• ইউরো
  • " />

     

    ইউরোর ব্যবচ্ছেদ- গ্রুপ ডি

    ইউরোর ব্যবচ্ছেদ- গ্রুপ ডি    

     

    টানা দু’বার ইউরো জেতা স্পেন, উদীয়মান পরাশক্তি তুরস্ক, ক্রোয়েশিয়া এবং চেক প্রজাতন্ত্রকে নিয়ে গড়া গ্রুপ-ডি এবারের ইউরোর অন্যতম আকর্ষণীয় একটি গ্রুপ। স্পেন, ক্রোয়েশিয়া পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার জন্য ফেবারিট হলেও তুরস্ক  ও চেক প্রজাতন্ত্রের হার না মানা মনোবলের জোরে পাশার দান পাল্টেও যেতে পারে।

     

    স্পেনঃ দেল বস্কের দানে দানে তিন দান?

     

    গত দু’বারের মত এবারও ইউরোর কোয়ালিফায়ারে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই মূলপর্বে এসেছে স্পেন। কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কের শেষ টুর্নামেন্ট জিতলে তাঁকে একটা ‘হিরোস ফেয়ারওয়েল’ দেয়া এবং নিজেদের ইউরোর ‘হ্যাট্রিক’ পূরণ করতে পারার পক্ষেই বাজি ধরার লোক বেশিই হবে ধরে নেয়া যায়।

     

    রোড টু ইউরোঃ

     

    প্রথম ম্যাচে ম্যাসেডোনিয়াকে ৫-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে কোয়ালিফায়ারে শুভসূচনাই করেছিল স্পেন। কিন্তু পরের ম্যাচেই স্লোভাকিয়ার কাছে হারের পর এবং ম্যাচডে ৬ পর্যন্ত স্লোভাকিয়ার পেছনে থাকায় সমর্থকদের মন শঙ্কার কালো মেঘে ঢেকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু বাকি চার ম্যাচ জিতে ও স্লোভাকিয়ার দুটি হারের কল্যাণে টানা তৃতীয়বারের মত ইউরোর কোয়ালিফায়ারে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই মূল দলে খেলার গৌরব অর্জন করে স্পেন। ১০ ম্যাচ ৯ জয় ও ১ হার এবং ২৩ গোলের বিপরীতে মাত্র ৩ গোল হজম করেছে স্পেন। 

     

    টাচলাইনের বসঃ

    ব্রাজিল বিশ্বকাপে এক ঝাঁক উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ থাকার পরেও সেই আগের দল খেলিয়ে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়ার পর দেল বস্ককে কড়া সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এবার দল নির্বাচনে চমকে দিয়েছেন সবাইকেই। এবারই প্রথম এত তরুণ তুর্কিকে নিয়ে স্পেন কোনো টুর্নামেন্টে যাচ্ছে। কিন্তু কপাল পুড়েছে কোয়ালিফায়ারে স্পেনের সর্বোচ্চ গোলদাতা পাকো আলকাসেরের। কপাল পুড়েছে দিয়েগো কস্তা ও ২০০৮ ইউরো জয়ের নায়ক ফারনান্দো তরেসের। তিন স্ট্রাইকারের কেউই পাননি ফ্রান্সের টিকেট। লুকাস ভাজকেজ, নোলিতো, আদুরিজ, মোরাতাদের নিয়ে সাজানো অনভিজ্ঞ ফরওয়ার্ড লাইন নিয়ে স্পেন কতদূর যেতে পারে, তাই দেখার বিষয়। বরাবরের মত এবারও দলকে ৪-৩-৩ ফরমেশনে খেলাবেন দেল বস্ক।

     

    তারকা খেলোয়াড়ঃ

    প্রায় নতুন এই স্পেন দলটিতে অসংখ্য প্রতিভা থাকলেও মূল তারকা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। বার্সেলোনার এই শৈল্পিক মিডফিল্ডারের পায়ের জাদুর দিকেই তাকিয়ে থাকবে সমগ্র স্পেন। স্পেনের আগের দুই ইউরো জয়ের অন্যতম এই বর্ষীয়ান তারকা গেল মৌসুমের মাঝপথ থেকেই আছেন দারুণ ফর্মে। ফ্রান্সেও এই ফর্ম ধরে রাখার চেষ্টাই করবেন ‘ডন আন্দ্রেস’। বুস্কেটস ও কোকের সাথে মিডফিল্ড ভাগ করে নেয়া ইনিয়েস্তাই তাই এই দলের সবচেয়ে বড় তারকা।

    ক্রোয়েশিয়াঃ রক্ষণের দুর্বলতা ঢাকতে পারবে আক্রমণ?

