• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    মেসির আর্জেন্টিনার একগাদা কুসংস্কারের গল্প

    মেসির আর্জেন্টিনার একগাদা কুসংস্কারের গল্প    

    ২০১৮ বিশ্বকাপ। আর্জেন্টিনা দলের ঘোর দুঃসময় তখন, গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ার শঙ্কাটা ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। এমনই একদিন মিক্সড জোনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন অধিনায়ক লিওনেল মেসি। একজন সাংবাদিক তখনই একটা লাল সুতো এগিয়ে দিলেন মেসির দিকে। 

    “লিও, আমার মা তোমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে আমার কাছে তাঁর দেওয়া একটা লাল সুতো আছে। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে এটা দিতে পারি।”

    “হ্যাঁ, অবশ্যই।”

    “এটা আমার মায়ের পক্ষ থেকে উপহার। এটিকে সাবধানে রেখো।”

    নাইজেরিয়ার বিপক্ষে বাঁচামরার ম্যাচে ২-১ ব্যবধানে জয়ের পরে ওই সাংবাদিকের সাথে আবারও দেখা হয়েছিল মেসির। সেই লাল সুতোটার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই মেসি হাসলেন, এরপর বাঁ পায়ের মোজা সরিয়ে দেখালেন, তাঁর পায়ে বাঁধা আছে সেই সৌভাগ্যের প্রতীক, সেই লাল সুতোটা।

    ২০১৮ বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে পায়ে লাল সুতো বেঁধে খেলেছিলেন মেসি; Image Source: Twitter

    ব্যাপারটাকে মেসির বিনয় ও মহত্ব হিসেবে দেখতে পারেন, আবার আর্জেন্টিনার দলে বিদ্যমান কুসংস্কার হিসেবেও দেখতে পারেন।

    ওই লাল সুতোটা এরপর হাতবদল হয়েছে অনেকবার। ২০১৮-১৯ মৌসুমে বার্সেলোনার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ফিলিপে কৌতিনহোর হাতে দেখা গেছে সেটা। ২০১৯ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে যখন নিজের প্রথম গোল পেলেন পাওলো দিবালা, তাঁর হাতেও দেখা গেছে সুতোটা। লাউতারো মার্তিনেজ আর রদ্রিগো ডি পলের হাতেও বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে সুতোটা। বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে টাইব্রেকারে শট সেভ করার পরে এমিলিয়ানো মার্তিনেজের হাতেও দেখা গেছে সেই লাল সুতো, ড্রেসিংরুমে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ উদযাপনের সময়েও দেখা গেছে সেটা।

    বিভিন্ন সময়ে মেসি তাঁর লাল সুতো সতীর্থদের দিয়েছিলেন তাঁদের খারাপ সময় কাটানোর জন্য; Image Source: Getty Images

    ফুটবল দলগুলোর ক্ষেত্রে এই সংস্কারের ব্যাপারগুলো নতুন না। বিশেষ করে আফ্রিকান দলগুলোর মধ্যে কুসংস্কারের প্রভাব অনেক বেশি। তবে পাদপ্রদীপের আলোটা আর্জেন্টিনার ওপরে বেশি থাকে বলে তাদের সংস্কারের গল্পগুলোও বেশি আলো পায়।

    আর্জেন্টাইন ম্যানেজার লিওনেল স্কালোনিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁর নিজের সংস্কারের ব্যাপারে। স্কালোনিও স্বীকার করে নিয়েছেন অকপটে, সবসময়ে ডান পা ফিয়ে মাঠে ঢোকেন তিনি। “আমি ছোটবেলা থেকেই এটা করে আসছি, যেদিন থেকে আমি ফুটবল খেলছি। আর আমি এটা চালিয়েই যাবো,” স্কালোনি বলেন, “তাতে ম্যাচের ফলাফল যাই হোক না কেন।”

