• ইউরো
  • " />

     

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ১০

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ১০    

    ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত ইউরোতে একাধিকবার শিরোপাজয়ী দল ছিল একটাই। পশ্চিম জার্মানি। এই আসরে দলটি মাঠে নামে তাদের নাম বদলে। তবে ‘পশ্চিম জার্মানি’ থেকে ‘জার্মানি’ হলেও, অতীত রেকর্ডের কারণে দলটার নামের সাথে জড়িয়ে ছিল ফেভারিট তকমাটাও, যদিও শক্তিশালী ইংল্যান্ডের মাটিতে ট্রফি জেতাটা একেবারেই সহজ ছিল না এর আগে দুইবারের চ্যাম্পিয়নদের।

    ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর চলাকালে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের দশম পর্বে থাকছে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর দশম আসর আর জার্মানির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।

    Image Source: Getty Images

    কেমন ছিল সেই ইউরো?

    ইউরোর এই আসরের আগ পর্যন্ত শুধু জার্মানিরই একাধিক শিরোপা জয়ের অভিজ্ঞতা ছিল, তবে সেই শিরোপাগুলো তারা জিতেছিল "পশ্চিম জার্মানি" নামে। এই টুর্নামেন্টটা ছিল জার্মানদের তৃতীয় ইউরোপীয় ট্রফি, ওদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড তখনো খুঁজে চলেছে সাফল্যের বাতিঘর।

    ইউরোর '৯৬-এর আসরটা অনেক ক্ষেত্রেই রয়ে যায় মানুষের স্মৃতির আড়ালে। তবে এই আসরেই প্রথমবারের মতো ১৬টা দল অংশগ্রহণ করে। যদিও ব্যাপারটা শুরুতেই সফলতার মুখ দেখেনি। দলগুলোর খেলা ছিল অনেকটা রক্ষণাত্মক, দর্শক-উপস্থিতিও ছিল অনেক কম। এমনকি নকআউট পর্বেও চোখে পড়ছিলো গ্যালারির ফাঁকা আসন। পুরো আসরের পাশাপাশি ওই জার্মানি দলের ব্যাপারে মানুষের স্মৃতিতেও ধুলো জমে। প্রাপ্য কৃতিত্ব পাওয়া হয় না তাদের।

    ম্যানেজার

    বার্টি ভটস যে একদিন জার্মানির ম্যানেজার হবেন, এটা ভবিতব্যই ছিল। খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি খেলেছেন কেবল একটাই ক্লাবে, বরুশিয়া মনশেনগ্লাডবাখে। ক্লাবের হয়ে পাঁচ শতাধিক ম্যাচ খেলা এই ডিফেন্ডার জাতীয় দলেও খেলেছেন অনেক দিন। পশ্চিম জার্মানির হয়ে ইউরো'৭২ আর বিশ্বকাপ'৭৪-ও জিতেছিলেন তিনি। অবসরের পরে জার্মানির অনূর্ধ্ব-২১ দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব নেন, এরপর জাতীয় দলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। ১৯৯০ সালে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ম্যানেজারের দায়িত্ব ছেড়ে দিলে সেই জায়গায় অধিষ্ঠিত হন ভটস।

    বার্টি ভটস; Image Source: Getty Images

    জাতীয় দলে ভটস ভালো-মন্দ দুটো পর্যায়ই দেখেছেন। দুটো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে তাঁর দল বাদ পড়েছিল। কাগজে কলমে অনেক দলের জন্য সেটা হয়তো খুব বড় ব্যর্থতা নয়, কিন্তু টানা তিন বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা জার্মানির জন্য ব্যর্থতাই বটে। এর আগে পশ্চিম জার্মানি ছিল দুর্দান্ত দল, আর দুই জার্মানি একীভূত হওয়ার পর দলটাকে অপরাজেয় হয়ে ওঠার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। ওদিকে ভটসও তখন পর্যন্ত ক্লাব থেকে পাওয়া স্বল্প জ্ঞান দিয়ে তেমন কিছু অর্জন করতে পারেননি।

