• ইউরো
  • " />

     

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৪

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৪    

    ‘৬৪-তে স্পেন, ‘৬৮-তে ইতালি। পরপর দুটো ইউরোর শিরোপা গেছে স্বাগতিকদের ঘরে। সেই একই ক্রমানুসারে ১৯৭২-এর ইউরোর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা বেলজিয়ামের। কিন্তু না, বেলজিয়াম নয়, চতুর্থ আসরে এসে ইউরোপ পেলো এক নতুন রাজাকে। বিশ্ব ফুটবলের ইতোমধ্যেই পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা, পশ্চিম জার্মানি।

    ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর শুরুর আগে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের চতুর্থ পর্বে থাকছে ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর চতুর্থ আসর আর পশ্চিম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।

    Image Source: Getty Images

    কেমন ছিল সেই ইউরো?

    “অসুন্দর, তবে কার্যকরী” পশ্চিম জার্মান ফুটবল সম্পর্কে বিংশ শতকে জনমনে এই ধারণা প্রচলিত ছিল, যদিও এর সত্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। ঐতিহাসিকভাবে, বড় আসরে প্রতিপক্ষের বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিতে পশ্চিম জার্মানির জুড়ি মেলা ভার। ১৯৫৪ আর ১৯৭৪, পশ্চিম জার্মানির প্রথম দুটো বিশ্বকাপই এসেছিল ফাইনালের ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে। দুই প্রজন্মের দুটো দারুণ আক্রমণাত্মক এবং চোখের জন্য প্রশান্তিদায়ক ফুটবল খেলা দুটো দল, যথাক্রমে হাঙ্গেরি ও নেদারল্যান্ডসকে ফাইনালে হারিয়ে বিশ্ব আসরের শিরোপা ঘরে তুলেছিল জার্মানরা। ফুটবলের বাইরের কিছু ব্যাপারও হয়তো জার্মানদের সম্পর্কে তৈরি করেছিল একটা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ।

    তবে জনমত যেটাই বলুক, পশ্চিম জার্মানির প্রথম ইউরো জয়ের গল্পটা খুবই ‘আন্ডাররেটেড’। জাদুকরী, দুঃসাহসী, মেধাবী একঝাঁক ফুটবলার নিয়ে তৈরি দলটা প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিতো এক ফুঁৎকারে। পাশাপাশি এটাও সত্য, জার্মানদের ওই শিরোপা জয়টা আসর হিসেবে ইউরোর মর্যাদা এবং গুরুত্বও বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটা।

    ম্যানেজার

    পশ্চিম জার্মানির ওই দলের ম্যানেজার ছিলেন হেলমুট শোন। ড্রেসডেনের এক ছবি শিল্প সংগ্রাহকের বাড়িতে জন্ম নেওয়া এই ভদ্রলোকের জীবনের গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে খেলেছেন জার্মান জাতীয় দলে, ১৬ ম্যাচে করেছিলেন ১৭ গোলও, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পেশায় তিনি ফুটবলার ছিলেন না। ব্যাংকে কাজ করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি, পরবর্তীতে স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করেছেন সাংবাদিক হিসেবে।

    “আমি আমার জীবনে ফুটবল ম্যানেজার ছাড়া আর সবই হতে চেয়েছি,” শোন বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এই চাকরিটা বেশ কঠিন হবে, বিনিময়ে খুব বেশি কিছু পাওয়ারও নেই। এই চাকরিটা আবার ছোট বড় অনেক বিষয় এবং পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে, যেগুলোর ওপর আবার ম্যানেজারের তেমন একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে না।”

