'ওয়ান ফর অল, অল ফর ওয়ান'
গল্পটা আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের এক জুলাই মাসের।
ব্রাজিল থেকে ফুটবল বিশ্বকাপের দামামা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো পৃথিবীতে। ওদিকে ইউরোপের জমজমাট ক্লাব ফুটবল তখন বিশ্বকাপ শেষে নতুন মৌসুম শুরুর অপেক্ষায়। ব্রাজিলগামী বিমানে জায়গা না পাওয়া খেলোয়াড়রা তখন অখণ্ড অবসরে বিশ্বকাপকে উপভোগ করছেন নিজেদের মতো করে। কেউ উড়ে গেছেন ব্রাজিলে, কেউ আবার পরিবারের সাথে খেলা দেখছেন নিজের বাড়ির টিভিতে। তাঁদেরই একজনের নাম দিবু। দিবু জন্মসূত্রে আর্জেন্টাইন, গোলরক্ষক হিসেবে খেলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব আর্সেনালে। খেলেন বলতে ধারে এই ক্লাবে, ওই ক্লাবে খেলে বেড়ান আর কী। তবে এদিক-ওদিক 'ঘোরাঘুরি' করলেও ক্লাবে থিতু হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় দলের গোলপোস্ট সামলানোর দায়িত্ব নেওয়ার স্বপ্নটা দেখছিলেন।
একই স্বপ্নটা তখন দেখছিলেন আর্জেন্টিনার আরেক তরুণ। তরুণ বলতে মাত্রই কৈশোর পেরিয়েছেন। রদ্রি নামের এই তরুণ তখনো পেশাদার ফুটবলের জন্য নিজের দেশ ছাড়েননি, আর্জেন্টিনার রেসিং ক্লাব থেকে ধারে স্প্যানিশ লা লিগায় কোন একটা ক্লাবে আসার তোড়জোড় চলছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময়ে এই তরুণও ছিলেন নিজ মাতৃভূমিতেই, দেখেছিলেন মারাকানায় লাতিন আর ইউরোপার দুই পরাশক্তির বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইটা।
তরুণ দিবু-রদ্রি-লিচা; Image Source: Getty Images, Alamy
লিচার বয়স তখন আরো কম, পনেরো কী ষোল হবে। তাঁর কিশোর-হৃদয়টাও ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয় চাচ্ছিল ভীষণভাবে। মারিও গোটজের ওই গোলের পরও হয়তো একটু আশা বাকি ছিল, কিন্তু ফ্রিকিক মিস আর শেষ বাঁশি বাজার পরে মেসির বিষণ্ণতামাখা হাসিতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না লিচা, নাকের নিচের সরু গোঁফের রেখার মতো সদ্য জন্মানো আত্মসম্মান রক্ষার ভয় বিসর্জন দিয়ে কাঁদলেন শিশুর মতো। সাথে কাঁদলেন দিবু, কাঁদলেন রদ্রি। একইভাবে তাঁরা কাঁদলেন পরের দুই বছরের দুই কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনার পরাজয়ের পরে, আরেকবার চোখ ভেজালেন অভিমান আর দুঃখে লিওনেল মেসি অবসর নেওয়ার পরে।
পনেরো বছরের এনজো তো মেসির উদ্দেশ্যে একটা বিশাল চিঠিই লিখে ফেললেন। আর্জেন্টিনার জার্সিতে ট্রফি জেতার জন্য ফেরার আহ্বান জানিয়ে নয়, কিশোর এনজো বরং মেসির ফিরে আসার আকুতি জানালেন আরেকবার খেলাটাকে উপভোগ করার জন্যই। জনতার প্রত্যাশার চাপ না নিয়ে, শিরোপা জেতার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা না করে, মেসিকে খেলতে বললেন শুধু আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলার আনন্দটা গায়ে মেখেই। চিঠিতে লেখা ছিল না বটে, কিন্তু এনজো হয়তো সেদিন মনে মনে বলেছিলেন, “লিও, আর চার-পাঁচটা বছর শুধু আনন্দ নিয়ে খেলে যাও। আমরা একটু বড় হই, তোমাকে ট্রফি জেতানোর দায়িত্ব আমরাই নেবো।”
এনজোর সেই চিঠি; Image Source: Facebook
এবার এই লেখার প্রথম বাক্যে আরেকবার ফিরে যাওয়া যাক। হ্যাঁ, গল্পই বটে। দিবু, রদ্রি আর লিচাদের এই গল্পগুলো হয়তো শতভাগ সত্য নয়, হয়তো সেগুলো পুরোপুরি যাচাইয়ের সুযোগও নেই, কিন্তু মোটাদাগে বেশিরভাগ আর্জেন্টাইন সমর্থকের গল্প তো এটাই। আর এই দিবু, রদ্রি, লিচা, এনজোরাই আজকের এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, রদ্রিগো ডি পল, লিসান্দ্রো মার্টিনেজ আর এনজো ফার্নান্দেজ, বা অন্য কথায়, এরাই আজকের আর্জেন্টিনা। দশ বছর আগের সেদিনের কিশোররাই আজকের পরিণত তরুণ।
