মুদ্রার দুই পিঠ: রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে আয়োজকদের প্রস্থান, রোনালদোদের ম্যাড়ম্যাড়ে বিদায়
ইউরোর মঞ্চে রাতটা যে রোনালদোর জন্য শেষ হতে পারে সেই সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই নেমেছিল পর্তুগাল। ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচটা অবশ্য যেখানে উত্তেজনায় ঠাঁসা হওয়ার কথা ছিল সেখানে দুই দলই ম্যাড়ম্যাড়ে এক ম্যাচ খেলে গেল। রোনালদোর বিদায়টাও হল নিষ্প্রভ। রোনালদোর ৪১ বছর বয়সী সতীর্থ পেপেও ইউরো থেকে বিদায় নিলেন চুপিসারেই, অশ্রুসজল চোখে। তবে এই বয়সেও পেপে দেখিয়েছেন ফ্রান্সের দ্রুতগতির খেলোয়াড়দেরও তিনি ভালোই সামলাতে পারেন। অন্যদিকে পর্তুগালের মতো বিদায় হয়নি, আয়োজক জার্মানির বিদায়টা বরং বুলডোজারের মতোই যেন মিশিয়ে দিয়েছে দেশের মানুষদের। এই হাসি, এই কান্নার ম্যাচে জার্মানদের আরও একবার বুক ভেঙেছে দেশের মাটিতে। তবে নিরপেক্ষ দর্শকরা যেন আসলেই ফাইনালের আগে আরেক ফাইনাল দেখে ফেলল স্পেন-জার্মানির সুবাদে।
সেই ১৯৮৮ সালে প্রতিযোগিতায় শেষ স্পেনকে হারিয়েছিল জার্মানি। দেশের মাটিতে খেলা বলে এবার হয়ত সেই ফাঁড়া কাটবে বলেই আশা ছিল তাদের। তবে কাজটা তো নেহায়েত সহজ হবে না সেটাও জানতো তারা। তর্কসাপেক্ষে আসরের সবচেয়ে বড় শিরোপার দাবিদার স্পেনের তরুণ তুর্কিরা ফর্মের তুঙ্গে। লামিন ইয়ামাল-নিকো উইলিয়ামস যেন দুই উইংয়ে ত্রাস। গত ম্যাচেও তার ব্যত্যয় ঘটল না। ইয়ামালকে সামলাতে রাউমকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে, হলুদ কার্ডও দেখেছেন পরে।
প্রথমার্ধ থেকেই ম্যাচে চরম উত্তেজনা। পেদ্রিকে দশ মিনিটেই মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন ক্রুস, অদ্ভুত এক তেড়ে আসা ফাউলে। ম্যাচে বেশ কয়েকটা বিপদজনক ফাউল করেও ক্রুস তার শেষ ম্যাচে পেয়েছেন মাত্র একটা হলুদ কার্ড। স্পেনকে গতির ব্যবহার করতে না দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নামা জার্মানি মিডফিল্ডে পুরো ম্যাচ জুড়েই এরকম আগ্রাসী ফুটবল খেলে গিয়েছে। স্পেন অবশ্য অবিচল থেকে মাঠ বাড়িয়ে খেলেছে অনায়াসেই। পেদ্রি উঠে দানি অলমো নামাটাও যেন শাপেবর হয়ে এসেছিল তাদের জন্য। বেশ কয়েকবার ডি বক্সে ঢুকে গিয়ে নয়্যারকে প্রশ্ন করেছিলেন অলমো, ইয়ামাল, নিকোরা।
প্রথমার্ধ গোলশূন্য সমতায় শেষ হলে দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য নড়েচড়ে বসে জার্মানি। যেহেতু জার্মানি মিডফিল্ড ধরে খেলার চেষ্টা করছিল, স্পেনও ততক্ষণে তাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই নাচোকে নামানো হলে দুই দিক থেকে কারভাহাল ও কুকুরেয়াও রক্ষণে আরও মাঝে এসে খেলা শুরু করলে মুসিয়ালা, হ্যাভার্টজরা একেবারেই সুবিধা করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে স্পেন তখন রদ্রিকে মাঝে স্থির রেখে মিডফিল্ডটাও ছড়িয়ে নিয়েছেন রুইজদের সামনে ঠেলে। সেই সুযোগ নিয়েই ডান প্রান্ত থেকে ইয়ামাল আবারও বক্সে ঢুকে পড়ে বক্সের ভেতর আগুয়ান অলমোকে খুঁজে নেন বুদ্ধিদীপ্ত এক পাসে। পাস থেকে সরাসরি মাটি কামড়ানো শটে।
