দেবদূতের বিদায়ক্ষণে
‘ফাঁড়া’, অথবা ‘দুর্ভাগ্য’, অথবা হয়তো নিছক ‘সামর্থ্যের অভাব’, আপনি তাকে ডাকতে পারেন নিজের ইচ্ছামতো নামে।
যে নামেই ডাকুন না কেন, আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের কপালে সেঁটে গিয়েছিল একটা অভিশাপ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যায়, সেই অভিশাপ আর কাটে না। তারকারা ম্লান হয়ে যান সেই অভিশাপে, মহাতারকাও উত্তর খুঁজে পান না। অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হয়, আর্জেন্টাইন আকাশি-সাদায় অভিশাপের অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। আঁধার কালো এই রাতের যেন কোন শেষ নেই, টানেলের শেষ প্রান্তের ছোট্ট আলোকবিন্দু তখন কেবলই মরীচিকা। অনন্ত অপেক্ষার প্রহর গোণা হয় প্রজন্মান্তরের দীর্ঘশ্বাসে।
এরপর একজন দেবদূত আসেন। ইংরেজিতে তাঁকে বলে ‘অ্যাঞ্জেল’, স্প্যানিশে ‘আনহেল’। কিন্তু অভিশাপের ছোঁয়া তাঁকেও স্পর্শ করে। ভাগ্যের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ের আগেই ডানাজোড়া কাটা পড়ে দেবদূতের। থমকে যান তিনি। মহাতারকাকে আর সাহায্য করা হয় না তাঁর। মহাতারকা হেরে যান লড়াইতে। হেরে যায় আর্জেন্টিনা। উড়তে থাকা স্বপ্নের আকাশি-সাদা নিশানটা গুটিয়ে যায়। লড়াই শেষ হয় অবনত মস্তকে দণ্ডায়মান মহাতারকার আক্ষেপমিশ্রিত নির্বাক হতাশায়, আর দেবদূতের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অক্ষমতার অশ্রুতে।
দেবদূত কাঁদছেন; Image Source: Getty Images
কিন্তু একটা লড়াই-ই তো আর জীবনের শেষ কথা হতে পারে না। পরের বছর আবারও সুযোগ আসে তাঁদের সামনে। যদিও আগেরবারের মতো বৈশ্বিক লড়াই নয় এবার, মহাদেশীয়। অবশ্য মহাদেশীয় বলে লড়াইকে ছোট করার সুযোগ নেই। ডাইনির অভিশাপে আকাশি-সাদার প্রতিটা লড়াই-ই জীবন-মরণ। তবে এবার আর দুশ্চিন্তা নেই। মহাতারকা তো লড়াইয়ের ময়দানে আছেনই, দেবদূতও এবার প্রস্তুত। অভিশাপ তো এবার কাটবেই!
নাহ। অভিশাপ এবারও কাটলো না। লড়াইয়ে নামার কিছুক্ষণ পরই চোট পেলেন দেবদূত। ডানাজোড়া আবারও কাটা পড়লো তাঁর। মহাতারকাকে একা রেখে ময়দান থেকে উঠে যেতে হলো তাঁকে। মহাতারকার সব চেষ্টা বিফলে গেল। আবারও শেষ পরীক্ষায় হার মানতে হলো আকাশি-সাদাদের, জয়ী খোঁজার যে লড়াইকে লোকে আদর করে ‘ভাগ্য-পরীক্ষা’ বলে।
সর্বনাশা চোট; Image Source: Getty Images
সময় যায়। দিন যায়। মাস যায়। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টায়। নতুন বছর আসে। আরো একবার সুযোগ আসে আর্জেন্টিনার সামনে। এই সুযোগটা অবশ্য একটু বিশেষ। প্রতি একশ বছর পরপর নাকি আসে এমন সুযোগ। মহাতারকা-দেবদূতের জন্য তো এমন একটা সুযোগই দরকার ছিল, এবার ডাইনির অভিশাপ না কেটে যাবে কোথায়!
লড়াইয়ের শুরুর পর্যায়ে ডানা মেললেন দেবদূত, মহাতারকা জ্বলে উঠলেন আপন দীপ্তিতে। শেষ লড়াইয়ের আগে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত, আগের দুবারের মতো এবার আর অভিশাপ কাটানোর সুযোগটা হাত ফসকাবে না আর্জেন্টিনার। একটা জাতি আর কতটাই বা দুর্ভাগা হতে পারে, আগের দুই পরাজয়ের অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু না কিছু শিখবে!