    তবে ১৯৯৬ সালে কোচিং এবং ম্যানেজমেন্টের জন্য কৃতিত্বটা তাঁর প্রাপ্য। মাঠের বাইরে, দলের ড্রেসিংরুমে যেন অপ্রয়োজনীয় কোন ব্যাপার না ঘটে, সেই ব্যাপারগুলো দেখভাল করেছিলেন তিনি। তাঁর উপস্থিতি দলের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে ভেবে লোথার ম্যাথাউসের মতো কিংবদন্তিকেও দলে ডাকেননি ভটস। বোদো ইলনার এবং স্টেফান এফেনবার্গের মতো ক্যারিয়ারের শেষের দিকে থাকা তারকাদেরও দলের বাইরে রেখেছিলেন তিনি। মাঠেও তাঁর ট্যাকটিক্সের সাথে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর খেলোয়াড়েরা। খেলোয়াড়দের চোট-নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটাও চমতকারভাবে সামলে নিয়েছিলেন তিনি। প্রেস করে খেলার গুরুত্বটা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই দেখিয়েছিলেন তিনি।

    মূল খেলোয়াড়

    পূর্ব জার্মানির ১৯৯০ বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন ম্যাথিয়াস সামার। '৯২-এর ইউরোতে মিডফিল্ডার হয়েও তাঁর গোল করার চেষ্টা অনেকের চোখ কেড়েছিল। ওই টুর্নামেন্টে দারুণ পারফরম্যান্সের পরই সিরিআতে পাড়ি জমান তিনি। তবে ইন্টার মিলানের হয়ে তাঁর প্রথম অর্ধ-মৌসুমটা একেবারে ভালো যায়নি, তাই তিনি আবারও ফিরে যান বুন্দেসলিগার ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ভূমিকায় খেলে সতেরো ম্যাচে দশ গোল করেছিলেন তিনি। 

    ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার বা লোথার ম্যাথাউসের মতো জার্মান কিংবদন্তির মতো ম্যাথিয়াস সামারও ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে তাঁর খেলার জায়গা পরিবর্তন করেন। মিডফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরবর্তীতে সুইপার ভূমিকায় খেলতে থাকেন তিনি, তাতে ‘ভালো’ খেলোয়াড় থেকে ‘কিংবদন্তির’ পর্যায়ে পৌঁছে যান তিনি। দুটো বুন্দেসলিগা জিতেছিলেন, ১৯৯৭-এর ইউরোপিয়ান কাপে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে।

     

    ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গোল করছেন ম্যাথিয়াস সামার; Image Source: Getty Images

    এই পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই দারুণ খেলেছিলেন সামার। অন্যান্য ডিফেন্ডারের পেছনে তাঁর ফ্রি রোলে খেলা, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় উপস্থিত হয়ে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নেওয়া, প্রতিটা ব্যাপারেই সামার ছিলেন একেবারে ঠিকঠাক। নিজের স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে রক্ষণ থেকে আক্রমণে উঠে যেতেন তিনি, গ্রুপ পর্বে রাশিয়ার বিপক্ষে গোলও পেয়েছিলেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচেও বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। রান নিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। প্রতিপক্ষকে হ্যান্ড বলে বাধ্য করে প্রথম পেনাল্টিটা তিনিই অর্জন করেছিলেন, ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান সেটা থেকে গোল পেতে ভুল করেননি। এরপর দ্বিতীয় গোলের ক্ষেত্রে তাঁর হেডটা ব্লকড হয়েছিল, তবে ফিরতি শটে বলকে জালে পাঠাতে ভুল করেননি একেবারেই।

    ট্যাকটিক্স

    সাদা চোখে দেখলে, পূর্বের মতো ৩-৫-২ ফরমেশনেই খেলেছিল জার্মানি। কিন্তু ভটসের সিস্টেমে কিছুটা পরিবর্তন ছিল। তাঁর দলে ছিলেন দারুণ সৃজনশীল সুইপার ম্যাথিয়াস সামার, দুইজন দুর্দান্ত প্রতিভাবান প্লেমেকার আন্দ্রেয়াস মোলার এবং থমাস হ্যাসলার। মাঝমাঠে দিয়েতের এইল্টসের সামনে দায়িত্ব ছিল হোল্ডিং মিডফিল্ডারের ভূমিকায় খেলার, সামার আক্রমণের জন্য উপরের দিকে উঠলে তিনি নিচে নেমে তাঁর ফেলে আসা জায়গাটা পূরণ করতেন। টুর্নামেন্টে জার্মানির দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড়ও তিনিই ছিলেন।

