ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৫
‘৬০-এ চ্যাম্পিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ‘৬৪-তে স্পেন, ‘৬৮-তে ইতালি, ‘৭২-এ পশ্চিম জার্মানি। আগের চার আসরে ভিন্ন ভিন্ন চার চ্যাম্পিয়ন দেখা ইউরোর ১৯৭৬ সালের আসরটা যেন আরো এক নতুন চ্যাম্পিয়নের অপেক্ষাতেই ছিল। সেই অপেক্ষার শেষটা সুন্দরভাবেই হলো। যুগোস্লাভিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত ইউরোর পঞ্চম আসরে চেকোস্লোভাকিয়াকে দেখা গেল প্রথমবারের মতো শিরোপা জয় করতে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই ইউরোর ফাইনালের সেরা মুহূর্তটা চেকোস্লোভাকিয়ানদের শিরোপা জয় নয়, বরং এক অভূতপূর্ব পেনাল্টি। বিশ্ব একে চেনে ‘পানেনকা’ নামে।
ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর শুরুর আগে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের পঞ্চম পর্বে থাকছে ১৯৭৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর পঞ্চম আসর আর চেকোস্লোভাকিয়ার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।
Image Source: Getty Images
কেমন ছিল সেই ইউরো?
ইউরোর সবগুলো আসরের মধ্যে ‘৭৬-এর আসরটা একটু বিশেষ। এই আসরেই বিশ্ব প্রথমবারের মতো দেখেছিল পানেনকা, দেখেছিল পশ্চিম জার্মানিকে ফাইনালে পরাজিত করে চেকোস্লোভাকিয়াকে প্রথম ইউরো জিততে।
ফুটবলীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যে চেকোস্লোভাকিয়া বেশ সমৃদ্ধ ছিল সবসময়েই। ১৯৩৪ আর ১৯৬২ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছিল দলটি, ১৯৬০ এর ইউরোটা শেষ করেছিল তৃতীয় স্থানে থেকে। চেকোস্লোভাকিয়ার বিভক্তির পরে, চেক প্রজাতন্ত্র ফাইনাল খেলেছে ইউরো ১৯৯৬-এর ফাইনালে। দারুণ খেলে ২০০৪-এর সেমিতেও পৌঁছে গিয়েছিল দলটি, পাভেল নেদভেদ চোটে না পড়লে হয়তো ফাইনালেও খেলতে পারতো।
তবে ‘৭৬-এর সাফল্যটা একটু বিশেষ ছিল চেকোস্লোভাকিয়ার জন্য। ওই দলের বেশির ভাগ সদস্যই চেক নন, বরং স্লোভাক ছিলেন। আগের দুই দশকের প্রেক্ষাপটে এই ব্যাপারটাও বেশ চমকজাগানিয়া, কেননা স্বাভাবিকভাবে চেকোস্লোভাকিয়া দলে চেকদের আধিপত্যই ছিল বেশি।
ম্যানেজার
বিশ্বকাপ ও ইউরোজয়ী কোচদের তালিকায় ভ্যাক্লাভ জেজেকের নামটা সাধারণত একটু আড়ালেই থেকে যায়। পত্রিকাগুলোর বর্ণনানুসারে, সে সময়ের অনেক ম্যানেজারের মতো জেজেকও ছিলেন একজন চেইন স্মোকার। তবে দলের সাফল্যে তাঁর অবদানের ব্যাপারে খুব বেশি কিছু বর্ণিত হয়নি তৎকালীন সংবাদমাধ্যমে। স্পার্টা প্রাগার হয়ে চারটা ভিন্ন ভিন্ন স্পেলে কাজ করেছিলেন তিনি, আর শিরোপা জিতেছেন প্রতি স্পেলেই।
ম্যানেজার ভ্যাক্লাভ জেজেক; Image Source: Koen Suyk / Anefo
তবে চেকোস্লোভাকিয়ার এই দলের কোচিং প্যানেলে অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচের ভূমিকা ছিল অনেক। জোজেফ ভেনগ্লোস, শারীরিক শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রির জন্য যাঁকে ‘ডক্টর জোজেফ ভেনগ্লোস’-ও বলতেন অনেকে, শুধুই এই দলের কোচ জেজেকের ডেপুটি ছিলেন না। চেকোস্লোভাকিয়ানদের সাফল্যেও তাঁর অবদান ছিল অনেক।
