা ম্যাচে। শিরোপাজয়ী অস্ট্রেলিয়া টুর্নামেন্টে তাদের সাত ম্যাচের মধ্যে ছয়টাতেই জিতেছিল টসে, আর তাদের জয়সংখ্যাও ছয়। একটা ম্যাচেই টস জিততে ব্যর্থ হয় অজিরা, দুবাইয়ের ওই ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে ওই ম্যাচে বাজেভাবে হেরেছিল তারা।
বিশ-বিশের প্রভাব
টি-টোয়েন্টির প্রভাবটা পড়েছে ক্রিকেটের অন্যান্য ফরম্যাটের ওপরও। টেস্ট ক্রিকেটের কথাই ধরা যাক। ২০০৩ সালে টেস্টে গড়ে প্রতি ওভারে রান উঠতো ৩.২০ হারে, প্রতি উইকেট পতনের আগে ৩৬.৩৩ রান তুলতে পারতেন ব্যাটসম্যানরা। বিশ বছর পরে, ২০২৩ সালে রান উঠেছে আরেকটু দ্রুতগতিতে, ওভারপ্রতি ৩.৫২ হারে। ওদিকে উইকেটপ্রতি রানের পরিমাণও কমেছে, প্রতি ৩২.৫০ রানে একটি উইকেট হারিয়েছে ব্যাটিং দল।
টেস্টের পর এবার ওয়ানডের দিকে তাকানো যাক। বিশ বছরের ব্যবধানে পাওয়ারপ্লে, ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন, বোলারদের স্বাধীনতা, পিচের অবস্থা, বাউন্ডারির আকার, এই সবগুলো ব্যাপারে পরিবর্তন এসেছে সত্যি, এর পাশাপাশি বড় একটা লাফ দিয়েছে ব্যাটিং দলের রানরেটও। ২০০৩ সালে ওভারপ্রতি ৪.৬৭ হারে রান উঠতো, ২০২৩ সালে সেটা ৫.৫৪।
টি-টোয়েন্টির প্রভাব পড়েছে টেস্টেও; Image Source: Getty Images
শুধু পরিসংখ্যানই নয়, টেস্ট খেলার ধরণেও এসেছে পরিবর্তন। হেডিংলিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩৫ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলার পথে বেন স্টোকসের একের পর এক রিভার্স সুইপ কিংবা বিশাখাপত্তনমে ওলি পোপ আর বেন ফোকসের উদ্দেশ্যে জসপ্রীত বুমরাহর ছোঁড়া দুর্দান্ত ইয়র্কার ও স্লোয়ারই প্রমাণ করে দেয়, ক্রিকেটের ‘শুদ্ধতম’ সংস্করণটাও প্রভাবিত হচ্ছে টি-টোয়েন্টির দ্বারা। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট যে খেলোয়াড়দের দক্ষতাকে নিয়ে যাচ্ছে পরবর্তী পর্যায়ে, ঝুলিতে যুক্ত করছে নতুন নতুন অস্ত্র, এরপর সেই অস্ত্রে নতুন বৈচিত্র্য যোগ করে বদলে দিচ্ছে অপর দুই সংস্করণকে, ব্যাপারটাকে সম্ভবত অস্বীকার করার সুযোগ নেই বিশুদ্ধতাবাদী ক্রিকেট দর্শকদেরও!