    তবে ভটসের সিস্টেমের বিশেষত্ব ছিল তাঁর খেলোয়াড় পরিবর্তনে। নিয়মিত খেলোয়াড় পরিবর্তন করার কারণে কোন নির্দিষ্ট ফরমেশনে খেলাতেন না তিনি। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ ম্যাচের আগে দলে তিনটা করে পরিবর্তন এনেছিলেন ভটস। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়ার আগে দলে এনেছিলেন দুটো পরিবর্তন, একই সাথে জার্মানির খেলার ধরনেও পরিবর্তন আনেন। ৩-৫-২ এর পরিবর্তে জার্মানি ওই ম্যাচে খেলে ৩-৫-১-১-এ। সবার সামনে মাত্র একজন স্ট্রাইকারের সাথে ওই ম্যাচে খেলানো হয় হোল্ডিং মিডফিল্ডার স্টেফান ফ্রয়েন্ডকে। ভটস ঠিকই বুঝেছিলেন, ওই ম্যাচে সাসপেন্ড হওয়া গ্যারি নেভিলের পরিবর্তে ইংল্যান্ড খেলাবে পল ইন্সকে। এর মাধ্যমে ইংল্যান্ড মাঝমাঠকে আরো শক্তিশালী করে আটকে দিতে চাইবে জার্মানদের।

    Image Source: The Athletic

    ওদিকে ভটসের পরিবর্তনগুলো ছিল মূলত চোট এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে, একই সাথে দলর আক্রমণভাগে কিছু পরিবর্তন এনে প্রতিপক্ষকে ধন্দে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। ক্লাসিক নম্বর নাইন ফ্রেডি ববিক আর বাম পায়ের স্টেফান কুন্টজকে নিয়েই চেক রিপাবলিকের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে জিতেছিলেন তিনি। এরপর ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান আর অলিভার বিয়েরহফকে নিয়ে ৩-০ ব্যবধানে জিতেছিলেন রাশিয়ার বিপক্ষে। পরের দুটো ম্যাচে আবার তিনি নামিয়েছিলেন ক্লিন্সম্যান আর ববিককে, আর সেমিফাইনালে ওপরে খেলেছিলেন শুধুই কুন্টজ। ফাইনালে আবার কুন্টজ-ক্লিন্সম্যান জুটিতেই ভরসা রেখেছিলেন তিনি।

    মূল একাদশে বারবার এত পরিবর্তন এনেও একটা বড় টুর্নামেন্ট জেতার এমন নজির খুবই বিরল।

    জেনে অবাক হবেন যে…

    সেমিফাইনালের আগে, নিজেদের একাদশ সাজানোর সময়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল জার্মানিকে। চোট এবং সাসপেনশনে দুজন খেলোয়াড়ের ঘাটতি ছিল জার্মানির একাদশে। ইউয়েফার পক্ষ থেকে পরবর্তীতে দুজন খেলোয়াড়কে যুক্ত করার সুযোগ দেওয়া জার্মানিকে। তবে এর আগেই ব্যাকআপ গোলরক্ষক অলিভার কান এবং অলিভার রেকের নাম লেখা জার্সিও তৈরি করে রেখেছিল জার্মান টিম ম্যানেজমেন্ট, যেন প্রয়োজনে তাঁদেরকে আউটফিল্ড খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামানো যায়।

    “জার্মানির পাঁচজন খেলোয়াড় ইতোমধ্যেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছেন,” ইউয়েফার বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, “ইয়ুর্গেন কোহলার, মারিও বাসলার আর ফ্রেডি ববিক দীর্ঘমেয়াদী চোটে পড়েছেন। আর স্টেফান রয়টার আর আন্দ্রেয়াস মোলার ছিটকে গেছেন নিষেধাজ্ঞায়।”

    নিষেধাজ্ঞার কারণে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিতে খেলতে পারেননি আন্দ্রেয়াস মোলার; Image Source: Getty Images