একই সাথে স্লোভান ব্রাতিস্লাভা দলের ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করছিলেন তিনি, এবং জেজেককে বুঝিয়ে তাঁর প্রিয় একজন খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে রাজি করেন তিনি। অ্যান্টন অন্দ্রাস নামের ওই খেলোয়াডের ডাকনাম ছিল “দ্যা বেকেনবাওয়ার অব দ্যা ইস্ট”, কেননা একজন অ্যাটাকার থেকে পরবর্তীতে সুইপার রোলে নিজেকে অভ্যস্ত করেছিলেন তিনি। আবার পরবর্তীতে স্লোভানদের হয়ে একটা ম্যাচে অ্যাটাকার হিসেবে খেলে চারটা গোল করে প্রমাণ করেন যে তিনি ফুরিয়ে যাননি। ইউরোর সেমিফাইনাল ম্যাচেও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হেডে গোল করেন তিনি, যদিও এরপর আত্মঘাতী গোল করে আবার তিনিই সমতা এনে ম্যাচকে নিয়ে যান অতিরিক্ত সময়ে।
জেজেক দায়িত্ব ছাড়ার পরে ভেনগ্লোস দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যদিও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবেই তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি কার্যকর।
ট্যাকটিক্স
‘৭০-এর ব্রাজিল, ‘৭২ এবং ‘৭৪-এর জার্মানি, ‘৭৪ এর নেদারল্যান্ডসের মতো আক্রমণাত্মক বা আধিপত্যপূর্ণ ফুটবল খেলতো না চেকোস্লোভাকিয়া।
ম্যাচের অনেকটা সময়ে ব্যাকফুটে থাকতেও আপত্তি ছিল না দলটির, অপেক্ষা করতো অন্দ্রাসের ব্যক্তিগত ঝলকের জন্য। মাঠের নিচের অংশে সুইপার ভূমিকায় উজ্জ্বল ছিলেন অন্দ্রাস, এরপর সেট পিস বা দ্রুতগতির কাউন্টার অ্যাটাক থেকে হেডিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের জাল খুঁজে নিতেন। এই সেট পিস আর দ্রুতগতির কাউন্টার অ্যাটাক থেকেই সেমিফাইনালের অতিরিক্ত সময়ের দুটো গোল পেয়ে গিয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়ানরা, আর প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডসও ততক্ষণে পরিণত হয়েছে নয়জনের দলে।
Image Source: The Athletic
তবে একই সময়ে, দল হিসেবে চেকোস্লোভাকিয়া খেলতো পরিষ্কার ফুটবল। সেন্টার ফরোয়ার্ডকে টার্গেট ম্যান হিসেবে ব্যবহার করে তাঁর উদ্দেশ্যে একের পর এক লং বলে দেওয়ার পরিবর্তে দলটি খেলতো গতিময় ফুটবল। তিনজন ফরোয়ার্ড নিজেদের মধ্যে জায়গা পরিবর্তন করতেন নিয়মিত, যেকোন উইং বা মাঝ দিয়ে গতি দিয়ে পরাস্ত করতে পারতেন প্রতিপক্ষকে। অন্দ্রাস আর রাইটব্যাক ইয়ান পিভারনিক প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের আটকে দিতেন, আর দুজন মিডফিল্ডার নিজেদের জায়গাটা ধরে রাখতেন। এই মিডফিল্ডারদেরই একজন, ক্যারল ডবিয়াস, ফাইনালে একটি দুর্দান্ত লং-রেঞ্জ গোলও করেছিলেন।
মূল খেলোয়াড়
চেকোস্লোভাকিয়ার গোলরক্ষক ইভো ভিক্টরকে গোলরক্ষক হিসেবে বেশ উঁচু মানের মনে করতেন ফুটবলবোদ্ধারা। ১৯৬৯ সালে ব্যালন ডি’অরের লিস্টে তেইশতম হয়েছিলেন তিনি, একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে জায়গা পেয়েছিলেন এই তালিকায়।
