ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৩
ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বিশ্বকাপের প্রতিটা আসরের গল্পগুলো যতটা চর্চিত, মহাদেশীয় আসরগুলোর গল্পগুলো ততটা নয়। ইউরো-স্মৃতির প্রশ্নে মানসপটে ভেসে ওঠে কিছু ছকবাঁধা তথ্য, কিছু বহুল প্রচলিত ছবি। অথচ গল্প আর কাহিনীর ভাণ্ডারে ইউরো পিছিয়ে নেই কোন অংশেই, মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বকাপের মতো না হলেও। আর এই ভুলে যাওয়ার মিছিলের নেতৃত্বে যেন রয়েছে ইতালির প্রথমবারের মতো ইউরোপ-সেরা হওয়ার আসরটি।
ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর শুরুর আগে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের তৃতীয় পর্বে থাকছে ১৯৬৮ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর তৃতীয় আসর আর ইতালির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।
Image Source: Getty Images
কেমন ছিল সেই ইউরো?
ইংরেজ ইতিহাসবিদ জন ফুটের ‘ক্যালসিও’ নামের ৬০০ পৃষ্ঠার একটা বই রয়েছে, ইতালির ফুটবলের ইতিহাসের ওপর। ইতালীয় ফুটবলের ইতিহাসের ওপর ইংরেজি ভাষায় রচিত বইগুলোর মধ্যে কলেবরে সবচেয়ে বড় এই বইটি। সেই বইতেও ইতালির ১৯৬৮ ইউরো জয়ের কথা উঠে এসেছে মাত্র দুটো লাইনে, এবং সেই দুটো লাইনেও বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায় না। এই তথ্যটাই স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়, ইতালির প্রথম ইউরো জয়ের গল্পটা সাধারণ দর্শক-সমর্থকদের কাছে তো বটেই, ফুটবলবোদ্ধাদের কাছেও বেশ অবহেলিত।
কারণ খুঁজলে কয়েকটা ব্যাপার উঠে আসে, তুলনার স্বার্থে চলে আসে সর্বশেষ ইউরো অর্থাৎ ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত আসরের ব্যাপারটাও। দুটো ইউরো জয়ই এসেছিল বিশ্বকাপে ভয়াবহ ব্যর্থতার পরে। ১৯৬৮ ইউরোর দুই বছর আগে, ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং উত্তর কোরিয়ার কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ইতালি। অপরদিকে ২০২১ ইউরোর তিন বছর আগে অনুষ্ঠিত ২০১৮ বিশ্বকাপে তো দলটি উতরাতে পারেনি বাছাইপর্বের বাধাই। ইতালির দুটো দলই এরপর দারুণ একটা অপরাজিত-দৌড় উপভোগ করে। মজার ব্যাপার, দুটো প্রজন্মই নির্ধারিত সময়ে সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে জিততে ব্যর্থ হয়। ২০২১-এর ইতালি সেমিফাইনাল আর ফাইনালে টাইব্রেকারে পরাজিত করেছিল যথাক্রমে স্পেন ও ইংল্যান্ডকে। ১৯৬৮-এর গল্পটা আরেকটু অদ্ভুত, সেই ব্যাপারে একটু পরেই আসা যাক।
ম্যানেজার
ফেরুচ্চিও ভ্যালকারেগি। ইতালির কিংবদন্তি ম্যানেজারদের তালিকায় এই ভদ্রলোকের নাম পাওয়া যাবে না, কিন্তু তিনি ছিলেন একজন প্রথাগত ইতালীয় ম্যানেজার। একজন চেইন-স্মোকার, ফুটবল রোমান্টিকতার বদলে যাঁর মাথায় ঘুরতো একের পর এক ট্যাকটিক্স, আর ম্যাচ জয়ের চেয়ে না হারার প্রতিই যিনি বেশি নজর দিতেন।