    হেলমুট শোন; Image Source: Getty Images

    বিশ্বযুদ্ধের পরপরই কোচিং ক্যারিয়ারে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৫০ সালে, পূর্ব জার্মানির ফুটবলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে তিনি এক প্রকার পালিয়েই পশ্চিম জার্মানিতে চলে আসেন। পরবর্তীতে সারল্যান্ড ‘জাতীয়’ দলে কোচিং করানো শুরু করেন তিনি। সারল্যান্ড হলো জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমের অঞ্চল। জায়গাটা ফরাসিদের দখলে ছিল ছয় বছর। এই সময়কালে, এখানকার খেলোয়াড়েরা পশ্চিম জার্মানির প্রতিনিধিত্ব করতে পারতেন না, একই সাথে ফ্রান্সের জার্সি পরতেও অস্বীকৃতি জানাতেন। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে পশ্চিম জার্মানির কাছেই পরাজিত হয়ে শোনের কোচিং ক্যারিয়ারের এই অধ্যায়টা শেষ হয়ে যায়।

    এরপর, ১৯৫৬ সালে সারল্যান্ড আবারও পশ্চিম জার্মানির অংশ হয়ে যায়। পশ্চিম জার্মানির ম্যানেজার তখন সেপ হারবার্গার, যাঁর অধীনে ১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপ জেতে জার্মানরা। হেলমুট শোনকে তখন নিয়োগ দেওয়া হলো হারবার্গারের সহকারী হিসেবে। এর আট বছর পরে, পশ্চিম জার্মানির ম্যানেজারের দায়িত্ব পান হেলমুট শোন। যদিও এই সিদ্ধান্তে হারবার্গারের মত ছিল না। রক্ষণাত্মক-ধাঁচের ফুটবল খেলিয়ে অভ্যস্ত হারবার্গারের দর্শনের সাথে হেলমুট শোনের দর্শনের অমিল ছিল।

    ট্যাকটিক্স

    দায়িত্ব পেয়ে জাতীয় দলকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন হেলমুট শোন। ড্রেসডেনে জিমি হগানের অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর, জোনাথন উইলসনের বই “ইনভার্টিং দ্যা পিরামিড”-এ যাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোচদের মধ্যে একজন হিসেবে। টোটাল ফুটবলের অন্যতম রূপকারও তিনি। টোটাল ফুটবলে মাঠের খেলোয়াড়রা বল পায়ে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে থাকেন, নিয়মিত নিজেদের মধ্যে জায়গা অদলবদল করতে পারেন স্বাচ্ছন্দ্যে।

    ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করেছিল পশ্চিম জার্মানি। এর মধ্যে প্রথম লেগে ওয়েম্বলিতে তারা জয় পায় ৩-১ ব্যবধানে, আর নিজেদের মাটিতে ইংল্যান্ডের নিয়মিত ভালো পারফরম্যান্সের কারণে পশ্চিম জার্মানির ওই সাফল্যের গুরুত্ব আরো বেশি।

    পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডের ববি মুর; Image Source: Getty Images

    “জার্মান ফুটবলটা যেন ডাচ ফুটবলের অবিকল প্রতিলিপি হয়ে গিয়েছিল,” জার্মান ফুটবল ট্যাকটিক্সের ইতিহাসের বই “ভম লিবেরো জুর ডপেলসেখস” (লিবেরো থেকে ডাবল পিভট)-এ লেখক টবিয়াস এশার লিখেছিলেন, “শোনের দর্শন, আধিপত্যপূর্ণ খেলা, বলের দখল রাখা, সবই ছিল রাইনাস মিশেলসের অনুরূপ। শোনের খেলোয়াড়েরা আয়াক্সের দর্শন ভালোভাবেই জানতো। বায়ার্ন মিউনিখ আর বরুশিয়া মনশেনগ্ল্যাডবাখের হয়েই খেলতেন অধিকাংশ পশ্চিম জার্মান খেলোয়াড়, আর তাঁরা প্রীতি ম্যাচ বা ইউরোপিয়ান কাপে নিয়মিত মুখোমুখি হতেন আয়াক্সের। জায়গা অদলবদল করে খেলার ডাচ ধরনটার সাথে তাঁরা ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন।”