এই প্রজন্মটা দেখেছে লিওনেল মেসি নামের একজন যোদ্ধা কীভাবে একা হাতে আর্জেন্টিনাকে টেনে নিয়েছেন বিশ্বকাপে, কোপা আমেরিকায়। নিজে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, একের পর ব্যালন ডি’অর জিতেছেন, কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে তাঁর সঙ্গী ছিল ফাইনালে একের পর এক পরাজয়ের দীর্ঘশ্বাস। খাদের কিনারায় চলে যাওয়া আর্জেন্টিনার ‘১৮ বিশ্বকাপ-স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে। কিন্তু তবুও, একটা সময় তো জাতীয় দলের প্রতি মেসির নিবেদন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। মেসি নাকি জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলান না, বার্সেলোনার মেসি কখনোই আর্জেন্টিনার হতে পারবেন না… এমন আরো কত কথা। মেসি চুপ করে ছিলেন, চেয়েছিলেন পারফরম্যান্স দিয়ে সব সমালোচনার জবাব দিতে। নিজের পারফরম্যান্সে দশে দশই পেয়েছিলেন, কিন্তু আর্জেন্টিনার ট্রফি জেতার খাতায় লেখা থাকলো শুধুই একটা শূন্য।
ফাইনাল মানে মেসির কাছে ছিল শুধুই হতাশা; Image Source: Getty Images
আর শুধু মাঠের খেলাতেই নয়, অধিনায়ক মেসি আর্জেন্টিনাকে টেনেছিলেন মাঠের বাইরেও। আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গ্রান্দানার মৃত্যুর পরে বোর্ডের সাথে দলের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেই দূরত্ব ঘোচানোর জন্য ভূমিকা রেখেছিলেন মেসি। চরম অর্থাভাবে থাকা বোর্ডের অনেক কর্মচারীর বেতনও দিয়েছিলেন তিনি। এর বাইরে একের পর এক কোচ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও মেসির উপস্থিতি আর হস্তক্ষেপ সমাধান এনেছে দলের মধ্যে। ২০১৬ সালে সতীর্থ এজেকিয়েল লাভেজ্জিকে নিয়ে অসত্য সংবাদ তৈরির প্রতিবাদে পুরো দল নিয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন মেসি।
লাভেজ্জি-ইস্যুতে মেসির নেতৃত্বে মিডিয়াকে বয়কট করছেন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়েরা; Image Source: AP
মাঠের মেসিকে তো দর্শকেরা সবাই দেখছে, কিন্তু এই তরুণ প্রজন্মটা দেখেছে মাঠের বাইরে অধিনায়ক থেকে 'নেতা' হয়ে ওঠা মেসিকে। এজন্যই রদ্রিগো ডি পল এসে বলতে পারেন, "মেসির জন্য আমরা যুদ্ধে যেতে রাজি", লিসান্দ্রো মার্টিনেজ মেসিকে আটকে রাখতে চান যতদিন সম্ভব, আর এমিলিয়ানো মার্টিনেজ তো নিজের প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত মেসির জন্য। এই কারণেই এক কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালের মেসির বক্তব্য শুনে চোখের জল ফেলেন কোচ-কর্মকর্তা-খেলোয়াড় সবাই, আবার ওই মেসির রক্ত গরম করা কথাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন পরের কোপা আমেরিকার ফাইনালে, মেসির জন্যই। এই কারণেই মাঠে মেসির গায়ে টোকা পড়লেও সবাই ছুটে আসেন একযোগে। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দেন, সেনাপতির গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড়ও বরদাশত করবেন না তাঁরা। একসময়ের 'মেসির আর্জেন্টিনা' ব্যাপারটা রূপান্তরিত হয় 'আর্জেন্টিনার মেসি'তে, মাঠে মেসির নামে যুদ্ধে নামা খেলোয়াড়ই মাঠের বাইরে হয়ে ওঠেন মেসির সবচেয়ে বড় ভক্ত। তাই একটা সময়ে স্বয়ং মেসিও বলে ফেলেন, "একটা পুরো প্রজন্ম গড়ে উঠেছে আমার সাথে, আর্জেন্টিনার জার্সিতে আমাকে শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে দেখার জন্য তারা দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে। তারাই আমাকে শক্তি যুগিয়েছে, আর আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত তারা আমার সাথেই থাকবে।"