কিন্তু শেষ লড়াইয়ের আগে আবারও এক অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কা এলো আকাশি-সাদার শিবিরে। ময়দানে নামার আগেই দেবদূত চোট পেলেন তার ডানায়, লড়তে পারলেন না ঠিকমতো। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে, মহাতারকাকে একা ফেলে, বাধ্য হয়ে তাঁকে উঠে যেতে হলো ময়দান ছেড়ে। আর একেবারে শেষ পরীক্ষায় তো ভুল করে ফেললেন মহাতারকা নিজেই। আরো একবার কাঁদলেন তিনি নিজে, কাঁদলেন অনুসারীরা। কাঁদলেন দেবদূত। যে অভিশাপ টানা তিনবারের চেষ্টায় কাটেনি, সেই অভিশাপ কি আর এই ইহজীবনে কাটবে! হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার আগে কি একবার মুক্ত হাওয়ায় মন খুলে শ্বাস নেওয়া হবে না? একবারের জন্য পাওয়া হবে না সেই অতুলনীয় স্বর্গীয় অনুভূতি? অবর্ণনীয় কষ্টে রক্তক্ষরিত হৃদয়ের বাকরুদ্ধ কান্নাগুলো স্থানান্তরিত হবে না বিশ্বজয়ের অপার্থিব আনন্দের অশ্রু দিয়ে?
স্বপ্নভঙ্গের শেষ কোথায়? Image Source: Alamy
পরের তিন-চার বছরে অবশ্য তেমন কোন লক্ষণ দেখা গেল না। অভিশাপের ছায়া গাঢ় হলো। আকাশি-সাদার মাঝের সূর্যটা ঢেকে গেল কালো মেঘে। স্বপ্নবাজ সমর্থকের আশাগুলো হতাশায় রূপান্তরিত হলো, আর্জেন্টিনার দুঃসময় দীর্ঘায়িত হলো। টানেলের শেষে তখন শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার দেয়াল। কোথাও কোন আলোকবিন্দু নেই। সামনে এগোনোর পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্ঠুর দেয়াল।
এই দেয়ালটা দেবদূত আগেও দেখেছেন। তাঁর বাবা কাজ করতেন কয়লা শ্রমিক হিসেবে, কয়লার ধূলে বাড়ির শুভ্র দেয়ালটা ঢেকে গিয়েছিল কালো রঙে। কয়লা থেকে চারকোল তৈরি করার কাজটা করতেন তিনি, তাতে সাহায্য করতেন দেবদূতও। দেয়াল ভাঙার কাজটা তিনি করেননি অবশ্য কখনো, তবে কালো দেয়ালের ওপারের আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীটা খুঁজে নিতে জানতেন তিনি।
মাঝমাঠ থেকে রদ্রিগো ডি পলের উঁচু করে বাড়ানো বলটা মাঠের ডান দিকে ভেসে আসতেই আরো একবার যেন জীবনটা দেখতে পেলেন দেবদূত। সেই দেয়াল হয়ে সামনে এগিয়ে এসেছিলেন এডারসন। তাঁর মাথার ওপর দিয়ে বলটা জালে জড়িয়ে দিতে দিতে যখন ছুটছেন আনহেল ডি মারিয়া, উদ্বাহু দৌড়টা যেন দেবদূতের মতো ডানা মেলে ওড়ারই পূর্বক্ষণ!
যে গোলে অভিশাপ কাটে! Image Source: Getty Images
টানেলের শেষের কালো অন্ধকার নিষ্ঠুর দেয়ালটাও ভেঙে গেল ডি মারিয়ার ওই চিপে। ম্যাচশেষের বাঁশি বাজতেই মহাতারকা লিওনেল মেসি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন মাটিতে। কাঁদলেন মেসি, কাঁদলো আর্জেন্টিনার শত কোটি ভক্ত। দুঃখের দিন তবে শেষ হলো! ডাইনির কালো অভিশাপ কেটে গেল দেবদূতের সোনালি স্পর্শে!
সত্যিই, অভিশাপ কেটে গেল। কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে পরের বছরে সুযোগ এলো ফিনালিসিমাতে খেলার। ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালির বিপক্ষে ওই ম্যাচে আবারও গোল পেলেন আনহেল ডি মারিয়া, আরো একটা শিরোপা জিতলো আর্জেন্টিনা। দুইয়ে দুই!
গোল পেলেন ফিনালিসিমাতেও; Image Source: Getty Images
কিন্তু আসল ট্রফি তো তখনও বাকি। সেই সোনালি ট্রফি, যার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চষে ফেলতে পারেন ফুটবলাররা। যার স্বপ্নে নির্ঘুম রাত কাটানো যায়, যার প্রাপ্তিতে পূর্ণ হয় জীবন, যাকে একবার স্পর্শ করার সুযোগের জন্য চোটগ্রস্ত হাঁটুতে ইনজেকশন নিয়ে অপেক্ষা করা যায় অনন্তকাল। সোনালি বিশ্বকাপ, স্বপ্নের বিশ্বকাপ!