ইতালীয় ক্লাব প্রাতোকে ইতালীয় ফুটবলের তৃতীয় স্তর সিরি’সি থেকে দ্বিতীয় স্তর সিরি’বিতে উন্নীত করার মাধ্যমে নিজের নামটা প্রথমবারের মতো জানান দেন ভ্যালকারেগি, পরবর্তীতে কোচিং করান আটালান্টা এবং ফিওরেন্টিনাতে। এরপর ১৯৬৬ বিশ্বকাপে মূল কোচ এডমন্ড ফ্যাব্রির সহকারী নিযুক্ত হন তিনি এবং হেলেনিও হেরেরা। বিশ্বকাপে ইতালির ভরাডুবির পর সরিয়ে দেওয়া হয় এডমন্ড ফ্যাব্রিকে, জুটি হিসেবে ভ্যালকারেগি-হেরেরা দুজনই হন ইতালি জাতীয় দলের কোচ। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সরে যান হেরেরা, এরপর ম্যানেজারের আসনে একাই বসেন ভ্যালকারেগি। তবে হেরেরার সাথে ফুটবলীয় দর্শনে মিল ছিল তাঁর, যদিও তিনি হেরেরার তুলনায় একটু বেশি রক্ষণাত্মক ছিলেন। এটা আরো ভালোভাবে বোঝা যায় সত্তরের দশকে। ফুটবলীয় বিবর্তনের পথ ধরে ব্রাজিল এবং নেদারল্যান্ডের মতো দলগুলো আক্রমণাত্মক খেলে বিশ্বের প্রশংসা কুড়োতে শুরু করে, কিন্তু ইতালি তখনও সন্তুষ্ট ছিল তাদের অটুট রক্ষণের ফুটবল নিয়ে। গোল করার চেয়ে গোল হজম না করাটাই অগ্রাধিকার পেত ভ্যালকারেগির কাছে।
ফেরুচ্চি ভ্যালকারেগি; Image Source: Getty Images
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে ভ্যালকারেগি তাঁর ‘স্তাফেতা’ ফুটবলের জন্য বেশ পরিচিতি পান, যেখানে তিনি তাঁর দুই বড় তারকা জিয়ান্নি রিভেরা এবং সান্দ্রো মাজোলাকে একসাথে না খেলিয়ে বরং একজনের পরিবর্তে অপরজনকে খেলাতে শুরু করেন। তখনও ফুটবলে খেলোয়াড় বদলের নিয়মটা একেবারেই নতুন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কেরও জন্ম দিচ্ছে, আর মূলত ব্যবহৃত হতো চোটগ্রস্ত খেলোয়াড়দের পরিবর্তন করার জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা দারুণ উদাহরণ তৈরি করেন ভ্যালকারেগি। খেলোয়াড় বদল করে ম্যাচের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করতে শুরু করেন তিনি।
ট্যাকটিক্স
কাতেনাচ্চিও, কাতেনাচ্চিও এবং কাতেনাচ্চিও। ষাটের দশকে হেলেনিও হেরেরা কর্তৃক ইন্টার মিলানে প্রয়োগ করা বিখ্যাত সেই কৌশলকেই ইতালির জাতীয় দলের জন্য বেছে নিয়েছিলেন ফেরুচ্চিও ভ্যালকারেগি।
স্বাভাবিকভাবে কাতেনাচ্চিও বলতে রক্ষণাত্মক ফুটবলকেই বোঝায়, তবে কাতেনাচ্চিওর সবচেয়ে কঠোর প্রয়োগ দেখা যায় ম্যান-মার্কিং, ফিজিক্যাল সেন্টারব্যাককে খেলানো, ভালো বল প্লেয়িং পারেন এমন একজন সুইপার খেলানো, এমন সব ক্ষেত্রে। এই ধরনের ফুটবলে বলটা নিজেদের অর্ধেই থাকে বেশি, আর অ্যাটাকারের মুহূর্তের নৈপুণ্যই ঠিক করে দিতো খেলার ফলাফল। আর এই ফুটবলটা খেলেই অভ্যস্ত ছিল ইতালি, অসন্তোষের জায়গা তৈরি হওয়ার প্রশ্নই আসেনি।
Image Source: The Athletic
সন্তুষ্ট ছিলেন ভ্যালকারেগিও। ততদিন পর্যন্ত মাজোলা আর রিভেরাকে একত্রে খেলাতেন তিনি, সেমিফাইনালেও দুজনই ছিলেন শুরুর একাদশে। তবে খেলার শুরুর দিকেই চোটে পড়ে মাঠ ছাড়েন রিভেরা, পুরো টুর্নামেন্টে আর ফিরে পাননি নিজের কাঙ্ক্ষিত ফিটনেস।
