• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    এই কোপাই মেসির শেষ টুর্নামেন্ট?

    এই কোপাই মেসির শেষ টুর্নামেন্ট?    

    বয়সটা ত্রিশ পূর্ণ করেছে আরো সাত বছর আগেই। বয়সের সাথে সাথে নিজের গতি আর ক্ষীপ্রতা কমেছে, তিনিও নিজের খেলার ধরন পাল্টেছেন সময়ে সময়ে। ইউরোপীয় ফুটবল ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকার মেজর লিগ সকারে। তবুও বয়স তো থেমে থাকছে না, লিওনেল মেসির অবসরের দিনও ঘনিয়ে আসছে। কে জানে, হয়তো এই কোপা আমেরিকাই হয়ে যেতে পারে আর্জেন্টিনার জার্সিতে তাঁর শেষ বড় টুর্নামেন্ট।

    ব্যাপারটা মেসিও জানেন। জানেন তাঁর আর্জেন্টাইন সতীর্থ আর কোচিং স্টাফরাও। তাঁরা জানেন, গত বছর থেকেই হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটটা বারবার বিরক্ত করছে মেসিকে। চলতি কোপা আমেরিকাতেও গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে খেলতে পারেননি ওই চোটের কারণে, ইকুয়েডরের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচেও ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। গত দেড় দশক ধরে যেভাবে গোল-অ্যাসিস্ট করে একাই টেনেছেন আলবিসেলেস্তেদের, সেটা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ছে এই সাঁইত্রিশ বছর বয়সীর জন্য।

    ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে চোটটা ভোগাচ্ছে মেসিকে; Image Source: Getty Images 

    তাতেও অবশ্য সতীর্থদের সমর্থন হারাচ্ছেন না মেসি। অধিনায়কের ওপর এখনো পূর্ণ আস্থা রাখছেন আর্জেন্টাইনরা। তাঁদের বিশ্বাস, টুর্নামেন্টে মেসির চলমান গোলখরা কেটে যাবে যেকোন মুহূর্তেই।

    গোলটা মেসি পেতে পারতেন টুর্নামেন্টের প্রথম দুই ম্যাচেই। কানাডার বিপক্ষে, টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে সম্ভবত এই কোপা আমেরিকার সেরা ছন্দে ছিলেন মেসি। কানাডার খেলোয়াড়েরা তাঁকে খুব কড়াভাবে মার্কিং করেননি, মেসিও সেই সুযোগটা নিয়েছিলেন। নিজে প্রতিপক্ষের জালের দেখা না পেলেও, তাঁর ভিশন আর পাসিং থেকেই দুটো গোল পায় আর্জেন্টিনা। এর মধ্যে লতারো মার্তিনেজের গোলটা তো আসে সরাসরি অ্যাসিস্ট থেকেই।

    দ্বিতীয় ম্যাচে চিলির বিপক্ষেও বেশ ভালো খেলছিলেন মেসি। প্রথমার্ধে বক্সের বাইরে থেকে তাঁর নেওয়া শটটা ফিরে আসে পোস্টে লেগে। ‘ওপেন প্লে’ থেকে তো বটেই, প্রতিটা সেট পিস থেকে মেসি সুযোগ তৈরি করছিলেন। কর্নার থেকে তাঁর ‘অলিম্পিক’ গোলের চেষ্টা পরীক্ষা নিয়েছিল চিলির গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভোর, এরপর তাঁর আরেকটা কর্নার থেকে প্রাপ্ত সুযোগেই গোল করেন স্ট্রাইকার লতারো মার্তিনেজ। তবে দ্বিতীয়ার্ধে খেলায় শারীরিক চ্যালেঞ্জের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যায়, মেসির পুরোনো চোট ফিরে আসে, আর পেরুর বিপক্ষের ম্যাচ থেকে ছিটকে যান তিনি।

    চলতি কোপায় মেসির হিটম্যাপ; Image Source: Sofascore

    ইকুয়েডরের বিপক্ষে নিজের সেরা ছন্দে ছিলেন না মেসি, চোট থেকে পুরোপুরি সেরে না ওঠার প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তবুও আর্জেন্টিনার গোলটা এসেছিল মেসির কর্নার থেকেই, যে কর্নারটা অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারের মাথা ছুঁয়ে গোল করার সহজ সুযোগ করে দেয় লিসান্দ্রো মার্তিনেজের সামনে। 

    এখনও গোল না পেলেও মেসিকে পুরো টুর্নামেন্টে নিষ্প্রভ বলার কোন সুযোগ নেই। পুরো টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ সংখ্যক (৭টি) বিগ চান্স তৈরি করেছেন তিনিই। ম্যাচপ্রতি কী-পাসে (৪.৩) এখনো মেসি সেরা, এক্সপেক্টেড অ্যাসিস্টেও (১.৬২) তাঁর সমান কেউ নেই। গোলস্কোরার মেসির জন্য হয়তো বেশ নিষ্প্রভ টুর্নামেন্ট যাচ্ছে, তবে প্লে-মেকার মেসি এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা।

    আটটা শটের মধ্যে চারটা অন টার্গেটে রাখতে পেরেছেন মেসি, তবে গোল পাননি এখনো; Image Source: Fotmob

    তবে গোল করতে না পারলেও মেসি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফর্মে ফেরার। চোট থেকে রিকোভারের চেষ্টা করছেন, ট্রেনিংয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন।

    “ট্রেনিংয়ের পরেও তিনি বাড়তি সময় দিচ্ছেন,” রদ্রিগো ডি পল বলেন, “লিও আমাদের কাছে বড় ভাইয়ের মতো। তিনি দলে থাকলে আমরা বাড়তি নিশ্চয়তা পাই। দর্শকেরাও এমনটাই দেখে অভ্যস্ত, তবে দলের খেলোয়াড়দের কোয়ালিটির ওপর ভরসা আছে আমাদের।”

    নিজের গোলস্কোরিং ফর্মটা ভালো না গেলেও দলে মেসি ভূমিকা রাখছেন ঠিকই। অধিনায়কত্বে বরাবরই মেসি সেরা, স্বার্থহীনতায়ও। কোপা আমেরিকার আগে সর্বশেষ প্রীতি ম্যাচে গুয়াতেমালার বিপক্ষে লতারো মার্তিনেজকে পেনাল্টি নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। গোলখরায় ভুগতে থাকা মার্তিনেজের জন্য সেই পেনাল্টিটা এসেছিল একটা ‘লাইফলাইন’ হয়ে, আর এরপরই নিজের সেরা ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন তিনি। চলতি কোপাতে চার গোল করে এগিয়ে রয়েছেন গোল্ডেন বুটের দৌড়ে, গোলের বিচারে প্রায় একাই এগিয়ে নিচ্ছেন আর্জেন্টিনাকে। আর কে জানে, হয়তো আর্জেন্টিনার এগিয়ে নেওয়া ব্যাটনটাও হয়তো এভাবেই মার্তিনেজের হাতে তুলে দিলেন মেসি!

    লতারোকে পেনাল্টি দিয়েছিলেন মেসি, মেসিকে এখন তার প্রতিদান দিচ্ছেন লতারো; Image Source: Getty Images

    লতারো মার্তিনেজ গোল পাচ্ছেন। সুযোগ পেলেই জুলিয়ান আলভারেজ প্রেস করছেন প্রতিপক্ষকে। বল প্লেয়িং মিডফিল্ডার অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার আর এনজো ফার্নান্দেজ মেসিকে সুযোগ করে দিচ্ছেন আরেকটু উপরে খেলার। প্রতিপক্ষ আক্রমণে উঠলে দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের আটকে দিচ্ছেন ক্রিস্টিয়ান রোমেরো আর লিসান্দ্রো মার্তিনেজ। আর গোলপোস্টে এমিলিয়ানো মার্তিনেজ তো আছেনই, মেসির জন্য যুদ্ধে যেতে যিনি সদাপ্রস্তুত। টাইব্রেকারে নিজের শটটা মিস করলেও তাই মেসির চিন্তা নেই, বাকিরা নিজেদের কাজ ঠিকঠাকভাবে করছেন, জেতাচ্ছেন আর্জেন্টিনাকে। আর মেসিও উপভোগ করছেন পুরো ব্যাপারটা।

    তবুও, সামনের বিশ্বকাপের এখনো দুই বছর বাকি। এদিকে মেসির হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটটা যেভাবে ভোগাচ্ছে, এই কোপা আমেরিকার পর মেসির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার আর লম্বা না হওয়াটা অস্বাভাবিক না। ব্যাপারটা জানেন মেসির ৪২ বছর বয়সী ভাই মাতিয়াসও। পরের কোপা আমেরিকা চার বছর পরে, বিশ্বকাপটাও দুই বছরের দূরত্বে। অত দূরের স্বপ্ন হয়তো মেসি নিজেও দেখছেন না।

    বয়সের কারণে মেসি একা পারছেন না, কিন্তু আর্জেন্টিনার তরুণরা এগিয়ে আসছেন তাঁর জন্যই; Image Source: Getty Images

    “আমার ভাইয়ের অসাধারণ সিনেমাটি শেষের দিকে চলে এসেছে,” আর্জেন্টাইন এক রেডিও স্টেশনকে বলেন মাতিয়াস।

    মাতিয়াসের মতো সেটা জানেন মেসির সতীর্থ রদ্রিগো ডি পলও।

    “লিওর মতো আর কেউ নয়। তাই আমাদের দলটাও আর কোনো একজনের ওপর নির্ভর করবে না,” ডি পল বলেন, “পরের বিশ্বকাপে লিও থাকবেন না। আমার মনে হয় আমাদের জন্য কাজটা খুব কঠিন হবে, কারণ লিও সবসময়েই আমাদের কাজটা সহজ করে দেন। লিওকে অনুসরণ করে আমরা উপকৃত হয়েছি, আর লিওর যত্ন নিতেই হবে।”

    মাতিয়াস, ডি পলের মতো লিওনেল মেসির সতীর্থরাও চাইছেন তাঁর হাতে শেষবারের মতো আন্তর্জাতিক শিরোপা তুলে দিতে। তাই তো আর্জেন্টিনার টিম বাসে এখনো গাওয়া হয়, “মেসির জন্য আরেকবার কোপা আমেরিকা জিততে চাই।”

    চাওয়াটা যে পৃথিবীর কোটি কোটি আর্জেন্টাইন সমর্থকেরও, সেটা বোধ হয় আর না বললেও চলে!