    চোটের ব্যাপারটা অনুমেয়, কিন্তু খেলোয়াড়দের নিষেধাজ্ঞার ফলে জার্মানি দলকে খেলোয়াড় যুক্ত করতে দেওয়ার এই অনুমতিটা ভালো চোখে দেখেননি দেখেননি। তবে একইভাবে একজন খেলোয়াড় যুক্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল চেক রিপাবলিককেও, যদিও তারা সেই সুযোগটা গ্রহণ করেনি।

    তবে জার্মানি সুযোগটা নিয়েছিল। ফাইনালের আগে হোল্ডিং মিডফিল্ডার জেন্স টডকে দলে টেনেছিলেন ভটস। তবে ওই এক ম্যাচের জন্য ইংল্যান্ডে উড়ে গেলেও, ফাইনালের স্কোয়াডে আর তাঁকে রাখেনি টিম ম্যানেজমেন্ট।

    ফাইনাল ম্যাচ

    টুর্নামেন্ট শুরুর আগে চেক রিপাবলিককে ফেভারিটদের কাতারে কেউ রাখেননি। কিন্তু তারা ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিলো ফাইনাল পর্যন্ত, আর শিরোপা জিতলে সেটা হয়তো ছাড়িয়ে যেত চার বছর আগের ডেনমার্ক’বিস্ময়কেও।

    দুই দলই ফাইনাল ম্যাচটা শুরু করেছিল বেশ সতর্কভাবে। মাঝবিরতির পরে দুই দল একটু বেশি আক্রমণাত্মক হয়। জার্মান মিডফিল্ডার দিয়েতের এইল্টস চোটে পড়ে মাঠ ছাড়েন, তাঁর জায়গা নেন উইংব্যাক মার্কো বোদে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ফলে লেফটব্যাক ক্রিস্টিয়ান জিয়েগেকে মাঝমাঠে সরে আসতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এইল্টসের মতো পজিশনাল সেন্স তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি বল পায়ে দারুণভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারতেন, আর ফাইনালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ও তিনিই ছিলেন।

    বার্গারের গোলে এগিয়ে যায় চেক রিপাবলিক; Image Source: Getty Images

    তবে ম্যাচের প্রথম গোলটা এসেছিল চেকদের পা থেকেই। চেকদের গতির বিপক্ষে একটু হলেও ধুঁকছিলেন জার্মান সুইপার ম্যাথিয়াস সামার। ওদিকে রাইট উইং ধরে বারবার আতঙ্ক তৈরি করছিলেন পোবোরস্কি। এমনই এক আক্রমণের বিপক্ষে সামার নিজেদের বক্সে ফাউল করে বসেছিলেন পোবোরস্কিকে। সেই পেনাল্টি থেকে জোরালো শটে গোল করেন প্যাট্রিক বার্গার। 

    তবে ম্যাচের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন পরিবর্তিত খেলোয়াড়রাই। চেক রিপাবলিক মাত্র একজন খেলোয়াড়কে পরিবর্তন করেছিল, সেই ভ্লাদিমির স্মাইসার আবার শেষ মুহূর্তে গোলও করে ফেলেছিলেন প্রায়। তবে সব মিলিয়ে, জার্মান সাবস্টিটিউটরাই বেশি প্রভাব রেখেছিলেন ম্যাচে।

    ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত

    দিয়েতের এইল্টস ফাইনালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন বটে, তবে অবিসংবাদিত নায়ক ছিলেন অলিভার বিয়েরহফই। ব্যাপারটা একটু হলেও আশ্চর্যজনক, কেননা প্রথম ম্যাচগুলোতে তিনি নিয়মিত ছিলেন না। একই সাথে, আগের পাঁচ বছর ইতালির ঘরোয়া ফুটবলে খেলায় নিজের দেশে তিনি কটু হলেও অপরিচিত ছিলেন। এই ইউরোর মাত্র চার মাস আগে জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁর অভিষেক হয়। ডেনমার্কের বিপক্ষে জোড়া গোলও করেন তিনি।

    তবে বিয়েরহফ কিন্তু জার্মানির প্রথম পছন্দের ফরোয়ার্ড ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভটসের ‘প্ল্যান বি’। মূলত টার্গেটম্যান হিসেবে তাঁকে খেলাতেন তিনি। হেডিংটা বেশ ভালো পারতেন বিয়েরহফ, তাই গোলের প্রয়োজন হলেই তাঁকে স্মরণ করতেন ভটস। দুর্দান্ত একজন ‘সুপার সাব’ হিসেবে মাঠে নিজের কাজটা কাজটা করতেন বিয়েরহফ।