তবে ওই টুর্নামেন্টেরই শেষের দিকে (ঠিক কোন ম্যাচে, সেটা আপাতত চমক হিসেবে থাকুক!) যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে একই সাথে বেশ কয়েকজন অ্যাটাকারকে নামিয়েছিলেন ভ্যালকারেগি। লেফটব্যাক পজিশন থেকে লেফট উইংয়ে ঝড় তোলা জিয়াচিন্তো ফাচেত্তি আর রাইট ইনসাইড থেকে আক্রমণে ওঠা অ্যাঞ্জেলো ডোমেনঘিনিদের সাথে একাদশে ছিলেন দুই ফরোয়ার্ড গিগি রিভা আর পিয়েত্রো আনাস্তাসি। পেছন থেকে আক্রমণের সুতো বুনছিলেন মাজোলা, আর মাঝমাঠ থেকে ড্রিবল করে সামনে এগোচ্ছিলেন জিয়ানকার্লো ডি সিস্তি। শেষ পর্যন্ত যুগোস্লাভিয়াকে ২-০ ব্যবধানে পরাজিত করলেও আক্রমণে সমন্বয়ের অভাব ছিল ইতালি দলের।
বলে রাখা ভালো, চৌদ্দ বছর পরে ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন এই দলটিরই ছাব্বিশ বছর বয়সী গোলরক্ষক দিনো জফ।
জেনে অবাক হবেন যে…
এই টুর্নামেন্টের দুই বছর পর ফুটবলের আইনপ্রণেতা সংস্থা, দ্যা ইন্টারনেশন্যাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড (আইএফএবি) নকআউট ম্যাচে সমতা থাকলে টাইব্রেকারের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারণের নতুন নিয়ম প্রণয়ন করে। এর আগে, টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে নির্ধারিত ১২০ মিনিট শেষে ইতালি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করা সম্ভব না হওয়ায়, সমাধান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় কয়েন টস বা মুদ্রা নিক্ষেপণকে।
এবং আরো অবাক করার মতো ব্যাপার, এই টস কিন্তু মাঠে অনুষ্ঠিত হয়নি, অনুষ্ঠিত হয়েছিল রেফারির ড্রেসিংরুমে। নাপোলির সান পাওলো স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৬৮,০০০ দর্শক তাই ম্যাচের ফলাফল নিয়ে ছিলেন পুরোপুরি অন্ধকারে। হঠাৎ ফাচেত্তিকে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে টানেল দিয়ে দৌড়ে আসতে দেখে তাঁড়া বুঝে যান, জয়ী দলের নাম ইতালি।
জিয়াচিন্তো ফাচেত্তি; Image Source: Getty Images
এখানেই শেষ নয়। জোনাথান ও’ব্রায়েন তাঁর ‘ইউরো সামিটস’ বইয়ে লিখেছেন, টসের সময়ে ফাচেত্তিই ‘কল’ করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিনায়ক আলবার্ট শেস্তেরনিয়ভ ইংরেজি বুঝতেন না, তাই রেফারির “হেডস অর টেলস”-এর উত্তরে সাথে সাথে নিজের ‘কল’ বলেছিলেন ফাচেত্তি।
অন্য সেমিফাইনালে, সদ্য বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ডের ইউরোপ জয়ের স্বপ্নটা পূরণ হয়নি, যুগোস্লাভিয়ার কাছে ১-০ ব্যবধানে হেরে শেষ হয়ে যায় তাদের ইউরো-যাত্রা। ওই ম্যাচটা আরো একটা কারণে বিখ্যাত। প্রথম ইংরেজ খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক ম্যাচে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়েছিলেন অ্যালান মালেরি। তবে আলফ রামসির দল শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে তৃতীয় হয়ে টুর্নামেন্টের সমাপ্তি টানতে পেরেছিল। গোল পেয়েছিলেন ববি চার্লটন এবং জিওফ হার্স্ট।
মূল খেলোয়াড়