    পছন্দের পা বাড়িয়ে মাঠে ঢোকার ব্যাপারটা অনেকেই পালন করে থাকেন, এবং ব্যাপারটা ততটা ‘পাগলাটে’-ও নয়। তবে ২০২২ সালে আর্জেন্টাইন কোপা দে লা লিগার সেমিফাইনালে যেটা ঘটলো, সেটাকে যে কেউই ‘পাগলাটে’ বলবেন। বোকা জুনিয়র্স এবং রেসিং দে আভেয়ান্দার মধ্যকার ওই ম্যাচে এক রেসিং সমর্থক তাঁর দাদার মাথার খুলি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন খেলা দেখার জন্য। কেন? তাঁর দাদা ছিলেন রেসিংয়ের পাঁড় সমর্থক। দাদা পরলোকগমন করেছেন তো কী হয়েছে, দলের অমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটা তো তিনি দেখতে চাইবেনই! 

    দাদার মাথার খুলি নিয়ে মাঠে আসেন এই রেসিং সমর্থক; Image Source: SC_ESPN/Twitter

    “আমার দাদা ভ্যালেন্টিন আগুয়িলেরা আমৃত্যু রেসিং সমর্থক ছিলেন,” গ্যাব্রিয়েল আরান্দা নামের ওই দর্শক বলেন, “আমি আমার দাদার খুলিটা রেখে দিয়েছি। দাদার মতো আমিও রেসিংকে ভালোবাসি, আর খেলা দেখতে যাওয়ার সময়ে দাদাকে সঙ্গে নিয়ে যাই।”

    ২০১৯ সালে রেসিংয়ের শিরোপা উদযাপনে অংশগ্রহণের জন্য দাদার কবর থেকে তাঁর খুলিটা সরিয়ে নিয়েছিলেন আরান্দা। আর খুলি সরানোর এই ব্যাপারটা রেসিংয়ের জন্যও সৌভাগ্য বয়ে আনে, এমনটাই দাবি করেন তিনি।

    আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কুসংস্কারগুলো অবশ্য এমন ‘পাগলাটে’ পর্যায়ে যায় না, তবে টুকটাক কিছু সংস্কার পালিত হয়ে আসছে ২০২১ সাল থেকেই। মারাকানায় কোপা আমেরিকার ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ)-এর সভাপতি ক্লদিও তাপিয়া এবং মিডফিল্ডার রদ্রিগো ডি পলের সাথে একটা ছবি তুলেছিলেন লিওনেল মেসি। পরের দিনই ব্রাজিলকে ১-০ ব্যবধানে পরাজিত করে শিরোপাখরা কাটিয়ে ফেলে আর্জেন্টিনা, সাথে সাথে শুরু হয় এক নতুন প্রথার।

    রদ্রিগো ডি পল, লিওনেল মেসি আর ক্লদিও তাপিয়ার এই ছবিটা আর্জেন্টিনার রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন; Image Source: Twitter

    এরপর থেকে প্রতিটা ফাইনালের আগেই ওই একই ভঙ্গিতে ছবি তুলতে শুরু করেন মেসি-ডি পল-তাপিয়া। ২০২২ সালের জুনে ইতালির বিপক্ষে ফিনালিসিমার আগে, ডিসেম্বরে ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালের আগেও একই ভঙ্গিতে ছবি তোলেন তাঁরা। এমনকি চলতি কোপা আমেরিকা শুরুর আগেও তাঁরা ছবি তুলেছিলেন একই পোজ দিয়ে।

    “বল যেখানে, ডি পল সেখানে” এমন একটা কথা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মধ্যে প্রচলিত আছে। বল তাড়ার মতো কুসংস্কার পালনেও রদ্রিগো ডি পল অগ্রগামী। ২০২১ কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনা দলের তিন মিডফিল্ডার রদ্রিগো ডি পল, লিয়ান্দ্রো পারেদেস এবং আলেহান্দ্রো ‘পাপু’ গোমেজ ক্যারামেল ক্যান্ডি খেয়েছিলেন। আর্জেন্টিনা ওই ম্যাচটা জিতে যাওয়ায় দলীয় সংস্কারের খাতায় যোগ হয় এই ক্যান্ডি খাওয়ার ব্যাপারটাও।

