'আইস অ্যান্ড ফায়ার' লিটন-হৃদয়ে বাংলাদেশের লো-স্কোরিং থ্রিলার জয়
গ্রুপ পর্ব, ডালাস (টস-বাংলাদেশ/বোলিং)
শ্রীলঙ্কা - ১২৪/৯, ২০ ওভার (নিসাঙ্কা ৪৭, ধনঞ্জয়া ২১, আসালাঙ্কা ১৯, মোস্তাফিজ ৩/১৭, রিশাদ ৩/২২, তাসকিন ২/২৫)
বাংলাদেশ - ১২৫/৮, ১৯ ওভার (হৃদয় ৪০, লিটন ৩৬, মাহমুদউল্লাহ ১৬*, থুসারা ৪/১৭, হাসারাঙ্গা ২/৩২, ধনঞ্জয়া ১/১১)
ফলাফল - বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী
তীরে এসে তরী বাংলাদেশের বহুবার ডুবেছে, আজও সেরকমটাই হবে বলে মনে হচ্ছিল। তবে স্নায়ু ধরে রেখে মাহমুদউল্লাহ আরও একবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় ছিনিয়ে আনলেন। অল্প রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে হিমশিম খেতে থাকা বাংলাদেশের ম্যাচটা বের হয়ে গিয়েছিল তাওহিদ হৃদয়ের তিন বলের ঝড় আর লিটন দাসের দায়িত্বশীল ইনিংসেই। তবে নুয়ান থুসারা আবারও বাংলাদেশের যমদুত রূপে আবির্ভূত হলে মাহমুদউল্লাহকেই টানতে হয় তুলির শেষ আঁচড়; সুপার এইটের সম্ভাবানা বাড়িয়ে বাংলাদেশ তাই এবারের আসর শুরু করল জয় দিয়ে।
১২৫ রানের লক্ষ্যে বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল ভয়াবহ। দুই বাঁহাতি ওপেনারের বিপক্ষে ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে দিয়ে শুরু করানোর ফন্দি এঁটে শুরুতেই সফল শ্রীলঙ্কা। অদ্ভুত এক শটে মিড অনে ক্যাচ অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়ে রানের খাতা খোলার আগেই ফেরেন সৌম্য সরকার। অবশ্য এরপর তানজিদ হাসান তামিমকে যেই ইনসুইঙ্গারে বোল্ড করলেন থুসারা তার জবাব হয়ত অন্য আরেক দিনেও দিতে পারতেন না এই ওপেনার। বাংলাদেশের বিপদ বাড়িয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন শট খেলে ১৩ বলে ৭ রান শেষে বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ফেরেন থুসারার দ্বিতীয় শিকার হয়ে। পাওয়ারপ্লেতে মাত্র ৩৪ রান তুলতেই তাই বিপদে বাংলাদেশ।
সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতেই রয়েসয়ে খেলেন লিটন-হৃদয়। বল বুঝে বাউন্ডারি বের করার পাশাপাশি প্রান্ত বদলেই মনোযোগ দেন দুজন। তবে হাসারাঙ্গার করা ১২-তম ওভারে যেন হুট করেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন হৃদয়। ম্যাচে ততক্ষণে ধাক্কা সামলে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টির দ্বিতীয় সেরা অল রাউন্ডারকে তখন টানা দুই স্লগ সুইপে ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে আছড়ে ফেললেন হৃদয়। প্রায় একই জায়গায় পড়া পরের বলটা এবার জাগিয়ে বানিয়ে তুলে মারলেন লং অফের ওপর দিয়ে। টানা তিন ছয়ে ওখানেই যেন ম্যাচের ভাগ্য লিখে ফেললেন হৃদয়। পরের বলটা মিডল স্টাম্পের ওপর ক্লাসিক লেগ ব্রেক দিয়ে হৃদয়কে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন হাসারাঙ্গা। তবে ২০ বলে ৪০ রানে কাজটা সেখানে যে সেরে ফেলেছেন হৃদয়, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছিল হাসারাঙ্গার শান্ত উদযাপনে।