কিন্তু দেবদূতের তো চোটপ্রবণ শরীর। তাঁকে ব্যবহারও করতে হয় বুঝেশুনে, মেপে মেপে, সাবধানে। তবুও হয়তো শেষ রক্ষা হয় না। বিশ্বমঞ্চে চোটে পড়েন দেবদূত। শেষ ষোলোর লড়াইটা আর্জেন্টিনা লড়ে তাঁকে ছাড়াই, শেষ আটে তিনি মাঠে নামেন আট মিনিটের জন্য। শেষ চারটা আবারও বেঞ্চে বসে কাটান তিনি, কিন্তু কোচ লিওনেল স্কালোনি জানতেন, শেষ লড়াইতে তিনি দেবদূতকে ময়দানে চান প্রথম মুহূর্ত থেকেই।
দেবদূতও এবার অনেক বেশি সতর্ক। আগেরবারের ভুল আর এবার হতে দেওয়া চলবে না। আট বছর আগে অপ্রাপ্তির খাতায় নতুন করে গল্প লিখতে হবে। পৃথিবীর সামনে লড়তে হবে প্রতিপক্ষের সাথে, নিজের সাথে, নিজের ভাগ্যের সাথে। মহাতারকার সাথে মিলে চুকাতে হবে সব পুরনো হিসাব।
আনহেল লড়লেন। বিজয়ীর মতোই লড়লেন। প্রতিপক্ষের ডানপাশটা গুঁড়িয়ে দিলেন। নিজে গোল পেলেন, উন্মুক্ত করলেন লিওনেলের গোল পাওয়ার দ্বার। আর্জেন্টিনার ছত্রিশ বছরের অভিশাপ কাটালেন, নিজের আট বছরের আক্ষেপ দূর করলেন। বিশ্বকাপের ছোঁয়ায় নিজেকে পরিপূর্ণ করলেন, আলবিসেলেস্তে ব্যাজের ওপরে আঁকলেন আরো একটা তারকা, সাথে যেন অমরত্বের অক্ষরে নিজের নামটাও লিখে রাখলেন ওই অক্ষয় তারকায়!
ফাইনালের সেই গোল; Image Source: Getty Images
অমৃতের পাত্রে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেবদূত সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর আর্জেন্টাইন জার্সিটা তুলে রাখার। অনেক তো ওড়াউড়ি হলো, অনেক উত্থানপতন দেখলেন, আর্জেন্টিনাকে অভিশাপমুক্ত করলেন। এবার তবে বিদায়ের পালা। বিদায়ের মঞ্চ হিসেবে দেবদূত বেছে নিলেন ওই মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইকেই। আরো একটা ফাইনালকে, যে ফাইনালের সাথে মিশে আছে দেবদূতের অনেক হাসিকান্নার গল্প। নিজের তিন ফাইনালের দুঃখকে নিজেই পরের তিন ফাইনাল দিয়ে কাটিয়েছেন তিনি, ফাইনালে প্রতিপক্ষকে মোক্ষম আঘাত করার জন্য তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তেমনই আরেক ফাইনালে সাধের ফুটবলকে বিদায় বলবেন তিনি।
ফাইনালে আরেকবার কাঁদবেনই তিনি, ফলাফলে আনন্দ-বেদনা যেটাই থাকুক না কেন। কিন্তু তাতে কী-ই বা যায় আসে! যে অনন্ত কান্না থেকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন তামাম দুনিয়ার কোটি আর্জেন্টাইন ভক্তকে, যেভাবে আরেকবার আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন আকাশি-সাদা পতাকার মাঝের ওই সূর্যকে, তাতে আলবিসেলেস্তে ব্যাজের অক্ষয় তৃতীয় তারকার মতো নিজেকেও বসিয়েছেন আর্জেন্টিনার সর্বকালের সেরা তারকাদের অমর কাতারে।
ঘনিয়ে এলো বিদায়ের ক্ষণ; Image Source: Getty Images
আনহেল ডি মারিয়ার মতো সাক্ষাৎ দেবদূতেরা বিদায় নেন দৃশ্যপট থেকে। কিন্তু মহাকাল তাঁদের মনে রাখে মহাতারকা হিসেবে, স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখে তাঁদের বীরত্বের কাহিনী, বিজয়ের গল্প। দেবদূতের প্রস্থান মানে তাই শুধুই অশ্রুসজল বিদায় নয়, সাথে এক সমুদ্র আবেগমিশ্রিত ধন্যবাদও।