৫৮ বছর ধরে যেভাবে 'অভিশাপে' পুড়ছে ইংল্যান্ড
ইউয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ সাফল্য গত আসরে রানার্স-আপ হওয়া। এর সাথে বড় টুর্নামেন্ট হিসেবে বিশ্বকাপকে ধরলে, ১৯৬৬ সালে শিরোপা জয়। ‘৬৬-এর ওই সাফল্যের পর কেটে গেছে ৫৮টি বছর, কিন্তু ইংল্যান্ডের আর সাফল্য পাওয়া হয়নি। তবে গ্যারেথ সাউদগেটের শিষ্যরা টানা দ্বিতীয়বারের মতো উঠে গেছে ইউরোর ফাইনালে। এবার কি কাটবে ইংল্যান্ডের ফাঁড়া?
সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে শীঘ্রই, তবে এর আগে চলুন ফিরে দেখা যাক গত পাঁচ যুগে বড় টুর্নামেন্ট থেকে ইংল্যান্ডের বিদায় নেওয়ার দশটা হৃদয়বিদারক ঘটনা।
১। ম্যারাডোনা এবং ‘হ্যান্ড অব গড’ (কোয়ার্টার ফাইনাল, বিশ্বকাপ ১৯৮৬)
১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ইংল্যান্ডের বিদায় হয়েছিল আর্জেন্টিনার কাছে হেরে, কিংবা বলা ভালো, দিয়েগো ম্যারাডোনার কাছে হেরে। ম্যাচের ৫৫তম মিনিটে ছয়জনকে কাটিয়ে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলটা করেছিলেন ম্যারাডোনা, আর এর চার মিনিট আগেই করেছিলেন সর্বকালের অন্যতম বিতর্কিত গোল, তিনি নিজেই যেটাকে বলেছিলেন, ‘হ্যান্ড অব গড’।
ম্যারাডোনার সেই গোল; Image Source: Getty Images
ইংরেজ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের সামনে লাফিয়ে উঠে হাতের ছোঁয়ায় তাঁর মাথার ওপর দিয়ে বলটা জালে পাঠিয়ে দেন ম্যারাডোনা। তিউনিসিয়ান রেফারি আলী বেন নাসের গোল হিসেবেই বিবেচনা করেছিলেন সেটা, পরে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের প্রতিবাদের মুখে লাইনসম্যানের সাথে কথা বলে নিশ্চিত করেন। সেই গোলটার ক্ষত আজও বয়ে বেড়ান পিটার শিলটন। ম্যারাডোনা কখনোই ওই গোলের জন্য অনুতপ্ত হননি, শিলটন এই কথা বলেছিলেন ২০২০ সালে।
২। টাইব্রেকারে হৃদয়ভঙ্গ (সেমিফাইনাল, বিশ্বকাপ ১৯৯০)
বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু ফাইনালে ওঠার স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি তাঁদের। ম্যাচের নির্ধারিত সময়ে আন্দ্রেয়াস ব্রেহমে এবং গ্যারি লিনেকারের ‘গোল বিনিময়ে’ ম্যাচটা গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। স্টুয়ার্ট পিয়ার্স এবং ক্রিস ওয়াডেলের ব্যর্থতায় সেমি থেকেই বিদায় নিতে হয় তাঁদের।
জার্মানির কাছে হেরে বিধ্বস্ত ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা; Image Source: Getty Images
তুরিনে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে হলুদ কার্ড দেখেছিলেন পল গাসকোয়েন। ইংল্যান্ড ফাইনালে উঠলেও নিষেধাজ্ঞার জন্য ম্যাচটা খেলা হতো না তাঁর। হলুদ কার্ড দেখার পরে গাসকোয়েনের ওই কান্নাভেজা চেহারাটা ইংল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম দুঃখের ছবি।
৩। টাইব্রেকার-হতাশা চলছেই (সেমিফাইনাল, ইউরো ১৯৯৬)
ইউরো ১৯৯৬-এর কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড। নির্ধারিত সময়ে গোলশূন্য থাকা ম্যাচের ফলাফল নিষ্পত্তির জন্য টাইব্রেকারের আশ্রয় নিতে হয়। ৪-২ ব্যবধানে ওই টাইব্রেকারে জেতে ইংল্যান্ড। কিন্তু ভাগ্যটা কি পাল্টালো ইংরেজদের?