তবে শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক সেখানে যেন বিপদ ঘটানোর ঘ্রাণও পাচ্ছিলেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চতুর্থ বা তার নিচের যেকোনো উইকেটেই ৬৪ রানের জুটিটা বাংলাদেশের সেরা; সেই জুটি ভাঙ্গায় বাংলাদেশ যে আবার হেলে পড়তে পারে সেটার সুযোগ নিতেই ওঁত পেতে ছিলেন তিনি। লিটনকেও নিজের স্পেলের শেষ ওভারে ৩৮ বলে ৩৬ রান শেষে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেললে রাস্তাটা খুলে যায় লঙ্কানদের জন্য। সেই রাস্তায় হেঁটে থুসারা এরপর আবারও বাংলাদেশের নাকের জল, চোখের জল এক করে ছাড়ছিলেন প্রায়। পাথিরানার বাউন্সারে এর আগে থার্ড ম্যানে থিকশানার দুর্দান্ত ক্যাচের শিকার হয়ে সাকিব ১৪ বলে ৮ রান শেষে ফিরলে এরপর টানা দুই বলে রিশাদ ও তাসকিনকে ফেরান থুসারা। চার উইকেট শিকারি দারুণ সেই স্পেলে থুসারা গোনেন মোটে ১৭ রান। পরের ওভারটা ম্যাথিউজ বা শানাকার কাউকে দিতে হত লঙ্কান অধিনায়ককে। এর আগের দিন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অসাধারণ বল করা শানাকার ওপরেই আস্থা রাখলেন হাসারাঙ্গা, তবে তাতেই বিধিবাম। প্রথম বলটাতেই ফুল টস দিলে শান্তভাবে স্কয়্যার লেগ দিয়ে তা মাঠছাড়া করলেন মাহমুদউল্লাহ। তানজিম সাকিবকে সঙ্গী করে বাকি পথটুকু অভিজ্ঞতার সাথে সামলে ১৩ বলে ১৬* রানের ইনিংসে ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন মাহমুদউল্লাহ।
এর আগে টসে জিতে বোলিং নিয়ে বাংলাদেশের শুরুটা যেন ঠিক মনমত হয়নি। পিচ থেকে পেসাররা সাহায্য পাবে এমনটাই কারণ দেখিয়েও দ্বিতীয় ওভারেই সাকিবকে আক্রমণে আনলেন শান্ত। ফাটকাটা কাজে না লাগলে পরের ওভারে তাসকিনকে আনা হলে তাকে টানা দুই বাউন্ডারিতে স্বাগত জানান কুশল। অবশ্য পরের বলটাই স্টাম্পে ডেকে এনে থামেন তিনি। পরের ওভারে সাকিবকে চার বাউন্ডারি মেরে অবশ্য নিসাঙ্কা বুঝিয়ে দেন শান্তর এই পরিকল্পনা কাজে লাগবে না। বিকল্প খুঁজতে পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে মোস্তাফিজকে ডাকা হলে প্রথম বলেই তিনি ফেরান কামিন্দু মেন্ডিসকে। তবে পাওয়ারপ্লেতে ৫৩ রান তুলে ফেলে যেন ছুটছিল শ্রীলঙ্কা।
সেখান থেকেই ম্যাচে ধীরে ধীরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে বাংলাদেশ। মোস্তাফিজের স্লোয়ার পড়তে না পেরে নিসাঙ্কা আকাশে বল ভাসিয়ে যখন ২৮ বলে ৪৭ রানে থামলেন সেখান থেকেই পড়তে শুরু করে শ্রীলঙ্কার রান রেট। সুযোগ বুঝে লঙ্কানদের ওপর চড়ে বসেন রিশাদ। গতির তারতম্যে শ্রীলঙ্কা ব্যাটারদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখে ১৫-তম ওভারে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন। লেগ স্পিনারকে আক্রমণ করতে গিয়ে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়্যার লেগে ক্যাচ তুলে আসালাঙ্কা ফিরলে পরের বলেই হাসারাঙ্গাকে স্লিপের ফাঁদে ফেলেন রিশাদ। রিশাদের দারুণ সেই ওভারের পরিক্রমায় ম্যাচে ফিরতে শুরু করে বাংলাদেশ, রাস্তাটাও রিশাদ নিজেই তৈরি করেন নিজের স্পেলের শেষ ওভারে ২৬ বলে ২১ রানে থাকা ধনঞ্জয়াকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে।
তীক্ষ্ণ ঘূর্ণির জালে ফেলে রিশাদ যে বাংলাদেশকে ম্যাচে চালকের আসনে বসালেন সেখান থেকে আর কর্তৃত্ব হারায়নি তারা। শান্তর সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করতেই আক্রমণে ফিরে তাসকিন হাত খোলার সুযোগ না দিয়ে থামিয়েছিলেন শানাকাকে। ১৯তম ওভার করতে এসে মোস্তাফিজ পরে জ্বলে উঠেছেন আরেকবার; ফিরিয়েছিলেন থিকশানাকে। দুর্দান্ত এক স্পেলে ফর্ম ধরে রেখে রানও দিয়েছিলেন মোটে ১৭। শেষ ওভার করতে এসে তরুণ তানজিম সাকিবও স্নায়ু ধরে রেখে ১৬ রানে থাকা ম্যাথিউজকে থামালে ১০০/৩ থেকে ১২৪ রানে আটকে যায় শ্রীলঙ্কা। সেই রান তাড়া করতে খাবি খেলেও গুরুত্বপূর্ণ জয়ে শ্রীলঙ্কাকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশ।