• ইউরো ২০২৪
  • " />

     

    ফাইনাল মানেই স্প্যানিশদের জয়যাত্রা!

    ফাইনাল মানেই স্প্যানিশদের জয়যাত্রা!    

    পুরো টুর্নামেন্টে দাপটের সাথে খেলেই ফাইনালে উঠেছে স্পেন। অপ্টার সুপারকম্পিউটারের মতে, ফাইনালে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের চেয়ে একটু হলেও এগিয়ে থাকবে তারা। কিন্তু ম্যাচটা যেহেতু ফাইনাল, কতকিছুই ঘটতে পারে ওই নব্বই মিনিটে। শেষ লড়াইয়ের আগে দুই পরাশক্তির সম্ভাবনাকে তাই পঞ্চাশ-পঞ্চাশ হিসেবে ধরে নেওয়াই সঙ্গত। কিন্তু ফাইনালে যদি খেলে কোন একটা স্প্যানিশ দল, আদৌ কি সম্ভাবনার পাল্লাটা পঞ্চাশ-পঞ্চাশ সমতায় থাকে?

    ফাইনালে হারে না স্পেন! Image Source: Getty Images

    হিসাবের খাতিরে গত দুই দশককে গণনায় নেওয়া হোক, আরো পরিষ্কারভাবে বললে তেইশ বছর, স্পেন জাতীয় দল বা লা লিগার কোন দল হোক, ফাইনালে ওঠা মানেই তাদের জয় নিশ্চিত। বিশ্বকাপ, ইউরো, চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরোপা লিগ, এই সব প্রতিযোগিতায় গত তেইশ বছরে সব মিলিয়ে ছাব্বিশ বার ফাইনালে উঠেছে স্প্যানিশ দলগুলো। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, প্রতিটিতেই জয়ী হয়েছে তারাই। হ্যাঁ, চারটা ফাইনালে স্প্যানিশরা পরাজিতও হয়েছে, কিন্তু সেই সব ‘অল-স্প্যানিশ’ ফাইনালে তো একটা স্প্যানিশ দলকে পরাজিত হতেই হতো!

    ফাইনালে কোন নন-স্প্যানিশ দলের কাছে স্প্যানিশরা পরাজিত হচ্ছে, এই ঘটনা সর্বশেষ ঘটেছিল ২০০১ সালে। ওই বছরেই ইউয়েফা কাপের (বর্তমান ইউরোপা লিগ) ফাইনালে আলাভেসের মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল। নির্ধারিত নব্বই মিনিটে ৪-৪ সমতায় থাকা ম্যাচটা গড়িয়েছিল অতিরিক্ত সময়ে। সেই অতিরিক্ত সময়ে আবার আত্মঘাতী গোল করে বসেন আলাভেসের ডেলফি গেলি। ৫-৪ গোলে এগিয়ে যায় লিভারপুল, ‘গোল্ডেন গোল’ নিয়মের অধীনে খেলাটাও শেষ হয়ে যায় সাথে সাথে।

    ওই একই বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও বায়ার্ন মিউনিখের কাছে পেনাল্টি শুটআউটে হেরেছিল স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া। সে-ই শেষ! এরপর থেকে ফাইনাল মানেই স্প্যানিশদের জয়। 

    অল-স্প্যানিশ ফাইনালগুলো বাদ দিলে এই সময়ে ২২টা ফাইনালে জয়ী হয়েছে স্প্যানিশরা। এর মধ্যে স্পেন জাতীয় দল জিতেছে তিনটা ফাইনালে। ২০০৮ এর ইউরোর ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে, ২০১০ এর বিশ্বকাপের ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে, এবং ২০১২ এর ইউরোর ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে, টানা তিনটা বড় টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছিল স্পেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ফিফা কনফেডারেশন কাপের ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ৩-০ ব্যবধানে হেরেছিল স্পেন, ২০২১ সালে ফ্রান্সের কাছে ২-১ ব্যবধানে হেরেছিল ইউয়েফা নেশনস লিগের ফাইনালে। কিন্তু টুর্নামেন্ট হিসেবে কনফেডারেশন কাপ বা নেশনস লিগকে তো নিশ্চয়ই বিশ্বকাপ-ইউরোর কাতারে রাখবেন না কেউ!

    ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী স্পেন দল; Image Source: Getty Images

    জাতীয় দলকে বাদ রেখে স্পেনের ক্লাব পর্যায়ে তাকালে দেখা যায়, নন-স্প্যানিশ দলগুলোর বিপক্ষে গত তেইশ বছরে সর্বোচ্চ ফাইনাল জিতেছে সেভিয়া। ছয়টা ফাইনাল জিতেছে তারা, বলা বাহুল্য, সবই সাবেক ইউয়েফা কাপ বা বর্তমান ইউরোপা লিগের ফাইনাল। ২০০৬ সালে ইউয়েফা কাপের ফাইনালে মিডলসব্রোকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে জয়যাত্রা শুরু করে সেভিয়া। পরের বছরেই, একই মঞ্চে স্বদেশী ক্লাব এসপানিওলকে টাইব্রেকারে হারিয়ে শিরোপা জেতে তারা। পরবর্তী সাফল্যটা এলো ২০১৪ সালে, ইউয়েফা কাপ ততদিনে নাম পাল্টে পরিণত হয়েছে ইউয়েফা ইউরোপা লিগে। ওই বছর বেনফিকাকে টাইব্রেকারে হারায় সেভিয়া। ‘১৫ আর ‘১৬ সালেও এলো একই সাফল্য। ইউরোপা লিগের ফাইনালে যথাক্রমে ইউক্রেনের ক্লাব দিনিপ্রো আর ইংল্যান্ডের ক্লাব লিভারপুলকে হারিয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতে সেভিয়া। এরপর ২০২০ সালে ইন্টার মিলান আর ২০২৩ সালে রোমাকে হারিয়ে সেভিয়া অব্যাহত রাখে তাদের ফাইনালের অপরাজিত যাত্রা।

    সাফল্যের বিচারে সেভিয়ার পরেই রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। এই সময়কালে সাতটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে তারা, যার মধ্যে ২০১৪ এবং ২০১৬ সালের ফাইনাল ছিল স্বদেশী ক্লাব অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে। এর বাইরে ২০০২ সালে বেয়ার লেভারকুসেন, ২০১৭ সালে জুভেন্টাস, ২০১৮ ও ২০২২ সালে লিভারপুল এবং ২০২৪ সালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে পরাজিত করে দলটি।

    চ্যাম্পিয়নস লিগ মানেই রিয়াল মাদ্রিদের রাজত্ব; Image Source: Getty Images

    রিয়াল মাদ্রিদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা এই শতাব্দীতে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জিতেছে চারবার, প্রতিবারই কোন না কোন নন-স্প্যানিশ দলকে হারিয়ে। ‘০৬-এ আর্সেনাল, ‘০৯ ও ‘১১-তে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ২০১৫ সালে জুভেন্টাস ফাইনালে হেরেছিল দলটির কাছে।

    এর বাইরে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ দুইবার, এবং ভিয়ারিয়াল ও ভ্যালেন্সিয়া একবার করে নন-স্প্যানিশ দলকে ফাইনালে পরাজিত করে শিরোপার স্বাদ পেয়েছে।

    প্রশ্ন আসতেই পারে, একটা দেশের জাতীয় দল এবং ক্লাবগুলোর এমন আধিপত্য কি ফুটবল-বিশ্ব আগে কখনো দেখেছে?

    উত্তরটা সহজ। না। সত্তর আর আশির দশকে ইংলিশ দলগুলো বেশ রাজত্ব করছিলো, কিন্তু তাদের ফাইনাল-রেকর্ডও এখনকার স্প্যানিশদের মতো ভালো ছিল না। লিভারপুল, নটিংহ্যাম ফরেস্ট, অ্যাস্টন ভিলার মতো দলগুলো ইউরোপ-সেরার মুকুট পরেছিল সত্যি, কিন্তু ১৯৮০ সালে ভ্যালেন্সিয়ার কাছে কাপ উইনার্স কাপের ফাইনালে হেরেছিলো আর্সেনাল। 

    জার্মান দলগুলোও ওই সময়ে বেশ শক্তিশালী ছিল। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬, টানা তিন বছরে ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ) জিতেছিল বায়ার্ন মিউনিখ। কিন্তু এরপ লিভারপুলের কাছে বরুশিয়া মনশেনগ্লাডবাখ হেরে যাওয়ায় জার্মানদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ব্যাপারটা আর থাকেনি।

    ষাটের দশকে ইতালীয় দলগুলোকে দেখা যেত ইউরোপে ছড়ি ঘোরায়ে। এসি মিলান, ইন্টার মিলানের মতো দলগুলো ইউরোপিয়ান কাপ জিততো, ফিওরেন্টিনা জিতেছিল একটা কাপ উইনার্স কাপ। কিন্তু কাপ উইনার্স কাপের পরের আসরের ফাইনালেই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে হেরে ইতালীয়দের অপরাজিত থাকার ব্যাপারটার ইতি টানে ফিওরেন্টিনা। আশি আর নব্বই দশকও ইতালীয়দের সুসময় ছিল। এই সময়ে ইতালির ক্লাবগুলো জিতেছিল আটটা ইউয়েফা কাপ, তিনটা কাপ উইনার্স কাপ আর চারটা ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়নস লিগ। কিন্তু একই সময়ে বিদেশী দলগুলোর কাছে নয়টা ফাইনালও হেরেছিল তারা।

    সেভিয়া যেন ইউরোপা লিগের 'রিয়াল মাদ্রিদ'; Image Source: Getty Images

    তাহলে ফাইনালে স্প্যানিশ দলগুলোর এমন আধিপত্যের কারণ কী?