গোল খেয়েই যেন বিকার হয় নাগেলসমানের। উইয়ারতজকে নামিয়ে গতি সঞ্চার করায় স্পেনের রক্ষণভাগ ঝামেলায় পড়ে। আন্দ্রিখকে নামিয়ে ক্রুসকে আরও গভীর থেকে মিডফিল্ডের দখল নেওয়ার সুবিধা দেওয়া হলে একের পর এক আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে জার্মানরা। বদলি হিসেবে নামা ফুলক্রুগ বেশ কয়েকটা সুযোগ পেয়েছিলেন, উনাই সিমোন বাধা হয়ে না দাঁড়ালে গোলও পেতে পারতেন, একবার তো উইয়ারতজের বাড়ানো পাস থেকে বল বারেও লাগালেন। তবে জার্মানদের অপেক্ষার প্রহরের অবসান ঘটে ওই উইয়ারতজের পা থেকেই। বাঁ প্রান্ত থেকে দূরের বারের উদ্দেশ্যে ক্রুস বল বাড়ালে অসাধারণ এক লাফে বল মাটিতে নামান কিমিখ। সেটা উইয়ারতজের পায়ে পড়তেই মাটিতে বাড়ি খাইয়ে জোরালো এক ভলিতে শেষ মুহূর্তে জার্মানদের ম্যাচে ফেরান এই তরুণ লেভারকুসেন খেলোয়াড়।
অতিরিক্ত সময়ে দুই দলই সুবিধা করতে পারছিল না। ম্যাচ মনে হচ্ছিল টাইব্রেকারেই গড়াবে। হঠাৎ করেই ম্যাচে আবির্ভাব মিডফিল্ডার মিকেল মেরিনোর। বাঁ প্রান্তে বল পেয়েই অলমো খেয়াল করলেন রুডিগার মেরিনোর চেয়ে বেশ এগিয়ে। দারুণ এক ক্রস সেখানে ভাসালে রুডিগারের মাথার ওপর দিয়েই বল খুঁজে নেয় মেরিনোর মাথায়। লাফিয়ে উঠে নিখুঁতভাবে মেরিনো বল জালে জড়ান। ম্যাচে অতিরিক্ত তিন মিনিট যোগ হলেও সেটাই যে স্পেনের সেমি নিশ্চিত করে ফেলেছে তা আঁচ করা যাচ্ছিল। তবে ম্যাচের একদম শেষ সংযোগে আবারও সুযোগ পেয়েছিলেন ফুলক্রুগ। প্রায় একই ভঙ্গিমায় তিনিও অনেকটা ফ্রি-হেডার পেলে মারেন বাইরে। স্পেন তাই ২-১ ব্যবধানে জিতে আবারও জার্মানদের কাঁদিয়ে সেমিতে।
কেঁদেছে এই রাতে পেপে-রোনালদোরাও। ম্যাচে অবশ্য হাসার মতো কোনো খেলাও খেলতে পারেননি তারা। ইউরোর ইতিহাসেই প্রথমার্ধে সবচেয়ে কম বল ছোঁয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড গড়েছিলেন রোনালদো (৯)। ফ্রান্সও পর্তুগিজদের বক্সেই ঢুকতে পারছিল না। পুরো সময়ে ঝলক দেখিয়েছেন শুধু রাফায়েল লিয়াও। কুন্ডেকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছেন গতি, স্কিলের প্রদর্শনীতে। তবে ভেতরে বল বাড়াতে পারেননি সেই অর্থে।
দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য উসমান ডেম্বেলে নামার পর ফ্রান্স কিছুটা ছন্দে ফিরেছিল। তবে শেষ বাধাটা পার হওয়া হয়ে উঠেনি কোনো দলেরই। খেলা টাইব্রেকারে গড়ালে দুই দলই দারুণ সব পেনাল্টি নিয়েছে। আগের দিনের নায়ক ডিয়োগো কস্তা তো শুরুই করেছিলেন বোকা বনে। বিপদ ঘটে পর্তুগালের তৃতীয় পেনাল্টিতে। মাইক ম্যানিয়ান ঠিক দিকে ঝাঁপ দিলেও জোয়াও ফেলিক্স বলটা তার নাগালের বাইরেই রেখেছিলেন। তবে বল একটু বেশিই বাইরে থেকে সেবার লাগে বারে। ওই পেনাল্টি মিস হওয়ার পর আর ফেরত আসতে পারেনি পর্তুগাল। থিও ফ্রান্সের শেষ পেনাল্টিটা জালে জড়ালে তাই ফ্রান্স চলে যায় সেমির পথে।