• টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
  • " />

     

    পরিকল্পনা, ইন্টেন্ট, এবং কিছু উত্তরহীন প্রশ্ন

    পরিকল্পনা, ইন্টেন্ট, এবং কিছু উত্তরহীন প্রশ্ন    

    "পরিকল্পনাটা এমন ছিল যে আমরা প্রথম ৬ ওভার চেষ্টা করব। পরিকল্পনা ছিল, যদি আমরা ভালো শুরু করি, দ্রুত উইকেট যদি না পড়ে, তাহলে আমরা সুযোগটা নেব। কিন্তু যখন আমাদের দ্রুত ৩ উইকেট পড়ে গেল, তখন আমাদের পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল- যেন আমরা ম্যাচটা জিততে পারি। তারপরও আমি বলব, মিডল অর্ডার ভালো সিদ্ধান্ত নেয়নি। যার কারণে ম্যাচটা আমরা হেরে গেছি।"

    আফগানিস্তানের বিপক্ষে পরাজয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। কিন্তু তাঁর কথার সাথে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ইন্টেন্টের পুরোপুরি মিল পাওয়া যাচ্ছে না। পরিকল্পনার বাস্তবায়নে একটা সমন্বয়হীনতার অস্তিত্বও ধরা দিতে পারে অনেকের চোখে। 

    ওভারপ্রতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক, বাংলাদেশ দলের পরিকল্পনা এবং ইন্টেন্টের মধ্যে আসলে কতটা মিল ছিল।

    বাংলাদেশের হয়ে ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে এসেছিলেন তানজীদ হাসান তামিম এবং লিটন দাস। নাভিন-উল-হকের করা প্রথম ওভারে লিটনের হাঁকানো চার এবং ছক্কায় বাংলাদেশ ভালো শুরু পায়। প্রথম ওভার থেকে সর্বমোট ১৩ রান আসে।

    ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই তানজিদকে ফিরিয়ে দেন ফারুকী; Image Source: Getty Images

    ফাজালহক ফারুকীর করা ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের তৃতীয় বলে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে শট খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হন তানজীদ, আর পরের ওভারে পরপর দুই বলে শান্ত আর সাকিবকে তুলে নেন নাভিন-উল-হক। ডানহাতি-বাঁহাতি সমন্বয় রক্ষার জন্য তাওহীদ হৃদয় তখনো মাঠে নামার সুযোগ পাননি, তাঁকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে নামানো হয় সৌম্য সরকারকে। এদিকে তিন ওভার শেষে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৩ উইকেট হারিয়ে ২৪।

    সাকিব আউট হয়ে যান মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই; Image Source: Getty Images

    শান্তর কথা অনুসারে, বাংলাদেশ দলের পরিকল্পনা পরিবর্তিত হয় এই সময়েই। সেমিফাইনালে কোয়ালিফাই নয়, বরং ম্যাচ জয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। তবে মাঠের খেলায় কি সেই পরিকল্পনার ছাপ ছিল?

    চতুর্থ ওভারে বোলিংয়ে আসেন ওই ফারুকীই। একটা ওয়াইডের পর তাঁর করা প্রথম বৈধ বলটাই বাউন্ডারি ছাড়া করেন সৌম্য, পরের বলে আসে কুইক সিঙ্গেল। এরপর একটা ওয়াইড বল করেন ফারুকী, আর তখনই বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সংগ্রহ তখন ৩.২ ওভার শেষে ৩ উইকেট হারিয়ে ৩১।

    বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ থাকাকালীন স্বাভাবিকভাবেই দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান লিটন-সৌম্যকে দলের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেওয়ার কথা টিম ম্যানেজমেন্টের। সেই হিসেবে, পরের ৮৫ রান করতে সেমিফাইনালের জন্য বেঁধে দেওয়া ৫৩ বল নয়, বরং বাড়তি ঝুঁকি না নিয়ে বাংলাদেশের ব্যবহার করার কথা বাকি ১০০টা বলই। কিন্তু লিটন-সৌম্য কী করলেন?