    পশ্চিম জার্মানির খেলায় একটু পুরনো-ধাঁচের রক্ষণাত্মক ভাব ছিল, ডাচদের মতো মাঠের ওপরের দিকে প্রেস করে খেলতো না তারা। বরং শারীরিকভাবে শক্তিশালী সেন্টারব্যাকদের নিয়ে ম্যান-টু-ম্যান মার্ক করেই খেলতো দলটা।

    তবে এটা কেবলই একটা সতর্কতা ছিল। ব্রায়ান গ্লানভিল ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনে জার্মানদের খেলার ধরনের বেশ প্রশংসা করেছিলেন। “মেক্সিকো বিশ্বকাপে ব্রাজিলের খেলা থেকে শিক্ষা নিয়েছিল জার্মানরা। তারা বুঝেছিলো, আক্রমণাত্মক-ঘরানার ফুটবলকে আর অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। ইতালি আর ব্রিটেন তখনো এই ধাঁচটাকে অবহেলা করছিলো, একটু গোঁয়ার্তুমি করেই, তবে নেদারল্যান্ডস আর পশ্চিম জার্মানিতে ছিল এর সমাদর। ”

    ১৯৭২ ইউরোর ফাইনালে এই ছবিতে দেখানো ফরমেশন ব্যবহার করেছিল পশ্চিম জার্মানি।

    Image Source: The Athletic

    ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার সুইপার পজিশন থেকে সামনে এগিয়ে একজন বাড়তি মিডফিল্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন। হার্বার্ট উইমার মিডফিল্ডের ডানে খেলার পাশাপাশি পুরো মাঠজুড়ে প্রতিপক্ষকে ট্যাকেল করে বল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। পল ব্রেইটনার তাঁর গতিকে কাজে লাগিয়ে ওভারল্যাপ করতেন। আর জার্মানদের দুই উইংই শক্তিশালী হলেও, বেশিরভাগ আক্রমণ বাম পাশ থেকেই আসতো।

    মূল খেলোয়াড়

    জনপ্রিয় উত্তর হিসেবে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের নাম নেওয়া যেতে পারে, অথবা সেমিফাইনাল আর ফাইনালে জোড়া গোল করা জার্ড মুলার।

    কিন্তু না।

    পশ্চিম জার্মানির সেরা খেলোয়াড় ছিলেন গুন্টার নেটজার। পুরো খেলাটা পরিচালনা করতেন এই নম্বর টেন, আক্রমণের জন্য চমৎকার সব বল জোগান দিতেন। ওই বছর আর তার পরের বছরে যে তিনি সেরা জার্মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেই তথ্যটাই দলে তাঁর গুরুত্ব আর কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

    কোচ হেলমুট শোনের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন নেটজার; Image Source: Getty Images

    মাঠের খেলার বাইরে, সুদর্শন চেহারা আর খ্যাতির জন্য তাঁকে তুলনা করা যায় জর্জ বেস্টের সাথে। তবে মাঠে নেটজার ছিলেন খুবই শান্ত। হেঁটে হেঁটে খেলতেন অনেক ক্ষেত্রে, বল পায়ে নিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে  আসার জন্য অপেক্ষা করতেন। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা কাছে এলেই দারুণ দক্ষতায় সরে যেতেন বল নিয়ে, ট্যাকেল এড়িয়ে বল নিয়ে এগিয়ে পাস দিতেন। পরিসংখ্যান বিবেচনায় তাঁকে বলা যায় মেসুত ওজিল আর টনি ক্রুসের মিশেলে তৈরি এক খেলোয়াড়। সেমিফাইনালে বেলজিয়ামকে ২-১ ব্যবধানে হারানো আর ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানের বড় জয়, দুটোরই মূল কারিগর তিনি।