তরুণ মেসির সাথে ছোট্ট আলভারেজ; Image Source: X
স্কোয়াডে একদল মেসিভক্তকে পেয়ে কোচ লিওনেল স্কালোনির জন্যও কাজটা সহজ হয়ে যায়। দলকে তিনি পথ দেখান, সেই পথে হাঁটেন মেসি, আর মেসির পেছনে হাঁটেন এমিলিয়ানো-ডি পল-লিসান্দ্রো-এনজোরা। গোল-অ্যাসিস্টে ঠিকই মেসি নেতৃত্ব দেন, কিন্তু মেসি গোল না পেলেও আর্জেন্টিনা থমকে যায় না। বিশ্বকাপেও মেসি নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে, কিন্তু প্রয়োজনের সময়ে জ্বলে ওঠেন সতীর্থরা। চোটগ্রস্ত ফরোয়ার্ড লতারো মার্তিনেজের বদলে সুযোগ পেয়েই বিশ্বমঞ্চে নিজেকে চিনিয়ে দেন জুলিয়ান আলভারেজ। রাইটব্যাকে নাহুয়েল মলিনা-গঞ্জালো মন্তিয়েল আর লেফটব্যাকে নিকোলাস তালিয়াফিকো-মার্কোস আকুনা পারফর্ম করেন পাল্লা দিয়ে। দুটো টাইব্রেকারে দলকে জিতিয়ে দেন এমিলিয়ানো, সাথে ম্যাচে মহাগুরুত্বপূর্ণ কিছু সেভ তো আছেই। মিডফিল্ডে জিওভানি লো সেলসোর ইনজুরি আর লিয়ান্দ্রো পারেদেসের অফফর্মে তাঁদের জায়গাটা দারুণভাবে নিয়ে নেন এনজো ফার্নান্দেজ আর অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার।
মাঠে পড়ে আছেন মেসি, ওদিকে তেড়ে গেছেন তাঁর সতীর্থরা; Image Source: Getty Images
আরে, ম্যাক অ্যালিস্টারকে নিয়েও তো গল্প আছে! আর্জেন্টিনা দলে সুযোগ পাওয়ার পর তরুণ ম্যাক অ্যালিস্টারকে সতীর্থরা ডাকতেন ‘কোলো’ (ইংরেজিতে ‘জিনজার’) বলে। কিন্তু ম্যাক অ্যালিস্টার সেটা পছন্দ করতেন না একেবারেই। লিওনেল মেসির কানে ব্যাপারটা পৌঁছানো মাত্রই তিনি এই নামে ম্যাক অ্যালিস্টারকে ডাকতে নিষেধ করে দেন সবাইকে। যদি বলা হয়, বিশ্বকাপের ফাইনালে একটা অ্যাসিস্ট করে তার প্রতিদান দিয়েছিলেন ম্যাক অ্যালিস্টার, খুব কি বাড়িয়ে বলা হবে!
অথবা এই কোপা আমেরিকার কথাই ধরা যাক। ৩৭ বছরের মেসির এখনকার নিত্যসঙ্গী চোট। এই চোটেই পেরুর বিপক্ষের ম্যাচটা বেঞ্চে বসে দেখেছিলেন মেসি, ইকুয়েডরের বিপক্ষেও ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। গোলের বড় সুযোগ তৈরিতে মেসি সবার চেয়ে এগিয়ে, তবে পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র এক গোল আর এক অ্যাসিস্ট তো ঠিক মেসি-সুলভ নয়। কিন্তু তবুও ফাইনালে উঠতে সমস্যা হয়নি আর্জেন্টিনার। চার গোল করে লতারো মার্তিনেজ আছেন টুর্নামেন্টের সোনালি জুতোর দৌড়ে, তাঁর পেছনে আছেন দুই গোল করা জুলিয়ান আলভারেজ। এমিলিয়ানো মার্তিনেজ আরেকবার জ্বলে উঠেছেন স্বমহিমায়, ইকুয়েডরের বিপক্ষে টাইব্রেকারে মেসির পেনাল্টি মিসটাও আর্জেন্টিনাকে পোড়ায়নি তাঁর দুই সেভে। রদ্রিগো ডি পল আরেকবার সময়মতো নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন, লিসান্দ্রো-রোমেরো পুরো টুর্নামেন্টেই ভরসা দিয়ে গেছেন রক্ষণে। সবই যেন করছেন মেসির জন্য, তাই টিম বাসে আবারও গান গাইছেন তাঁরা, “চলো মেসির জন্য আবার কোপা আমেরিকা জিতি…”
মেসির নেতৃত্বে যেন যুদ্ধে নামছে আর্জেন্টিনা; Image Source: X
ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে আর্জেন্টিনাকে এক হাতে টেনে নিয়েছিলেন লিওনেল মেসি, এখন সেই মেসির জন্যই রীতিমতো যুদ্ধে যাচ্ছে আর্জেন্টাইনরা। এমিলিয়ানো মার্টিনেজ বা রদ্রিগো ডি পলরা মুখে হয়তো স্বীকার করবেন না, কিন্তু ফরাসি ঔপন্যাসিক আলেকজান্ডার দ্যুমার বিখ্যাত উপন্যাস 'থ্রি মাস্কেটিয়ার্স' এর মাস্কেটিয়ারদের শপথবাক্য থেকে তাঁরা নিশ্চিতভাবেই অনুপ্রাণিত, "ওয়ান ফর অল, অ্যান্ড অল ফর ওয়ান..."
রাজার জন্য এক কথায় জীবন দিতে পারতেন মাস্কেটিয়াররা, আকাশি-সাদার 'মাস্কেটিয়ার'দের কাছে মেসি তো রাজাই!