    ফারুকীর অসমাপ্ত ওভারের বাকি চার বল থেকে সিঙ্গেলস-ডাবলসে পাঁচটি রান তুলে নেন লিটন-সৌম্য। অপর প্রান্ত থেকে পরের ওভারে বোলিংটা চালিয়ে যান ইতোমধ্যে দুই উইকেট পাওয়া নাভিন-উল-হক। সেই ওভারের প্রথম বলে লিটন ডিফেন্সিভ শটই খেলেন। তবে পরের চারটা বলেই বাউন্ডারির চেষ্টা করেছিলেন তিনি। একটা চার পেয়েছিলেন, একটা বল ভারী আউটফিল্ডের কারণে বাউন্ডারি অবধি পৌঁছেনি, আর দুটো ক্ষেত্রে পারেননি ব্যাটে-বলে করতে। শেষ বলে সিঙ্গেল নেন লিটন।

    ষষ্ঠ ওভারে প্রথমবারের মতো বোলিংয়ে আসেন মোহাম্মদ নবী। প্রথম বলে লিটন ডিফেন্স করেন, দ্বিতীয় বলে নেন কুইক সিঙ্গেল। তৃতীয় বলে রিভার্স সুইপের চেষ্টা করেন সৌম্য, তবে ব্যর্থ হন। চতুর্থ বলে নেন কুইক সিঙ্গেল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ বলে বড় শট খেলার চেষ্টা করেন লিটন-সৌম্য, লিটন সিঙ্গেল পেলেও সৌম্য ব্যাট-বলের সংযোগ ঘটাতে ব্যর্থ হন। সেমিতে যেতে বাংলাদেশের তখন প্রয়োজন ৩৭ বলে ৭০ রান।

    মোহাম্মদ নবীর বিপক্ষে রিভার্স সুইপ খেলছেন সৌম্য সরকার; Image Source: Getty Images

    সপ্তম ওভারে বোলিংয়ে এলেন রশিদ খান। প্রথম বলে লিটনের সিঙ্গেল, এরপরের বল গ্লান্স করতে গিয়ে সৌম্যের ডট। এরপর একটা ওয়াইড করেন রশিদ, আর তৃতীয় বৈধ বলেই সৌম্য হয়ে যান বোল্ড। নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে আসেন তাওহীদ হৃদয়। ওভারের বাকি তিন বলে ঝুঁকিহীন তিনটা সিঙ্গেল নেন লিটন-হৃদয়। বাংলাদেশের তখন দরকার ৩১ বলে ৬৫। খুবই সম্ভব, এবং বাংলাদেশের তখন সেই ইন্টেন্টও দৃশ্যমান!

    অষ্টম ওভারটা করতে এলেন মোহাম্মদ নবী। প্রথম দুটো বলে ডিফেন্সিভ শট খেলে ডট দেন হৃদয়। তৃতীয় বলে তাঁর লফটেড পুল খেলার চেষ্টায় টপ এজ হলো। কিন্তু শর্ট ফাইন লেগের ফিল্ডার ফারুকী ক্যাচটা ফেলে দিলেন, আর হৃদয় পেলেন দুটো রান। পরের দুই বলে আবারও আক্রমণাত্মক হৃদয়, পেলেন দুই চার। একটা পুল খেলতে গিয়ে টপ এজ থেকে, আরেকটা স্লগ সুইপে। ওভারের শেষ বলে ওয়াইড লং অনে বল ঠেলে দুই রান পেলেন হৃদয়। বাংলাদেশের দরকার আর ২৫ বলে ৫৩। হৃদয়ের ইন্টেন্টেও তখন জয়ের ইচ্ছা স্পষ্ট।

    মাঠেই নেমেই ইন্টেন্ট দেখিয়েছিলেন তাওহীদ হৃদয়; Image Source: Getty Images

    নবম ওভারে এলেন অধিনায়ক রশিদ। প্রথম বলে সুইপ করতে গিয়ে লেগবাই সূত্রে রান এলো লিটনের কাছ থেকে। তবে দ্বিতীয় বলে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বল হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন তাওহীদ হৃদয়। বাতাসের দিকেই শটটা খেলেছিলেন, তবে বাতাস বলটাকে ভাসিয়ে নিতে পারলো শুধুই ডিপ মিডউইকেটের ফিল্ডার অবধি। নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে এলেন মাহমুদউল্লাহ, নিজের মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলটাই আলতো করে পয়েন্টে ঠেলে সিঙ্গেল নিলেন তিনি। পরের বলে ব্যাকফুটে গিয়ে কাট করতে গিয়ে মিস করলেন লিটন দাস। তবে ওভারের শেষ দুই বলে ঠিকই দুটো বাউন্ডারি তুলে নেন তিনি। একটা ডাউন দ্যা উইকেটে গিয়ে, আরেকটা থার্ড ম্যানে গাইড করে। ১৯ বলে বাংলাদেশের দরকার ৪৩। কঠিন, তবে অসম্ভব তো নয়!