তবে ইউরো ১৯৭৬ ছিল ভিক্টরের শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, আর নিজের সুখ্যাতিকে বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য এই টুর্নামেন্টকেই বেছে নেন তিনি। সেমিফাইনালে ডাচদের বিপক্ষে দারুণ কিছু সেভ করেছিলেন তিনি, এরপর ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষেও জ্বলে ওঠেন আরেকবার। নিঃসন্দেহে তিনিই ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়, ব্যালন ডি’অরের শর্টলিস্টেও তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন তিনি।
টুর্নামেন্টের শেষ দুটো ম্যাচ, অর্থাৎ সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে, সর্বমোট তিনটা গোল হজম করেছিলেন ভিক্টর। তবে প্রথম দুটো গোলের জন্য তাঁকে দোষ দেওয়ার কোন সুযোগই নেই। আর তৃতীয় গোলের ক্ষেত্রে ধারণা করা হয় যে ক্রস আটকাতে গিয়ে ফাউলের শিকার হয়েছিলেন তিনি, যদিও নিজের সাময়িক অমনোযোগিতাকেই মূলত এজন্য দায়ী করেছিলেন ভিক্টর। অবশ্য অনেক ফুটবল-বিশেষজ্ঞ মনে করেন, উঁচু বলগুলো গ্লাভসে আনাই ছিল ভিক্টরের মূল দুর্বলতা।
ভিক্টরের সামনে আরো একবার নায়ক হওয়ার সুযোগ এসেছিল। ২-২-এ অমীমাংসিত হওয়া ফাইনালটা শেষ পর্যন্ত গড়ায় টাইব্রেকারে। যদিও গোলরক্ষক ভিক্টর ঠেকাতে পারেননি প্রতিপক্ষ পশ্চিম জার্মানির কোন শটই, তবে ইউলি হোয়েনেসের শটটা বারের অনেক ওপর দিয়ে চলে যাওয়ায় ম্যাচশেষে আক্ষেপেও পুড়তে হয়নি চেকোস্লোভাকিয়ানদের।
ফাইনাল ম্যাচ
পশ্চিম জার্মানি আর চেকোস্লোভাকিয়ার এই ফাইনালকে ধরা হয় ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাইনাল হিসেবে। দুই দলই ছিল বেশ আত্মবিশ্বাসী, গোল করার প্রচুর সুযোগ এসেছিল দুই প্রান্তেই। দুই ‘সুইপার’ অন্দ্রাস আর বেকেনবাওয়ার হুটহাট আক্রমণে ওঠার সক্ষমতা রাখতেন।
২৫ মিনিটের মধ্যে দুই গোলের লিড পেয়ে যায় চেকোস্লোভাকিয়া। প্রথমে গোলের ক্ষেত্রে জেডেনেক নেহোদা কাটব্যাক করেছিলেন ইয়ান সভেলিককে, সভেলিকের শটটা খুঁজে নেয় পশ্চিম জার্মানির জাল। পরবর্তীতে ডবিয়াসের লং রেঞ্জ শটে ব্যবধান দ্বিগু করে চেকোস্লোভাকিয়া। ঠিক পরপরই একটা গোল শোধ করে ফেলে পশ্চিম জার্মানি। গোলটার পাশে লেখা হয় মাত্র দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামা দিয়েতের মুলারের নাম। ওই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালেই অভিষেক হয়েছিল মুলারের, বদলি হিসেবে নেমে হ্যাটট্রিক করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
গোল শোধের জন্য মরিয়া পশ্চিম জার্মানি আক্রমণের পর আক্রমণ করতে থাকে। এদিকে চেকোস্লোভাকিয়ার গোলরক্ষক ভিক্টর একের পর এক দুর্দান্ত সেভ দিয়ে গোলবঞ্চিত করতে থাকেন পশ্চিম জার্মানদের। কখনো গোললাইন ছেড়ে সামনে এসে, কখনো নিজেকে পুরোপুরি ছড়িয়ে দিয়ে। তবে ম্যাচ শেষের ঠিক এক মিনিট আগে পরাস্ত হন তিনি। কর্নার থেকে ভেসে আসা বলে মাথা লাগিয়ে ম্যাচে সমতা ফেরান বার্নড হোলজেনবেইন। যদিও বর্তমান ফুটবলে হয়তো ভিএআরে বাতিল হতো গোলটা, হোলজেনবেইনের কনুই আঘাত করেছিল গোলরক্ষক ভিক্টরকে।
নির্ধারিত সময়ের পরে অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরুর আগে ভিক্টরকে দেখা গিয়েছিল মাঠে শুয়ে শুয়ে খোশমেজাজে সতীর্থদের সাথে আড্ডা দিতে। কে জানে, হয়তো ভবিষ্যতটা দেখতে পাচ্ছিলেন তখনই!