    ক্রোয়েশিয়ার বর্তমান দলটিকে কিছুটা হলেও পেছনে চাকা পাংকচার্ড গাড়ির সাথে তুলনা করা চলে। কারণ, ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড ও ফরওয়ার্ড লাইন বিশ্বমানের হলেও ডিফেন্স বেশ ভঙ্গুর। ফ্রান্সে তাদের এই ডিফেন্সই ভাল কিছু অর্জন করা ও ব্যর্থতার মূল প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে।

    রোড টু ইউরোঃ

    ৭ জয়, ২ ড্র ও ১ হারে গ্রুপ রানারআপ হয়ে মূলপর্বে গেলেও ক্রোয়েশিয়ার চলার পথ মসৃণ ছিল না। ম্যাচ চলাকালীন সময়ে দর্শকদের মধ্যকার সংঘর্ষ, নিজেদের মাঠে কুশপুত্তলিকা পোড়ানো, কোচ নিকো কোভাচকে বরখাস্ত করা- সব মিলিয়ে বেশ মানসিক চাপেই ছিল ক্রোয়েশিয়ানরা। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে ঠিকই ফ্রান্সে নিজেদের জায়গা পাকা করেছে তারা।

    টাচলাইনের বসঃ

    নিকো কোভাচের বদলি হয়ে ইউরোর মাঝপথেই ক্রোয়েশিয়ার কোচের আসনে বসেন আন্তে কাচিচ। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দলকে ৩-৫-২ ফরমেশনে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। অদ্রিচ, রাকিটিচ, কোভাচিচ, সারনা, পেরিসিচদের সামনে মানজুকিচ ও ক্রামারিচকে নিয়ে ভাল খেললেও ডিফেন্সে সমস্যাটা এখনো কাচিচের কপালের ভাঁজের অন্যতম বড় কারণ। কোয়ালিফায়ারে মাত্র ৫ গোল হজম করলেও ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্স যে তাদের কঠিনতম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে ফ্রান্সে, তা বলাই বাহুল্য।

    তারকা খেলোয়াড়ঃ   

    নিঃসন্দেহে লুকা মদ্রিচ। বিগত ৫-৬ বছর ধরে বিশ্বের অন্যতম সেরা এই মিডফিল্ডারই ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড অর্কেস্ট্রার মূল শিল্পী। কোয়ালিফায়ারে মধ্যমাঠ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি  দুই গোল ও চারটি অ্যাসিস্টও করেছেন তিনি। রাকিটিচ ও কোভাচিচকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক অসাধারণ মিডফিল্ড ত্রয়ী। দ্বিতীয় রাউন্ড অথবা এরচেয়েও দূরে যেতে হলে ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকেরা মদ্রিচের দিকেই তাকিয়ে থাকবে দলকে অনুপ্রারিত করার জন্য।

     

    তুরষ্কঃ ফিরে আসবে ২০০৮?

    ২০০৮ সালের ইউরোতে গ্রুপপর্বে প্রথম ম্যাচ হারের পরও সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু জার্মানীর কাছে হেরে ফাইনালে যাওয়ার স্বপ্নভঙ্গের পর দলের তারকাদের কান্না আজো তুরস্ক  সমর্থকদের মনে কাঁটার মত বিঁধে। ২০১২ ইউরোতে কোয়ালিফাই করতে না পারলেও এয়ার ঠিকই ইউরোর মূলপর্বে জায়গা করে নিয়েছে তুরান, চালহানগলুরা।

     

    রোড টু ইউরোঃ

    প্রথম তিন ম্যাচে মাত্র ১ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শেষদিকে থাকা তুরষ্কের সামনে আবারো ইউরোতে কোয়ালিফাই করতে না পারার চরম ব্যর্থতা চোখ রাঙ্গানী দিচ্ছিল। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচ শেষে কোচ ফাতিহ তেরিমের উত্তপ্ত ও তাতিয়ে দেওয়া টীমটক যেন আমূলে বদলে দেয় দলটিকে। এরপরের আট ম্যাচে ১৮ পয়েন্ট সংগ্রহ করে সেরা তৃতীয় দল হিসেবে সরাসরি ইউরোর টিকেট পায় তুরস্ক । শেষ ম্যাচটা তাদের জিততেই হত। ৮৮ মিনিট পরেও গোলশূন্য ম্যাচে ফ্রিকিক পায় তুরস্ক  এবং নাটকীয়ভাবে সেখান থেকে পরম অরাধ্য গোলটি করে দলকে ইউরোর মূলপর্বে নিয়ে যান সহ-অধিনায়ক সেলচুক ইনান। ১০ ম্যাচে ৫ জয়, ৩ ড্র ও ২ হারে ১৮ পয়েন্ট নিয়ে কোয়ালিফায়ার শেষ করে তুরস্ক ।

     