    ফাইনালে প্লেমেকার মেহমেট স্কোলকে উঠিয়ে বিয়েরফকে নামিয়েছিলেন কোচ ভটস। আর মাঠে ম্নামার মাত্র চার মিনিটের মধ্যেই ম্যাচে সমতা ফেরান বিয়েরহফ, জিয়েগের ইনসুইঙ্গিং ফ্রিকিকটা হেড করে জালে জড়িয়ে।

    গোল্ডেন গোলের পর বিয়েরহফের উল্লাস; Image Source: Getty Images

    কিন্তু ওই এক গোলেই বিয়েরহফের কাজ শেষ হয়নি। ম্যাচটা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়, ভেসে আসা লং বলটাকে ফ্লিক করে ক্লিন্সম্যানের কাছে পাঠিয়ে দেন বিয়েরহফ। ক্লিন্সম্যানও চিপ করে ফিরিয়ে দেন বলটা। এরপর বিয়েরহফ দারুণ এক টার্ন নিয়ে ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে সামনে যান, এরপর বাঁ পায়ের জোরালো শটে গোল করেন। শটের পরে বলটা প্রতিপক্ষের এক ডিফেন্ডারের পা ছুঁয়ে যায়, আর সাথে ছিল বল আটকানোর ক্ষেত্রে গোলরক্ষক পেত্র কুবার ভুল। চেক খেলোয়াড়েরা অবশ্য অভিযোগ করছিলেন, অফসাইডে দাঁড়িয়ে থাকা কুন্টজের কারণে কুবার সেভ করার চেষ্টা প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হয়েছে, তবে রেফারি গোল বাতিল করেননি।

    ব্যস। ওখানেই খেলা শেষ। প্রথমবারের মতো কোন বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালের ফলাফল নির্ধারিত হলো ‘গোল্ডেন গোল’ নিয়মে। পুরো টুর্নামেন্টের সপ্তম নকআউট ম্যাচ ছিল এটা, এর মধ্যে পাঁচটা ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে, আর এই একমাত্র ম্যাচই নিষ্পত্তি হয় গোল্ডেন গোলে। গোল্ডেন গোলের নিয়ম জানা থাকায় দুটো দলই ভুল করার ব্যাপারে বেশ সতর্ক ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোলরক্ষক কুবার ভুলেই শিরোপা জেতা হলো না চেক রিপাবলিকের।

    জার্মানি কি ইউরোপের সেরা দল ছিল? 

    সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে হারা ইংরেজরা হয়তো একমত হতে চাইবেন না, তবে ওই জার্মানিই ছিল ইউরোপের সেরা।

    ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে সাজানো গ্রুপে জার্মানি ছিল ‘গ্রুপ অব ডেথ’-এ। চেক রিপাবলিক, ইতালি, রাশিয়াকে পেরিয়ে জার্মানি পরের রাউন্ডে উঠেছিল কোন গোল হজম না করেই। শারীরিক ফুটবলে পারদর্শী ক্রোয়েশিয়াকে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়েছিল দলটি, এরপর সেমিতে টাইব্রেকারে ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়। ওই টাইব্রেকারের শেষ পেনাল্টিটা মিস করেছিলেন গ্যারেথ সাউদগেট, ইংল্যান্ডের বর্তমান ম্যানেজার যিনি।

    যোগ্য দল হিসেবেই শিরোপা জিতেছিল জার্মানি; Image Source: Getty Images

    পুরো টুর্নামেন্টে খুব ভালো ফুটবল হয়েছে, এমনটা বলার সুযোগ নেই। ম্যাচপ্রতি গোল হয়েছে মাত্র ২.০৬ করে। তবে এর মাঝেও জার্মানি খেলেছে তাদের সুন্দর ফুটবলটা। নিজেদের কাজটা ঠিকঠাকই করেছিল জার্মানরা, আর ঘরে তুলেছিল রেকর্ড তৃতীয় ইউরো শিরোপা।