অতিরিক্ত সময়েও দুই দলের চমৎকার ফুটবল অব্যাহত থাকে, দুই অর্ধেই সুযোগ পেতে থাকেন ফরোয়ার্ডরা। মূলত বদলি হিসেবে নামা খেলোয়াড়রাই ম্যাচের গতি ধরে রেখেছিলেন, যদিও ‘বদলি খেলোয়াড়’ ব্যাপারটা তখনও ফুটবলে বেশ নতুন।
জেনে অবাক হবেন যে…
ফাইনাল ম্যাচের আগ পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল না যে ম্যাচটা অমীমাংসিতভাবে শেষ হলে ঠিক কীভাবে দুই দলকে পৃথক করা হবে। পরবর্তীতে ফাইনালের দিন এই ঐক্যমত্যে পৌঁছানো হয় যে, নির্ধারিত সময়ে দুই দলের গোল পার্থক্য না থাকলে শিরোপা তুলে দেওয়া হবে টাইব্রেকারে জয়ী দলের হাতেই।
প্রথমে আইডিয়া ছিল, ১৯৬৮ ইউরোর মতো এবারও ফাইনাল ম্যাচটা পুনঃআয়োজিত হবে দুই দিন পরে। তবে দুই ফেডারেশনের মতামতের ভিত্তিতে, বিশেষত পশ্চিম জার্মানির ফেডারেশনের চাওয়ায়, ওই রাতেই ফলাফল নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিক-অফের কয়েক ঘণ্টা আগে উয়েফা রাজি হয় টাইব্রেকারের সিদ্ধান্তে, এরপর সেটা জানিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিম জার্মানদের ড্রেসিংরুমে। দ্যা মিউনিখ মার্কেট সংবাদপত্র জানিয়েছিল, এই সিদ্ধান্তে জার্মান অধিনায়ক বেকেনবাওয়ার হতভম্ব হয়ে যান। আগে থেকে এমন কিছুই জানতেন না তিনি। যখন জানলেন, পেনাল্টি অনুশীলনের সময়টাও ছিল না তাঁর দলের হাতে। ক্লাব পর্যায়ে নিয়মিত পেনাল্টি নেন, এমন মাত্র একজন খেলোয়াড়ই ছিল পশ্চিম জার্মান দলে, বাকিদের মধ্যে স্বেচ্ছায় পেনাল্টি নিতে চাওয়ার সংখ্যা ছিল বেশ কম।
ওদিকে চেকোস্লোভাকিয়া নিজেদের পেনাল্টি অনুশীলনে কোন কমতি রাখেনি। এমনকি স্থানীয় মানুষকে অনুশীলনে এনে টাইব্রেকারের পরিস্থিতিও কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করেছিলেন ম্যানেজার জেজেক। জানতেন, ফাইনালে চেকোস্লোভাকিয়ান দর্শকদের উপস্থিতি খুব বেশি থাকবে না। তাঁর ধারণা সঠিক হয়েছিল। যদিও, জয়ের পরে নিরপেক্ষ সমর্থকদের অভিবাদনটা ঠিকই পেয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়ানরা।
ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত
না, এটা সঠিকভাবে ধারণা করতে পারার জন্য কোন পুরস্কার নেই। পানেনকার ওই পেনাল্টি শুধু সাহসীই ছিল না, একই সাথে ছিল অভূতপূর্বও। পোস্টের মাঝ বরাবর এমন চিপ করে পেনাল্টি শট নিতে আগে কেউ কখনো দেখেনি। তৎকালীন সংবাদমাধ্যমে এই পেনাল্টিকে “ডিপিং অ্যান্ড কার্লিং” বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। একটু অতিরঞ্জন তো ছিলই, তবে এর অভিনবত্বে আশ্চর্যান্বিত হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না মোটেই।
খুব কম ফুটবলারই ফুটবলের কোন একটা মুভকে নিজের নামে ‘পেটেন্ট’ করে নিতে পেরেছেন। ‘ক্রুইফ টার্ন’ বললে যেমন বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে আর একটা শব্দও ব্যবহার করা লাগে না, পানেনকার ক্ষেত্রেও তাই। এমনকি ‘পানেনকা পেনাল্টি’-ও বলার প্রয়োজন নেই, ‘পানেনকা’ বললেই যথেষ্ট।
ট্রফি হাতে পানেনকা; Image Source: Getty Images
এমনিতেও খেলোয়াড় হিসেবে পানেনকা বিশেষ একজনই ছিলেন। তাঁর সময়ের অন্যতম ক্লাসিক প্লেমেকার ছিলেন তিনি। তেমন পরিশ্রমী ছিলেন না, খুব বেশি গতি বা স্ট্যামিনাও ছিল না, ট্যাকেল করতে পছন্দ করতেন না। কিন্তু পাসিংয়ে ছিলেন সৃষ্টিশীল, আর সেট পিসে বিশেষজ্ঞ। মাঠে নিজের প্রতিভার অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বাস্য ঝলক দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে চমক দিতে পারতেন তিনি। আর অমন পেনাল্টি তো ছিল সকলের ধারণার বাইরে।
“ডানে বা বাঁয়ে শট নিতে আমার কোন সমস্যা ছিল না,” ২০১৭ সালে স্পোর্ট৩৬০-কে পানেনকা বলেন, “আমি সবসময়েই গোলরক্ষকের প্রাথমিক মুভমেন্টের জন্য অপেক্ষা করতাম, এরপর নিজের শট নেওয়ার দিক ঠিক করতাম।”
“পেনাল্টি ঠেকানোর ক্ষেত্রে গোলরক্ষকদের জন্য মাঝে অবস্থান করাটা কঠিন,” পানেনকা আরো বলেন, “যদি মাঝে অবস্থান করার কারণে গোল হজম করতে হয়, তখন সব দোষ পড়বে গোলরক্ষকের কাঁধে, বলা হবে কেন সে কোন একদিকে ঝাঁপ দিলো না।”
তাই, ট্রেনিংয়ে অনেকবার অনুশীলনের পরে, নিজের ক্লাবের গোলরক্ষকদের বিপক্ষে অনুশীলন করে, অবশেষে সময় এলো মাঠে সেটা করে দেখানোর। ম্যাচের আগে সতীর্থদেরকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন পানেনকা, ম্যাচ যদি পেনাল্টি শুটআউটে গড়ায়, একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্ম দিয়েই দলকে জেতাবে তিনি। এমনই এক মুহূর্ত, ইউরোর ইতিহাসে যা রইবে চির অক্ষয় হয়ে!