ইতালির আক্রমণভাগ নিয়ে একটা প্রশ্ন ছিল সবসময়েই, সঠিক সমন্বয়ের জন্য কোন কোন খেলোয়াড়কে অ্যাটাকার হিসেবে নামানো উচিত। এর উত্তর হিসেবে এসেছেন অধিনায়ক জিয়াচিন্তো ফাচেত্তি, দলের মূল খেলোয়াড় ছিলেন তিনিই। ফুটবল ইতিহাসের খুব কম খেলোয়াড়ই এই দাবি করতে পারেন যে তাঁরা তাঁদের পজিশনে একটা বিপ্লব সাধন করেছেন, তবে সেই ছোট্ট তালিকাতেও অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছেন ফাচেত্তি। কাগজে কলমে একজন লেফটব্যাক তিনি, কিন্তু মাঠের পুরো বাম পাশটা দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি।
ইতালির ফুটবলে কাতেনাচ্চিওর প্রয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড় ছিলেন এই ফাচেত্তি। ইন্টার মিলানে থাকা অবস্থায়, হেরেরা একজন মিডফিল্ডার কমিয়ে আরমান্দো পিচ্চিকে সুইপার ভূমিকায় খেলিয়েছিলেন। এই যে একজন মিডফিল্ডার কমিয়ে একজন ডিফেন্ডার খেলানো হলো, এইটা পূরণ করার জন্য ফাচেত্তিকে বাড়তি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন হেরেরা। বাম পাশ দিয়ে ইচ্ছামতো ওভারল্যাপ করতে পারতেন ফাচেত্তি, আর প্রথমবারের মতো একজন লেফটব্যাককে অ্যাটাকার হিসেবে ব্যবহার করার গর্ব করার সুযোগটা নিয়েছিলেন হেরেরা।
ইতালির ওই দলের জার্সি নম্বর বণ্টিত হয়েছিল নামের অক্ষর অনুসারে। আধুনিক ফুটবলের জার্সি নম্বরের সাথে খুব একটা মিল পাওয়া যায় না, যেমন গোলরক্ষক দিনো জফ তাই ১ নম্বর জার্সির বদলে পেয়েছিলেন ২২। তবে আর কারো ক্ষেত্রে জার্সি নম্বর ঠিকঠাক না হলেও ফাচেত্তির ক্ষেত্রে একেবারে সঠিক হয়েছিল বলেই ধরে নেওয়া যায়। তাঁর আক্রমণাত্মক মানসিকতার সাথে ১০ নম্বর জার্সিটা খুব ভালোভাবেই যায়!
ফাইনাল ম্যাচ
কোন ফাইনালের কথা বলবো আগে, ২-০ নাকি ১-১? রহস্যের খোলাসা করা যাক এবার। স্বাভাবিকভাবে স্ব স্ব সেমিফাইনালে জিতে ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইতালি এবং যুগোস্লাভিয়া। ওই ফাইনালটা শেষ হয়েছিল ১-১ সমতায়। মাঝ বিরতির কিছুক্ষণ আগে গোল করে এগিয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া। ম্যাচের শেষ দিকে, খেলার ধারার বিপরীতেই সমতায় ফেরে ইতালি, আর সেজন্য ধন্যবাদটা প্রাপ্য ডোমেনঘিনির নিচু করে নেওয়া ফ্রিকিকের।
নির্ধারিত সময়ে অমীমাংসিত থাকায়, রোমের ওই স্তাদিও অলিম্পিকোতেই এই ম্যাচটা পুনঃআয়োজনের ব্যবস্থা করা হয় দুই দিন পরে। বিশ্বকাপ এবং ইউরোর ইতিহাসে এটাই ছিল কোন নকআউট ম্যাচ পুনঃআয়োজনের প্রথম এবং একমাত্র উদাহরণ। তবে প্রথম ফাইনালের মতো দর্শক উপস্থিতি ছিল না দ্বিতীয় ফাইনালে। প্রথম ফাইনালে ৬৮ হাজার দর্শক উপস্থিত থাকলেও পরের ফাইনালে উপস্থিত হয়েছিলেন মাত্র ৩২ হাজার।
