• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    এখনো ফুরিয়ে যাননি 'যাযাবর' হামেস

    এখনো ফুরিয়ে যাননি 'যাযাবর' হামেস    

    হাওয়ায় ভেসে আসা বলটাকে কাঁধ দিয়ে বক্সের বাইরে নামালেন তিনি। এরপরই দারুণ এক টার্ন নিলেন, বলটা মাটি ছোঁয়ার আগেই বাঁ পায়ের অসাধারণ ভলিতে পরাস্ত করলেন প্রতিপক্ষের গোলরক্ষককে। বিশ্বকাপের সেরা গোল দিয়েই বিশ্বমঞ্চে নিজেকে চেনালেন তিনি। তাঁর নাম হামেস রদ্রিগেজ।

    এরপর কেটে গেছে দশ বছর। দশ বছরে যেভাবে এগোনোর কথা ছিল হামেসের ক্লাব ক্যারিয়ারটা, তার প্রায় কিছুই হয়নি। কোন ক্লাবেই থিতু হতে পারেননি, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ঘুরেছেন কেবল, ধীরে ধীরে সরে গেছেন পাদপ্রদীপের আলো থেকে। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে হামেস এখনো খুবই কার্যকর। এতটাই, যে এবারের কোপা আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়ও হয়ে যেতে পারেন তিনি।

    যে গোলে বিশ্ব চিনেছিল হামেসকে; Image Source: Getty Images

    হামেসের ক্লাব ক্যারিয়ারটা নিয়েই কথা বলা যাক। ২০১৪ বিশ্বকাপের আগে হামেসকে খুব বেশি মানুষ চিনতেন না, হামেস নিজেও আর্জেন্টাইন ক্লাব ব্যানফিল্ড থেকে পর্তুগালের এফসি পোর্তো হয়ে এসেছেন ফরাসি ক্লাব মোনাকোতে। কিন্তু বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে, গোল্ডেন বুট জিতে নিয়ে সেই হামেসই চলে এলেন স্পটলাইটে। বিশ্বকাপের পর মোনাকো থেকে ৭৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান তিনি। কিন্তু বিশ্বকাপের ওই পারফরম্যান্সকে কখনোই ক্লাবের জার্সিতে অনুবাদ করতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে লোনে যান বায়ার্ন মিউনিখে, এরপর ঘুরেছেন এভারটন থেকে কাতারের আল-রাইয়ান আর গ্রিসের অলিম্পিয়াকোসে। সবশেষে এখন অবস্থান করছেন ব্রাজিলের সাও পাওলোতে। কিন্তু ক্লাবের হয়ে ভীষণ অনুজ্জ্বল এই হামেসই দেশের জার্সিতে জ্বলে ওঠেন আপন দীপ্তিতে। কীভাবে?

    ২০১৪-১৫ মৌসুমে, কোচ কার্লো আনচেলত্তির অধীনে রিয়াল মাদ্রিদে বেশ ভালো করেছিলেন হামেস রদ্রিগেজ। কিন্তু মৌসুম শেষে আনচেলত্তি চলে যান, আর সাথে করে যেন নিয়ে যান হামেসের সৌভাগ্যও। নিজের চোট, নতুন কোচের ট্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত আর রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণভাগের শক্তি, সব মিলিয়ে হামেস নিয়মিত খেলার সুযোগটাই পাচ্ছিলেন না, আর সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারছিলেন না ঠিকঠাক। তাই ২০১৭-১৮ সালে মৌসুমে লোনে তিনি পাড়ি জমান বায়ার্ন মিউনিখে, বায়ার্নের কোচ তখন কার্লো আনচেলত্তি। কিন্তু কার্লোও খুব বেশিদিন ছিলেন না বায়ার্নের দায়িত্বে। পরে কার্লোর অধীনে আবারও খেলার জন্য এভারটনেও গেছেন তিনি, কিন্তু তাতে বাঁধ সেধেছে চোট আর অফফর্ম। এভারটনে এক মৌসুম কাটিয়ে, এরপর এশিয়া-ইউরোপ-দক্ষিণ আমেরিকায় গেছেন হামেস, তবে থিতু হতে পারেননি কোথাও।

    কার্লো আনচেলত্তির অধীনে খেলতে পছন্দ করেন হামেস রদ্রিগেজ; Image Source: Getty Images

    ক্যারিয়ারে অনেকগুলো পজিশনে খেলেছেন, তবে প্রথাগত নম্বর টেনের ভূমিকায় খেলতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন হামেস রদ্রিগেজ। মূল স্ট্রাইকারের পেছনে অবস্থান করে নিজের ইচ্ছা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ডানে-বাঁয়ে সরে যাওয়ার যে স্বাধীনতা, সেটাই প্রয়োজন হয় হামেসের। এর বাইরে ৪-৩-৩ ফরমেশনেও খেলতে পারেন তিনি, সেক্ষেত্রে সাধারণত লেফট মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেন। বায়ার্নে অবশ্য ৪-৩-৩-এর রাইট মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন তিনি, বাম পায়ের খেলোয়েড় হওয়ায় কাট ইন করে খেলা সুইচ করতে বা থ্রু পাস দিতে পারতেন। জাভি মার্টিনেজ তখন খেলতেন মিডফিল্ডের অ্যাঙ্কর হিসেবে, আর তাঁদের সাথে মিডফিল্ডে ছিলেন আর্তুরো ভিদাল। তখন অন্যান্য বায়ার্ন খেলোয়াড়ের চেয়ে বলে বেশি স্পর্শ পেতেন হামেস, বল রিসিভ আর পাসিংয়ের মাধ্যমে ধরে রাখতেন দলের খেলাটা। সৃজনশীলতায় তখনো তিনি অতুলনীয়।