    ২০২১ কোপা আমেরিকার সময়ে সারা বিশ্বেই কোভিড-১৯ এর বেশ বিস্তার ছিল। দক্ষিণ আমেরিকাও এর বাইরে নয়। আর্জেন্টিনা দল তাই ক্যাম্প করেছিল বুয়েনস আইরেসেই, আর শুধু ম্যাচের দিনেই ব্রাজিলে ভ্রমণ করতো দলটি। তাই বাইরে থেকে ক্যাম্পে কোন কিছু আনা বা যোগ করার ক্ষেত্রে একটা বিধিনিষেধ ছিল। এমন সময়ে দলের সাহায্যে এগিয়ে এলেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। তাঁর কাছে থাকা ক্যারামেল ক্যান্ডি দিয়েই ‘সংস্কার’ পালন করতে থাকে আর্জেন্টিনা দল। তবে পরবর্তীতে আর্জেন্টাইন স্টাফরা আরো ক্যারামেল ক্যান্ডি জোগাড় করে মার্তিনেজকে দায়মুক্ত করেন।

    এমি মার্টিনেজও সংস্কারের বাইরে নন; Image Source: Getty Images

    ম্যাচ-পূর্ববর্তী ওয়ার্ম-আপের আগে রদ্রিগো ডি পল এবং লিয়ান্দ্রো পারেদেস তাঁদের জাতীয় দলের টি-শার্ট গায়ে ক্যান্ডি খেতে খেতে মাঠের মাঝে দুলকি চালে হাঁটেন। কাতার বিশ্বকাপেও অব্যাহত ছিল এই দলীয় সংস্কার, আর তাতে ক্যান্ডির বিশাল এক বহর পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন এমি মার্তিনেজের ভাই। কিন্তু তবুও, প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হেরে বসে আর্জেন্টিনা। যদিও আর্জেন্টাইনরা তাদের সংস্কার থেকে সরেননি।

    চলতি কোপা আমেরিকার প্রথম ম্যাচে কানাডার বিপক্ষে ম্যাচের আগেও পারেদেস আর ডি পলকে দেখা গেছে ক্যান্ডি খেতে খেতে মার্সিডিজ-বেঞ্জ স্টেডিয়ামে হাঁটতে। আর্জেন্টিনাও ওই ম্যাচটা জেতে ২-০ ব্যবধানে।

    ম্যাচের আগে ক্যান্ডি খেতেই হবে ডি পল-পারেদেসকে; Image Source: Getty Images

    “যাই হোক না কেন, ম্যাচের আগে ক্যান্ডি খেতে খেতে মাঠে আমাদের হাঁটা চাই-ই চাই,” আর্জেন্টাইন ব্রডকাস্টিং চ্যানেল টিওয়াসি স্পোর্টসকে বলেন রদ্রিগো ডি পল, “ক্যারামেল ক্যান্ডির ব্যাপারটা সবাই জানে। আর আমার কাছে এটা সবচেয়ে জরুরী।”

    এএফএ-এর সভাপতি ক্লদিও তাপিয়া নিজেও কিছু কুসংস্কার পালন করেন। ১৬ জুন এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে তাপিয়াকে দেখা গেছে একটা হোটেল কক্ষে তিনজন আর্জেন্টাইন স্টাফ এবং মিডফিল্ডার এজেকিয়েল পালাসিওসের সাথে। ছবিটার ব্যাকগ্রাউন্ডে, বিছানার ওপরে একটা ‘চাকি’ পুতুল দেখা যাচ্ছিল। কুসংস্কারের অংশ হিসেবে এই পুতুলটাও আর্জেন্টিনা দলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে ২০২১ সাল থেকেই।