পেনাল্টি মিস করলেন গ্যারেথ সাউদগেট; Image Source: PA
সেমিফাইনালে জার্মানির মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড। শুরুতেই অ্যালান শিয়ারারের গোলে এগিয়েও যায় দলটি, কিছুক্ষণ পরই সমতায় ফেরে জার্মানি। এরপর টাইব্রেকারে গড়ায় ম্যাচটা, পাঁচ-পাঁচে সমতার পরে শুরু হয় সাডেন ডেথ। সাডেন ডেথে গোল করে জার্মানি, মিস করে বিদায় নেয় ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের হয়ে কে মিস করেছিলেন জানেন? বর্তমান ম্যানেজার গ্যারেথ সাউদগেট।
৪। লাল কার্ড এবং আরো টাইব্রেকার-দুঃখ (রাউন্ড অব সিক্সটিন, বিশ্বকাপ ১৯৯৮)
নকআউট পর্বের ম্যাচগুলো এমনিতেই কঠিন, একটা লাল কার্ড ম্যাচগুলোকে আরো কঠিন করে দেয়। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেও ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছিল। বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল ইংল্যান্ড। ছয় মিনিটে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্ততার পেনাল্টি গোলে এগিয়ে যায় আলবিসেলেস্তেরা, দশম মিনিটে অ্যালান শিয়ারারের পেনাল্টি গোলেই সমতায় ফেরে ইংরেজরা। এরপর মাইকেল ওয়েনের গোলের বিপরীতে বল জালে জড়িয়ে দেন হাভিয়ের জানেত্তি। ২-২ সমতায় শেষ হয় ম্যাচ।
আরো একবার টাইব্রেকার-দুঃখ; Image Source: Getty Images
তবে ম্যাচের ৪৭তম মিনিটে দিয়েগো সিমিওনেকে লাথি মেরে লাল কার্ড দেখেছিলেন ডেভিড বেকহাম। এরপর টাইব্রেকারে পল ইন্স আর ডেভিড ব্যাটি গোলবঞ্চিত হতেই ৪-৩ ব্যবধানে পরাজয় নিশ্চিত হয় ইংল্যান্ডের।
তবে বেকহাম অবশ্য পরে তাঁর ‘প্রতিশোধ’টা ঠিকই নিয়েছিলেন। ২০০২ বিশ্বকাপে তাঁর গোলেই আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করে ইংল্যান্ড।
৫। এবং আরো টাইব্রেকার-দুঃখ… (কোয়ার্টার ফাইনাল, ইউরো ২০০৪)
ইংল্যান্ডের টাইব্রেকার-দুঃখ চলছেই, এবং তা অব্যাহত থাকলো ২০০৪-এর ইউরোতেও। কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে নির্ধারিত নব্বই মিনিট শেষ হয় ১-১-এ। এরপর অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটে আরো একটা করে গোল করে দুই দল। এরপর টাইব্রেকার… এবং ইংল্যান্ডের হৃদয়ভঙ্গ।
ইংল্যান্ডের টাইব্রেকার-দুঃখ চলছেই; Image Source: Getty Images
টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডের হয়ে পেনাল্টি মিস করেন ডেভিড বেকহাম, তবে ওই রুই কস্তার মিসে আবার সমতা চলে আসে। পরবর্তীতে সাডেন ডেথে ডেরিয়াস ভ্যাসেলের শট মিস হতেই কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় ইংল্যান্ডের।
৬। লাল কার্ড, রোনালদোর চোখ টিপ... এবং আবারও টাইব্রেকার-বেদনা (কোয়ার্টার ফাইনাল, বিশ্বকাপ ২০০৬)
ওই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড নিজেদের সেরা ছন্দে ছিল না। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে জয় এসেছিল আত্মঘাতী গোলে। ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর বিপক্ষে জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল শেষ মুহূর্তের দুই গোলের। এরপর রাউন্ড অব সিক্সটিনে বেকহামের একমাত্র গোলে ইকুয়েডরকে হারিয়ে দেয় দলটি।
লাল কার্ড দেখলেন রুনি; Image Source: Getty Images
কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড। ঘটনাবহুল ওই ম্যাচের নির্ধারিত সময়ের শেষ দিকে লাল কার্ড দেখেছিলেন ওয়েইন রুনি। মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়েছিলেন তাঁর তৎকালীন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সতীর্থ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সেই ব্যাপারটাও আলোচনার ঝড় তুলেছিল তখন, আর এরপর টাইব্রেকারে ৩-১ ব্যবধানে পরাজয় তো আছেই। ওয়েন হারগ্রিভস ছাড়া ইংল্যান্ডের আর কেউই গোল করতে পারেননি পেনাল্টি স্পট থেকে।