তবে দ্বিতীয় ফাইনালের মীমাংসা হয়ে যায় দুই দলের একাদশ নির্বাচনেই। মাত্র দুই দিন আগেই অনুষ্ঠিত প্রথম ফাইনালে খেলা বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার একাদশে। ক্লান্ত যুগোস্লাভিয়ানদের দ্বিতীয়ার্ধে সমান তালে দৌড়ানোর মতো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না, বলে শট নেওয়ার ক্ষেত্রেও এর ছাপ পড়েছিল। ওদিকে ইতালির কোচ ভ্যালকারেগি নামিয়েছিলেন প্রায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক একাদশ, পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও শিক্ষা নিয়েছিলেন আগের ম্যাচের ভুল থেকে। চোটের কারণে আগের ম্যাচে না খেলা মাজোলা ছিলেন এই ম্যাচের একাদশে, বিটুইন দ্যা লাইনসে দারুণ পারফর্ম করেন তিনি।
এর আগে লম্বা সময়ে চোটে থাকা ফরোয়ার্ড রিভা, যিনি এখনো ইতালির জার্সিতে সর্বোচ্চ গোল সংগ্রাহক, ঠিকই ওই ম্যাচের শুরুর একাদশে ছিলেন। প্রথম গোলটাও এসেছিল তাঁর পা থেকে।
ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত
ইতালির ওই দলটাকে সর্বকালের সেরা বলার সুযোগ নেই, কিন্তু ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল বের করে আনার সক্ষমতা ছিল দলটির। ফাইনালেও প্রথমার্ধেই দুটো গোল পেয়ে গিয়েছিল দলটি, দ্বিতীয় গোলটাই গড়ে দেয় ম্যাচের ভাগ্য।
ম্যাচের ঘড়িতে মাত্র ত্রিশ মিনিট পেরিয়েছে। ডি-বক্সের মধ্যে সেন্টার ফরোয়ার্ড আনাস্তাসির উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় একটা পাস, সাথে সাথে বলটা ফ্লিক করলেন তিনি, এরপর সরাসরি শটে পাঠালেন জালে। যেকোন প্রেক্ষাপটে দারুণ এই গোলটা পাল্লা দিতে পারে অন্য যেকোন দুর্দান্ত গোলের সাথে।
শিরোপা জয়ের পর পিয়েত্রো আনাস্তাসি (ডানে); Image Source: Getty Images
তবে আনাস্তাসির ওই গোলটা তাঁর নিজের জন্য খুব একটা বিরল নয়। তিন বছর আগে এই ধরাধাম ছাড়ার পরে, তাঁর অবিচুয়ারিতেও ঠিকই উল্লেখ করা হয়েছিল এই ‘অ্যাক্রোবেটিক’ গোল করার সক্ষমতার কথা।
ইতালি কি সত্যিই ইউরোপের সেরা দল ছিল?
ইতালির এই দলটা ইউরোর সেমিফাইনালে জিতেছিল কয়েন টসে, আর ফাইনালে জিতেছে ‘দ্বিতীয় ম্যাচে‘। স্বাভাবিকভাবেই এই শিরোপা জয়ের পেছনে ভাগ্যের ভূমিকা দেখবেন অনেকেই। ইতালির রক্ষণাত্মক মানসিকতার ‘অসুন্দর’ ফুটবলও অনেকের অপছন্দ। সেমিফাইনাল আর প্রথম ফাইনালেও প্রতিপক্ষ ছড়ি ঘুরিয়েছে ইতালির ওপর।
পরের ফাইনালটা ইতালি অপেক্ষাকৃত সহজেই জিতেছে। কিন্তু ফুটবলবোদ্ধাদের কাছে বেশি প্রশংসা পেয়েছে যুগোস্লাভিয়ার পজেটিভ ফুটবল, তাদের জয়টাই যেন বেশি প্রত্যাশিত ছিল সবার কাছে। “শিরোপা জিততে যদি আপনার আট-নয়জন ডিফেন্ডার দরকার হয়,” ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক কলামে বলা হয়েছিল, “তাহলে শিরোপাটা আপনার প্রাপ্য নয়।”
আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, ১৯৬৪ ইউরোতে স্পেন এবং ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের পর টানা তৃতীয় বড় টুর্নামেন্টে শিরোপা জিতলো স্বাগতিক দলটি। একই সাথে এটাও বুঝিয়ে দিলো, তৎকালীন ফুটবলে ঘরের মাঠের গুরুত্ব এবং প্রভাব কত বেশি ছিল। এতটাই, যে মাঠে দর্শকের উপস্থিতি অর্ধেক হলেও ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’-এর প্রভাব কমছে না!