    তবে শুরুতে এই পুতুলটাকে ‘দুর্ভাগ্যের প্রতীক’ হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন তাপিয়া। দলের ড্রেসিংরুমে এমন একটা পুতুলের উপস্থিতি ভালোভাবে নেননি তিনি, “আমি ড্রেসিংরুমে ঢুকেই ওই পুতুলটাকে দেখতে পাই। পুতুলটার এক হাত আর এক পা ছিল না। আমি জানতে চেয়েছিলাম যে এই পুতুলটা কে নিয়ে এসেছে, কেননা এই পুতুলটা দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে।”

    আর্জেন্টিনা দলের সাথে ওই 'চাকি' পুতুল; Image Source: Instagram

    তখন এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে আসে ড্রেসিংরুমে। এরপর কিটম্যান হুয়ান ক্রুজ বলেন, তাঁর ছেলে, যার ডাকনাম ‘চাকি’, ২০২১ কোপা আমেরিকার আগে এই পুতুলটা দিয়েছিল তাঁকে। এরপর থেকে সেটা রয়েছে দলের সাথে। তাপিয়ার চিন্তাটাও নেমে যায় তখন, আর পুতুলটাও থেকে যায় দলের সাথে। ফিনালিসিমার পরও ওই ‘চাকি’ পুতুলের উপস্থিতি দেখা গেছে আর্জেন্টিনার ড্রেসিংরুমে।

    লিওনেল মেসি নিজেও এসব কুসংস্কার থেকে মুক্ত নন। ২০২২ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সময়ে থেকেই মেসির রুমে, তিনি আর ডি পল ঠিক সকাল সাড়ে নয়টায় ‘মাতে’ নামক পানীয় পান করা শুরু করেন। একদিন ডি পলের আসতে দেরি হয়ে যায়, সাড়ে নয়টার পরিবর্তে দশটায় হাজির হন ডি পল। আর রুমে ঢুকেই অধিনায়কের রাগান্বিত মুখটা চোখে পড়ে ডি পলের।

    “৯:১৫, ৯:২০ বা ৯:৫০ নয়, ঠিক সাড়ে নয়টা,” ২০২২ সালে ডি পল বলেছিলেন, “একদিন ঘুমিয়ে থাকার কারণে আমার দেরি হয়ে যায়। আমি দশটার সময়ে মেসির রুমে যাই। তখন যদি তাঁর মুখটা আপনি দেখতেন…”

    বিশ্বকাপ চলাকালীন মেসি নিজেও মানসিকভাবে বেশ চাপে ছিলেন। চাপমুক্ত হওয়ার জন্য ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালের আগের রাতে তিনি রুমে ডেকে নেন পুরোনো বন্ধু সার্জিও আগুয়েরোকে। স্কোয়াডের অংশ না হলেও দলের সাথেই কাতারে ছিলেন আগুয়েরো। তাই নিজের মানসিক চাপ কমা, সাথে একটু সৌভাগ্যের জন্য দীর্ঘদিনের রুমমেটকে ডেকে নিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। আর এরপরের ঘটনা তো সবারই জানা।

    বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে মেসি, আর মেসির পায়ে লাল সুতো; Image Source: Twitter 

    তবে দিনশেষে, বিশ্বাস-অবিশ্বাস যার যার ব্যক্তিগত জায়গা। বিভিন্ন সংস্কার বা কুসংস্কার মূলত এই বিশ্বাসের পালেই হাওয়া দেয়। মাঠের পারফরম্যান্সেও অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে মাঠের বাইরের এই বিশ্বাসগুলো। অনেকের চোখে আর্জেন্টিনা দল হয়তো মাঠের যোগ্যতম দল হিসেবেই জিতেছে কোপা-ফিনালিসিমা-বিশ্বকাপ, তবে আর্জেন্টাইনদের জিজ্ঞেস করলে হয়তো এই ছোট ছোট সংস্কারের ভূমিকার উল্লেখও পাওয়া যাবে।