    ক্লাব পর্যায়ে গ্ল্যাডবাখে খেলতেন নেটজার। একটা সময়ে ধারণা করা হতো, গ্ল্যাডবাখ আর বায়ার্নের ‘জাত’ অধিনায়ক, যথাক্রমে নেটজার আর বেকেনবাওয়ারকে হয়তো একই সাথে পশ্চিম জার্মানির একাদশে খেলানো অসম্ভব। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণিত করে, ক্লাবের প্রতিদ্বন্দিতাকে জাতীয় দলে টেনে আনেননি দুজনের কেউই। ক্লাবে দুজন একই পজিশনে খেললেও পশ্চিম জার্মানির হয়ে খেলার সময়ে বেকেনবাওয়ার পেছন থেকে খেলা শুরু করে সামনে এগিয়ে যেতেন, আর নেটজার একটু পেছনে নেমে আসতেন। তাতে আখেরে লাভটা হতো পশ্চিম জার্মানির।

    ফাইনাল ম্যাচ

    ওই গ্রীষ্মের অলিম্পিকের আগে মিউনিখের অলিম্পিয়াস্তাদিওন স্টেডিয়ামের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউরোর আগে অনুষ্ঠিত ওই প্রীতি ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল পশ্চিম জার্মানরা। ওই পারফরম্যান্সকে অনেকেই পশ্চম জার্মানির সেরা পারফরম্যান্স হিসেবে মনে করেন।

    এর এক মাস পরে, ইউরোর ফাইনালে যখন আবার মুখোমুখি হয় দুই দল, ওই প্রীতি ম্যাচটা আরেকবার অনুপ্রাণিত করেছিল হেলমুট শোনের শিষ্যদের। “সবকিছুই যেন ঠিকঠাক চললো। দল ভালো খেললো, কোচিং ভালো হলো, একেবারে খাপে খাপ,” জার্ড মুলার বলেন, “আমরা ফাইনালে প্রতিপক্ষকে ভয় পাইনি। আমরা ওদেরকে আগেও হারিয়েছি, আর প্রত্যেকেই জানতাম যে কে কাকে মার্ক করছি। ভালো একটা ম্যাচ গিয়েছিল আমাদের জন্য।”

    ভালো বললে কমই বলা হয়। একচ্ছত্র আধিপত্যই ছিল সেটা।

    বল পজেশনে এগিয়ে ছিল জার্মানরা, আক্রমণেও। ফাইনালের তুলনায় একটু ভিন্ন ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল নেটজারকে, বল পায়ে ভয়ঙ্করভাবে ড্রিবল করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এরপর যেন কাঁটা কম্পাসে নিখুঁতভাবে মেপে পাস দিয়ে দিচ্ছিলেন দুই উইংয়ে। বেকেনবাওয়ারকে মার্কিং করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্বল্প দূরত্বে মুলারের দ্রুতগতির দৌড়গুলোর সাথেও তাল মেলাতে পারছিলেন না তাঁরা। সেই সুযোগেই বক্সে জায়গা করে নিয়ে দুটো গোল পেয়ে যান মুলার। অপর গোলটা এসেছিল অখ্যত উইমারের পা থেকে।

    ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের এই আসরেই প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছিল খেলোয়াড় বদলির নিয়ম, কিন্তু হেলমুট শোন ওসবের ধার ধারেননি। মাঠের একাদশ যদি নিখুঁত-নির্ভুল খেলতে থাকে, কোচ তবে খেলোয়াড় বদলাবেন কেন!

    ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত

    ফাইনালের প্রথম গোলটাকে বেশ সাদামাটা বললে ভুল হবে না। ইয়ুপ হেইঙ্কেসের শটটা আটকে গিয়েছিল গোললাইনের আগেই, ফিরতি শটে বলকে জাল স্পর্শ করান জার্ড মুলার, একেবারে ক্লাসিক পোচার-সুলভ গোলে। শোন সবসময়েই বলতেন, মুলার নাকি ‘লিটল গোল’ করে অভ্যস্ত, আর এই গোলটা ছিল তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

    মুলারের গোলে জার্মানির এগিয়ে যাওয়া; Image Source: Getty Images

    তবে এর পনেরো সেকেন্ড আগে যাওয়া যাক। গোলের আগে পশ্চিম জার্মানি দলের মুভগুলো ছিল দারুণ, ঠিক যেভাবে তারা পুরো টুর্নামেন্টে রাজত্ব করে এসেছিল। ড্রিবলিং করে বল নিয়ে সামনে এগিয়েছিলেন বেকেনবাওয়ার, এরপর বলটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড মুলারের কাছে। মুলার চিপ করে দেন নেটজারের কাছে, যদিও তাঁর দর্শনীয় অ্যাক্রোবেটিক ভলিটা শুধু ক্রসবারেই আঘাত করতে পেরেছিল।

    ব্যাপারটাকে পশ্চিম জার্মানির জন্য রূপক হিসেবেও ধরা যায়। বেকেনবাওয়ার আর নেটজারের পায়ে ফুটবলটা ধরা দিয়েছিল সর্বোচ্চ সৌন্দর্যে, আর মুলারের পায়ে তা পূর্ণতা পেয়েছিল সাফল্যে।

    জেনে অবাক হবেন যে…

    ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ১৯৬০ আর ১৯৬৪-এর আসরে অংশগ্রহণ করেনি পশ্চিম জার্মানি। ১৯৬৮-এর আসরে অংশগ্রহণ করলেও, কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় দলটি, গ্রুপ পর্বে যুগোস্লাভিয়ার চেয়ে এক পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। সেই অর্থে, ১৯৭২ সালেই প্রথমবারের মতো ইউরোর মূল আসরে অংশ নেয় পশ্চিম জার্মানি, আর প্রথম আসরেই বাজিমাত!

    বিংশ শতাব্দীতে ইউরোর মোট সাতটা আসরের মূল পর্বে খেলেছিল জার্মানি। এর মধ্যে তিনবারই চ্যাম্পিয়ন, দু’বার রানার্সআপ, একবার সেমিফাইনাল খেলা, আর একবার গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়। গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়টা ১৯৮৪ সালের ঘটনা, স্পেনের শেষ মিনিটের গোলে কপাল পুড়েছিল জার্মানদের।

    পশ্চিম জার্মানি কি সত্যিই ইউরোপের সেরা দল ছিল?

    অবশ্যই।

    “ওরা ছিল ইউরোপের সেরা দল। দুই বছর পরের বিশ্বকাপের জন্য ওরা কতটা প্রস্তুত, সেটার প্রমাণও রেখেছিল,” ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনে এমনটাই লেখা হয়েছিল। রজার ম্যাকডোনাল্ড একটা ম্যাচ রিপোর্টে লিখেছিলেন, “পশ্চিম জার্মানির জয়টা শুধুই আর দশটা ম্যাচের মতো মাঝারি মানের দলের বিপক্ষে বড় দলের জয় ছিল না। জয়টা ছিল মোটাদাগে আক্রমণাত্মক বিচক্ষণ ফুটবলের জয়।”

    ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ইতিহাস লিখতে গিয়ে রব ফিল্ডার লিখেছেন, “পশ্চিম জার্মানই বস্তুতই নিজেদেরকে দুর্দান্ত দল হিসেবে প্রমাণ করেছে। এখন পর্যন্ত ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ইতিহাসের চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলগুলোর মধ্যে সেরা তারাই, নিঃসন্দেহে।”

    সে বছরের ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, সেটিও মুলার আর নেটজারের চেয়ে মাত্র দুই পয়েন্টে এগিয়ে থেকে।

    সব মিলিয়ে, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর তুলনায় এতটা এগিয়ে থেকে শিরোপা জেতার গল্প খুব বেশি লেখা হয়নি ফুটবল ইতিহাসে।