    রানের চাকা সচল রাখেন লিটন দাস; Image Source: Getty Images

    পরের ওভারের এলেন বাঁহাতি চায়নাম্যান নূর আহমেদ, যে ওভারটা নিয়েই যত কথা। প্রথম বলে মাহমুদউল্লাহ চেয়েছিলেন অনসাইডে পুশ করতে, কিন্তু টার্নে পরাস্ত হন। দ্বিতীয় বলটা আলতো করে পুশ করেন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে, আর তৃতীয় বলটা অনসাইডে। টানা তিনটা ডটের পর যেন হুঁশ ফেরে তাঁর, পরের বলে রুম করে কাভার দিয়ে বাউন্ডারি তুলে নেন। কিন্তু শেষ দুই বলে আবার আগের চিত্র। পঞ্চম বলে আলতো করে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে পুশ, শেষ বলে লিডিং এজ হয়ে শর্ট কাভারে। ছয় বলের মধ্যে পাঁচটাই ডট, বাকি ১৩ বলে ৩৯ রান তখন প্রায় অসম্ভব লক্ষ্য। অবশ্য লক্ষ্যে পৌঁছানোর ইচ্ছা থাকলে না সম্ভব-অসম্ভবের প্রশ্ন আসবে!

    প্রশ্নবিদ্ধ ইন্টেন্টে ব্যাটিং করেছেন মাহমুদউল্লাহ; Image Source: Getty Images 

    একাদশতম ওভারে বোলিংয়ে এলেন রশিদ খান। তাঁর করা প্রথম চার বলে তিনটা ঝুঁকিহীন সিঙ্গেল পান লিটন-মাহমুদউল্লাহ। ওভারের পঞ্চম বলে প্রথমবারের মতো বড় শট খেলতে যান মাহমুদউল্লাহ, তবে ইনসাইড এজ হয়ে কিপারের তালুবন্দী হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় তাঁকে। শেষ বলে রিশাদের স্লগ সুইপের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় রশিদের গুগলি। বোল্ড হয় ফিরতে হয় রিশাদকেও।

    প্রথম বলেই স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হন রিশাদ হোসেন; Image Source: Getty Images

    পরের গল্পটা সবারই জানা।

    সম্ভাবনা আর ‘সম্ভব না’-এর দোলাচলের পর বাংলাদেশের এই পরাজয় দেখে প্রশ্নটা তাই উঠেই যায়, বাংলাদেশ দল আসলে ঠিক কী পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিল? অধিনায়ক শান্তর বক্তব্য অনুসারে যদি পাওয়ারপ্লেতে তিন উইকেট পড়ার পরই বাংলাদেশ তাদের সেমিফাইনালে কোয়ালিফাই করার পরিকল্পনা বদলে ম্যাচ জিততে চায়, তবে ‘অযথা’ ঝুঁকি নিয়ে কেন আউট হলেন হৃদয়-রিশাদ? কেন ঝুঁকি নিয়ে রিভার্স সুইপ বা স্লগ সুইপ খেলতে চাইলেন সৌম্য, কেন রশিদকে ‘অহেতুক’ ছক্কা মারতে গিয়ে বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিলেন হৃদয়, কেন-ই বা মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই রশিদকে স্লগ সুইপের চিন্তা এলো রিশাদের মাথায়? লিটন-সৌম্য-হৃদয়রা কি পারতেন না ঝুঁকিহীন সিঙ্গেলস নিয়ে ছয়ের নিচে থাকা আস্কিং রানরেটের এই ম্যাচটা জিতিয়ে ফিরতে? কেন এই সমন্বয়হীনতা?

    আফগান শিবিরে উৎসব আর বাংলাদেশের হতাশা; Image Source: Getty Images

    আর মাহমুদউল্লাহর ওপর যদি ঝুঁকিহীন ব্যাটিংয়ের নির্দেশনাই থাকবে, তিনিই বা খেলাটা শেষ করে আসতে পারলেন না কেন? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কেন জয়ের চেষ্টা করবে না বাংলাদেশ? একটা অর্থহীন জয় দিয়ে মুখ রক্ষার আশায় কেন পায়ে ঠেলা হবে বিশ্ব আসরের সেমিফাইনালের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে?

    এসব প্রশ্নের হয়তো কোন উত্তর পাওয়া যাবে না, যায় না। দিনশেষে তাই আরো একবার রাজ্যের বিরক্তি আর অবহেলার সাথে এক বুক হতাশাই তৈরি হবে সমর্থকদের হৃদয়ে। আর কেন-ই বা হবে না!

    সামর্থ্যের ঘাটতি তবুও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু মানসিক দৈন্যতা কি মেনে নেওয়া সম্ভব?