    টাচলাইনের বসঃ

    আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মত তুরস্কের জাতীয় ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব পেলেন ফাতিহ তেরিম। মূলত তুরষ্কে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তাই এর পেছনের মূল চালিকা শক্তি। হল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, আইসল্যান্ডের সাথে টক্কর দিয়ে টায়ে টায়ে হলেও ইউরোতে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে তেরিমের শিষ্যরা। ৪-২-৩-১ ফরমেশনের চরম ভক্ত ৬২ বছর বয়সী এই কোচ তুরস্ককেও এই ফরমেশনে খেলিয়ে পেয়েছিলেন কার্যকরী সাফল্য। চালহানগলু, ইনান, তুরানদের সামনে খেলিয়েছেন কোয়ালিফায়ারে তাদের হয়ে সর্বোচ্চ গোলস্কোরার ‘টার্কিশ বুল’ খ্যাত বুরাক ইলমাজকে। ইউরোতেও যে তুরস্ক  এই ফরমেশেই খেলবে, তা প্রেস কনফারেন্সে বলেই দিয়েছেন তেরিম।

    তারকা খেলোয়াড়ঃ

     

    ইনান, চালহানগলু, ইলমাজরা আসলেও তুরষকের সবচেয়ে বড় তারকা এখনো সেই আরদা তুরানই। ২০০৮ সালের ইউরোতে তুর্কিদের যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেমিতে। বার্সেলোনার হয়ে পুরো মৌসুমে মাত্র ১৮ ম্যাচ খেললেও ফিটনেস ও শারিরীকভাবে একদম ফ্রেশ আরদা তুরানকে নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী তার সতীর্থ ও সমর্থকেরা। কোয়ালিফায়ারে ২ গোল ও ৬ অ্যাসিস্ট দিয়ে দলের জন্য অবদানও রেখেছেন তুরান।

     

    চেক প্রজাতন্ত্রঃ পবরস্কি, নেদভেদদের পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন দারিদা, রসিস্কি?

    সেই ১৯৯৬ সালে ইউরোর ফাইনালে জার্মানীর কাছে হারার পর ২০০৮ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল, ইউরোতে সাফল্য বলতে চেক প্রজাতন্ত্রের এই দুটি আসরই। কিন্তু পাভেল ভারদার শিষ্যদের অসাধারণ মনোবল চেক সমর্থকদের আশার ভেলায় আবারো বাতাস লাগিয়েছে।

    রোড টু ইউরোঃ

    হল্যান্ড, তুরস্ক , আইসল্যান্ডদের নিয়ে বানানো গ্রুপটি থেকে চেক প্রজান্ত্র মূলপর্বে যাবে, তাও আবার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে, এমনটা বিশ্বাস করার সাহসিকতা খুব সম্ভবত চেক সমর্থকদেরো ছিল না। থাকবে কীভাবে? এই দলটিতে যে তারকা নেই বললেই চলে! কিন্তু চেক খেলোয়াড়েরা আবারো প্রমাণ করেছে, একত্রিত হয়ে কোনো লক্ষ্যই অর্জন করা অসম্ভব নয়।

     

    টাচলাইনের বসঃ 

    পাভেল ভারদা বর্তমানে অনেকের মতে চেক প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও জনপ্রিয়। কারণ, কোয়ালিফায়ারের গ্রুপ ঘোষণার পর চেক সমর্থকেরাও ভাবেননি, এমন তারকার অভাবে ভোগা দলটি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফ্রান্সের টিকেট পাবে। ৪-২-৩-১ ফরমেশনে এবং অনুপ্রেরণার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দলের খেলোয়াড়দের ও দলকে নিয়ে গেছে অনবদ্য এক ইতিহাসের পথে। তার অধীনেই বিগত ৬-৭ বছরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলাটা খেলতে পেরেছে চেক দল। অবশ্য, দলের ডিফেন্স উন্নতি করতে না পারলে খুব সম্ভবত গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হতে পারে রসিস্কিদের। পিটার চেকের মত একজন বিশ্বমানের কীপার থাকার পরেও কোয়ালিফায়ারের ১০ ম্যাচ ১৪টি গোল হজম করেছে চেকরা।

     

    তারকা খেলোয়াড়ঃ

     

    মিডফিল্ডার ভ্লাদিমির দারিদা। ২৫ বছর বয়সী হার্থা বার্লিন তারকা এই মার্চেও রিয়াল মাদ্রিদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। প্রায় প্রতি ম্যাচেই গড়ে ১২ কিলোমিটার কাভার করা এক মিডফিল্ডার চেকদের বড় কিছু অর্জনের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হবেন। গ্রুপপর্বে চারবার ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হওয়া এই মিডফিল্ডারের কোয়ালিফায়ারে চেকদের সর্বোচ্চ গোলদাতা বরেক ডচকালের সাথের কম্বিনেশনের দিকে আলাদা ভাবে নজর রাখতে হবে প্রতিপক্ষদের।