৭। গোললাইন বিতর্কের পর বড় হার (রাউন্ড অব সিক্সটিন, বিশ্বকাপ ২০১০)
৪-১ ব্যবধানটার দিকে তাকালে ব্যাপারটা বোঝা যায় না, তবে জার্মানদের কাছে ইংল্যান্ডের ওই পরাজয়টা সত্যিই ‘বিতর্কিত ছিল’। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রুপ পর্ব পেরোনোর পরে রাউন্ড অব সিক্সটিনে ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েছিল ইংল্যান্ড। এরপর একটা গোল শোধ করেন ম্যাথু আপসন।
বল গোললাইন পেরোলেও রেফারি এটাকে গোল হিসেবে ঘোষণা করেননি; Image Source: BBC
তবে ২-১ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকার সময়ে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের একটা শট গোললাইন পেরোলেও রেফারি সেটাকে গোল হিসেবে বিবেচনা করেননি। ল্যাম্পার্ডের ওই শটটা বারে লেগে গোললাইন পেরিয়েছিল, যেটা টিভি ক্যামেরাতেও ধরা পড়েছিল। কিন্তু উরুগুয়ের রেফারি হোর্হে ল্যারিওন্দা এবং অন্যান্য অফিশিয়াল খেলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। ওই সময়ে গোল হলে খেলার ফলাফল বদলাতো কিনা বলা কঠিন, কিন্তু ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে আরো দুটো গোল হজম করে বিদায় নেয় ইংল্যান্ড
৮। বিব্রতকর বিদায় (রাউন্ড অব সিক্সটিন, ইউরো ২০১৬)
আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগেই পরিষ্কার ফেভারিট ছিল ইংল্যান্ড। ম্যাচ শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তারা এগিয়েও গিয়েছিল ওয়েইন রুনির গোলে।
ইংল্যান্ডের বিব্রতকর পরাজয়; Image Source: Getty Images
কিন্তু পরের পনেরো মিনিটের মধ্যেই দুটো গোল হজম করে ফেলে ইংরেজরা। অবিশ্বাসে চোখ কচলাচ্ছিলেন কোচ রয় হজসন, ম্যাচেও আর ফেরা হয়নি ইংল্যান্ডের। বিদায় নিতে হয় ইউরোর রাউন্ড অব সিক্সটিন থেকেই।
৯। অতিরিক্ত সময়ের দুঃখ (সেমিফাইনাল, বিশ্বকাপ ২০১৮)
এই টুর্নামেন্ট থেকেই ইংল্যান্ডের পুনর্জাগরণের শুরু। সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়ার পরে শিরোপার স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিল দলটা। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের পঞ্চম মিনিটে কিয়েরান ট্রিপিয়েরের ফ্রি-কিক গোলে লিডও পেয়ে যায় দলটি।
ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিমর্ষ ইংল্যান্ড; Image Source: Getty Images
কিন্তু ইভান পেরিসিচের গোলে দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচে ফেরে ক্রোয়েশিয়া। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে, আর তাতে মারিও মানজুকিচের গোলে কপাল পোড়ে ইংরেজদের। তবে হ্যাঁ, এই টুর্নামেন্টের শেষ ষোলোতে কলম্বিয়াকে টাইব্রেকারে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড, টানা পাঁচ টাইব্রেকারে পরাজয়ের দৌড়টাও থামে তাতে।
১০। এবার ফাইনালে পেনাল্টি-দুঃখ (ফাইনাল, ইউরো ২০২০)
৫৮ বছরের মধ্যে এই পরাজয়টাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। ফাইনালের আগেই তীব্র হয়েছিল “ইটস কামিং হোম…” রবটা। ফাইনালেও লুক শয়ের গোলে দারুণ সূচনা পেয়েছিল দলটি।
ইতালির কাছে গত ইউরোর ফাইনালে হেরেছিল ইংল্যান্ড; Image Source: Getty Images
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে লিওনার্দো বনুচ্চির গোলে সমতায় ফেরে ইতালি। এরপর টাইব্রেকারে মার্কাস রাশফোর্ড, জেডন সাঞ্চো আর বুকায়ো সাকার মিসে শিরোপা অধরাই থাকে ইংল্যান্ডের।
ইংল্যান্ডের অভিশাপ কাটবে এবার? Image Source: Getty Images
তবে সেই দুঃখটা এবার ঘোচানোর সুযোগ থাকছে থ্রি লায়ন্সদের। আবারও ফাইনালে উঠে গেছে দলটি, এবার প্রতিপক্ষ স্পেন। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, হয়তো এবারই অভিশাপটা কাটাতে পারবে ইংল্যান্ড। হয়তো প্রথমবারের মতো ইউরো শিরোপাটা ধরা দেবে তাদের হাতে, ফুটবলও নিজেদের ‘বাড়ি’তে পৌঁছাবে অবশেষে!