    “স্প্যানিশ ফুটবলটা আসলে অনেকগুলো ব্যাপারের যোগফল,” অ্যাস্টন ভিলার ম্যানেজার উনাই এমেরি বলেছিলেন, যিনি একটা সময়ে শিরোপা জিতিয়েছেন সেভিয়া আর ভিয়ারিয়ালকেও, “আমাদের ফুটবলের মেথোডোলজি এবং কার্যপ্রক্রিয়া যেমন, যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, ক্লাব ও ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শিশুদের যেভাবে ট্রেনিং করানো হয়, এই সবগুলো ব্যাপারের যোগফলই স্প্যানিশ ফুটবল।”

    “পেপ গার্দিওলাসহ স্প্যানিশ কোচদের যোগ্যতার ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। তাঁরা শিরোপা জিতে অভ্যস্ত এবং অন্যান্য দেশের ক্লাবের সাথে পাল্লা দিতে যথেষ্ট পারঙ্গম।”

    স্প্যানিশ ক্লাবগুলোর আর্থিক সক্ষমতাও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্যের পেছনে অন্যতম বড় কারিগর যে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, করিম বেনজেমা, গ্যারেথ বেল, লুকা মদরিচ, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, জুড বেলিংহামরা, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই ‘বিগ মানি সাইনিং’।

    বড় বড় সাইনিং করাতে দেখা গেছে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনাকেও। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে তারা ফিরে গেছে তাদের একাডেমি লা মাসিয়ার কাছেই, যে লা মাসিয়া অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল বার্সা আর স্পেনের স্বর্ণযুগে। কার্লেস পুয়োল, জেরার্দ পিকে, সার্জিও বুসকেটস, জাভি হার্নান্দেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সেস্ক ফ্যাব্রিগাস কিংবা লিওনেল মেসি, প্রত্যেকেই লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা। এখনকার লামিন ইয়ামাল, পাবলো গাভি, আলেহান্দ্রো বালদে, পাউ কুবারসিরাও এসেছেন লা মাসিয়া থেকেই।

    লা মাসিয়ার দিকেই আবার ঝুঁকেছে বার্সেলোনা; Image Source: Getty Images

    “গত দশ বছরে রিয়াল মাদ্রিদ দেখিয়ে দিয়েছে দল পরিচালনা এবং সাফল্য ধরে রাখার দক্ষতায় কেন তারা বিশ্বসেরা,” এমেরি বলেন, “গত কয়েক বছর বাদ দিলে বার্সেলোনাও বেশ ভালো করেছে। এদের সাথে ভিয়ারিয়াল, ভ্যালেন্সিয়া, সেভিয়া, অ্যাটলেটিকোর মতো দলগুলোও ট্রফি জিতেছে।”

    অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের শিরোপা জয়ের পেছনে দিয়েগো সিমিওনের অবদানই সবচেয়ে বেশি বলে ধরা হয়। গত দশকে ছোট ক্লাব থেকে অ্যাটলেটিকোকে ধীরে ধীরে বড় দলের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি।

    ওদিকে সেভিয়ার সাফল্য নিয়ে কথা বলেছিলেন সাবেক কোচ হোসে লুইস মেন্দিলিবার, “আমাদের পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয় দল হিসেবে, অন্যান্য দেশে সেটা মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমাদের বয়সভিত্তিক দলগুলোও মূল দলের মতো করেই খেলে, একই আইডিয়ার ভিত্তিতে তাদের তৈরি করা হয়। স্পেনে খেলাধুলার প্রতি মানুষের প্যাশন অনেক। এখানকার সংস্কৃতিও অনেক ক্ষেত্রে খেলা-কেন্দ্রিক। শুধু ফুটবল নয়, টেনিস, বাস্কেটবল, মোটর রেসিংয়েও।”

    “তবে হ্যাঁ,” মেন্দিলিবার আরো বলেন, “স্প্যানিশ ব্র্যান্ডের মূল ব্যাপারটা অবশ্যই ফুটবল। ফুটবলই স্পেনকে একতাবদ্ধ করে, ফুটবলই বিশ্বের সামনে স্পেনকে তুলে ধরে।”

    আরো একটা ফাইনাল জিততে চলেছে স্পেন? Image Source: Getty Images 

    সেই ফুটবল দিয়েই আরো একবার ইউরোপের সামনে নিজেদের তুলে ধরেছে স্পেন, আরো একটা ইউরোর ফাইনালে উঠে গেছে দলটি। রুপোলি ট্রফিটার ছোঁয়া পেতে শেষ বাধাটার নাম ইংল্যান্ড। তবে কে না জানে, গত দুই যুগে ফাইনাল মানেই তো স্প্যানিশদের জয়যাত্রা, স্পেনের সমর্থকেরা তাই উল্লাসের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেই পারেন!