    তবে বায়ার্নের ওই ফর্মটা রিয়াল মাদ্রিদ বা এভারটনে ধরে রাখতে পারেননি হামেস রদ্রিগেজ। কিন্তু জাতীয় দল কলম্বিয়ার হয়ে ঠিকই নিজের দারুণ ফর্মটা বজায়ে রেখেছেন তিনি। এই চলমান কোপা আমেরিকাতেও তিনি অসাধারণ খেলছেন। কলম্বিয়ার প্রায় দুই বছরের অপরাজিত-দৌড়ের পেছনেও অন্যতম কারিগর তিনি। কোচ নেস্তর লরেঞ্জোও তাঁকে ব্যবহার করার উপায় বের করেছেন।

    নেস্তর লরেঞ্জোর ভরসাও হামেসের সঙ্গী; Image Source: Getty Images

    কলম্বিয়ার ৪-৩-১-২ ফরমেশনে দুই ফরোয়ার্ডের পেছনেই খেলছেন হামেস রদ্রিগেজ, ম্যাচটা যেন তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছেন। মাঝমাঠে ‘ডার্টি ওয়ার্ক’ করা, প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়া বা ট্যাকটিক্যাল ফাউল করার দায়িত্ব থাকছে জেফারসন লার্মা আর রিচার্ড রিওসের ওপর। নম্বর টেন হামেস তাই মনোযোগ দিচ্ছেন শুধু নিজের সৃজনশীলতায়, লুইস ডিয়াক আর জন কর্ডোবার দৌড়গুলো লক্ষ্য করে বাড়িয়ে দিচ্ছেন বল। 

    প্যারাগুয়ে এবং কোস্টারিকার মতো দুই লো-ব্লক দলের বিপক্ষে একটু নিচে নেমে খেলেছিলেন হামেস, নিজের দলের সেন্টারব্যাকদের কাছ থেকে বল নিয়ে আক্রমণে উঠেছেন। অপরদিকে ব্রাজিলের বিপক্ষে অতটা নিচে নামতে হয়নি হামেসকে। বরং রাইট হাফস্পেসেই বেশিরভাগ সময়ে অবস্থান করেছেন তিনি, আর খুঁজে নিয়েছেন সতীর্থদের। দুর্দান্ত পাসিংয়ে নজর কেড়েছেন বারবার।

    হামেসের হিটম্যাপ; Image Source: Sofascore

    প্রথম তিন ম্যাচেই সর্বোচ্চ তিনটা অ্যাসিস্ট পেয়ে গেছেন হামেস, ম্যাচপ্রতি কী-পাস সংখ্যায় তাঁর (৩.৭) চেয়ে এগিয়ে শুধু লিওনেল মেসি (৪.৩)। গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচে সতীর্থদের জন্য ১১টা সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি, অবশ্যই অন্য যে কারোর চেয়ে সংখ্যাটা বেশি। ব্রাজিলের বিপক্ষে বিতর্কিত সিদ্ধান্তটা পক্ষে এলে সংখ্যাটা ‘চার’-ও হতে পারতো। 

    ডেড বল বা সেটপিস থেকেও দারুণ কিছু সুযোগ তৈরি করেছেন হামেস। ১১টা সুযোগের মধ্যে ৭টাই এসেছে কর্নার বা ফ্রিকিক থেকে। মাপা পাস আর চমৎকার ক্রস করার সক্ষমতা আর ঠিকঠাক সতীর্থকে খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন তিনি। সব মিলিয়ে, কোচের চোখের মণি হয়ে উঠেছেন হামেস।

    হামেসের ক্রসগুলো আতঙ্ক ছড়াচ্ছে প্রতিপক্ষের বক্সে; Image Source: The Athletic

    “জাতীয় দলের জার্সির প্রতি তার ভালোবাসা, তার দায়বদ্ধতার ব্যাপারটা আমি জানি। আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে ওর ওপর,” কোচ নেস্তর লরেঞ্জো বলেছিলেন।

    কর্নারগুলো পড়ছে ছয়গজি বক্সের প্রান্তে; Image Source: The Athletic

    একেবারে নিখুঁত সব পাস আর ক্রস দিচ্ছেন তিনি, প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে বলগুলো খুঁজে নিচ্ছে ফরোয়ার্ডদের মাথা। বিপক্ষের গোলরক্ষকদের জন্যও কাজটা কঠিন হচ্ছে। জায়গা দাঁড়িয়ে বল ঠেকাবেন নাকি সামনে এসে ক্লিয়ার করবেন, এই দ্বিধায় পড়তে হচ্ছে তাঁদের। কর্নার থেকে হাওয়ায় ভাসানো ক্রসগুলো অবতরণ করছে ঠিক ছয়গজি বক্সের প্রান্তে। কলম্বিয়ার জন্য যেটা সুবর্ণ সুযোগ, প্রতিপক্ষের জন্য সেটা বিষম মাথাব্যথা।

    নিজের মতো করেই আলো ছড়াচ্ছেন হামেস রদ্রিগেজ; Image Source: Getty Images

    কলম্বিয়ার ২৬ ম্যাচের অপরাজিত-দৌড়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন হামেস রদ্রিগেজ। ক্লাব-ক্যারিয়ারে যতই যাযাবর জীবনযাপন করুন না কেন, জাতীয় দলের হয়ে উপযুক্ত পরিবেশ আর সাহায্য পেয়ে তিনি এখনো পরিণত হন সেই পুরোনো ‘হামেস’-এই, যে হামেস নিজেকে চিনিয়েছিলেন বিশ্বমঞ্চে, যে হামেস এখনো উড়তে পারেন এক দশক আগের মতোই।