একটু ঝুঁকিও ছিল, বিশেষত একটি কঠোর কমিউনিস্ট দেশে অমন একটা মুহূর্তের জন্ম দেওয়াটা অনেকেরই ভালো চোখে দেখার কথা না। কিন্তু একটু ঝুঁকি না থাকলে সাহসী কাজের মজাটা কোথায়! ঝুঁকির ব্যাপারটা পানেনকা নিজেও জানতেন, বেন লিটলটনের বইয়ে পেনাল্টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন তা। পানেনকা জানতেন, বারো গজ দূর থেকে অমন অদ্ভুতুড়ে পেনাল্টি নিতে গিয়ে মিস করে ফেললে দেশে ফিরে হয়তো কঠোর শাস্তিও পেতে হতে পারতো তাঁকে।
চেকোস্লোভাকিয়া কি সত্যিই ইউরোপের সেরা দল ছিল?
ইউরো জিতলেও চেকোস্লোভাকিয়াকে নিঃসংকোচে ইউরোপের সেরা দল বলা যায় না। সেমিফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে নয়জনের নেদারল্যান্ডসকে পরাজিত করে ছিল দলটি, ফাইনাল জিতেছিল টাইব্রেকারে। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সেরা দল হওয়ার জন্য যতটা আধিপত্য দরকার, ততটা ছিল না চেকোস্লোভাকিয়ার। এর পাশাপাশি, দলের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন গোলরক্ষক ইভো ভিক্টর। তবে এটাও সত্য, এই দলটাই টানা বিশ ম্যাচ অপরাজিত ছিল, সেমিফাইনাল আর ফাইনালেও তারাই অপেক্ষাকৃত ভালো দল ছিল, এবং এই কারণেই ফুটবলবোদ্ধাদের সাধুবাদও কুড়িয়েছে দলটি। বিশেষত জার্মান সংবাদমাধ্যমে এসেছিল চেকোস্লোভাকিয়ানদের ভূয়সী প্রশংসা।
সব মিলিয়ে, এই টুর্নামেন্টটাকে ধরা হয়েছিল ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের অন্যতম সেরা আসর হিসেবে। ‘গোমড়া-মুখো’ হিসেবে খ্যাত ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনেও প্রশংসা করা হয়েছিল এই আসরের।
Image Source: Guenin Sportivo
“ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন সবসময়ে নিজেদের পা মাটিতে রাখতেই পছন্দ করে,” ১৯৭৬ সালের জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, “জনমতের পক্ষে গিয়ে সাফল্য খোঁজার ব্যাপারটা এড়িয়ে চলে, যৌক্তিক সমালোচনা করতে চায়। তাই, ওয়ার্ল্ড সকার যখন কোন ব্যাপারে প্রশংসা করে, তার মানে ব্যাপারটা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বের ওই এক সপ্তাহ আমাদের জন্য অনেক আনন্দ বয়ে এনেছে। আমাদের মনে হয়েছে, ফুটবল এবং ফুটবলাররা যেন নতুন করে নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন। সেমিফাইনালের চারটা দলই গোল করার জন্য মুখিয়ে ছিল, এই বিষয়টা বেশ কিছুদিন ধরেই ফুটবলে নিখোঁজ ছিল।”
শেষ চারের যেকোন দলই শিরোপাটা জিততে পারতো। চার বছর আগে ইউরো এবং দুই বছর আগে বিশ্বকাপ জেতা পশ্চিম জার্মানি, একটু অগোছালো হলেও দুই বছর আগে ও পরে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা নেদারল্যান্ডস, এবং স্বাগতিক যুগোস্লাভিয়ার পাশে চেকোস্লোভাকিয়ানদের সুযোগ একটু কম বলেই মনে হচ্ছিলো।
শেষ পর্যন্ত এমন টুর্নামেন্ট থেকে জয়ীরূপে ফেরা, সেটাও এমন দুর্দান্ত এক মুহূর্তের জন্ম দিয়ে, ইউরোপজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল ব্যাপারটা। প্রতিযোগিতা হিসেবে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এখন শুধু ‘সিরিয়াস’-ই নয়, একই সাথে হয়ে উঠলো চিত্তাকর্ষকও!