• লা লিগা
  • " />

     

    অ্যাথলেটিক বিলবাও এবং 'বাস্ক-নীতি'

    অ্যাথলেটিক বিলবাও এবং 'বাস্ক-নীতি'    

    ট্রফিসংখ্যার হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার পরে সবচেয়ে সফল স্প্যানিশ দলের নাম অ্যাটলেটিক বিলবাও। মজার ব্যাপার হলো, কোন বিদেশী খেলোয়াড় তো দূরের কথা, এই দলে জায়গা হয় না স্পেনের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরের খেলোয়াড়দের। প্রায় ১১৪ বছর ধরে শুধু বাস্ক অঞ্চলের খেলোয়াড়দের নিয়েই দল গঠন করে তারা। কিন্তু দলটি কেন এই অদ্ভুত প্রথাটি অনুসরণ করে? কীভাবে প্রচলন হলো এই অলিখিত নিয়মের? চলুন জেনে নেওয়া যাক এই নীতির আদ্যোপান্ত।

    ‘বাস্ক’ কী?

    Image Source: Britannica

    ‘বাস্ক’ বলতে মূলত ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। মোটাদাগে, স্পেন ও ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এই জাতিগোষ্ঠীর বাস। স্পেনের বিস্কে, গিপুজকো, আলাভা এবং নাভারা অঞ্চল এবং ফ্রান্সের ল্যাবোউর, সৌল এবং লোয়ার নাভারা অঞ্চলকে সাধারণভাবে বাস্ক বলা হয়। এই অঞ্চলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের বাস, এবং এদের মাতৃভাষা ‘বাস্ক’। 

    বাস্কদের সাথে অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের সম্পর্ক কী?

    বলে রাখা ভালো, বিলবাও হলো এই বাস্ক অঞ্চলের একটি শহর। স্পেনের উত্তরাঞ্চলের এই শহরে ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অ্যাটলেটিক ক্লাব’ বা ‘অ্যাটলেটিক বিলবাও’ ক্লাবটি। তবে শুরুতে কিন্তু ‘বাস্ক-অনলি’ প্রথাটা অনুসরণ করতো না ক্লাবটি, বরং ক্লাবটা চালাতেন তরুণ বাস্কদের সাথে ব্রিটিশ কর্মচারীরা মিলেই। বিদেশী খেলোয়াড়রাও তখন খেলতেন এই দলে।

    অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের ১৯১১ কোপা দেল রের দল; Image Source: Getty Images

    ১৯১১ সালে একটা ঘটনা ঘটে। অবৈধ বিদেশী খেলোয়াড় খেলানোর অভিযোগে অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের কোপা দেল রে শিরোপা কেড়ে নেওয়া হয় (পরবর্তীতে অবশ্য সেটা স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন কর্তৃক ফেরতও দেওয়া হয়েছিল)। পাশাপাশি ওই দশকেই পৃথিবীতে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যে কারণে বিদেশী খেলোয়াড়রা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে থাকেন। তখনই ক্লাব কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় শুধু নিজেদের খেলোয়াড় খেলানোর। বিলবাওয়ের সর্বশেষ বিদেশী খেলোয়াড় ছিলেন অ্যান্ড্রু ভেইচ। সমারসেটে জন্মগ্রহণ করা এই স্ট্রাইকার বিলবাওয়ের হয়ে শেষবারের মতো মাঠে নেমেছিলেন ১৯১১ সালের এপ্রিলে, লন্ডনের সিভিল সার্ভিস এফসির বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে।

    এরপর থেকেই অ্যাটলেটিক বিলবাও ক্লাবে সুযোগ পাওয়ার পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়ায় বাস্ক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা অথবা বেড়ে ওঠা।

    বাস্ক নীতির পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন

    একেবারে শুরুতে এই অলিখিত নিয়মের আওতায় ছিলেন শুধুই স্পেনের বিস্কে অঞ্চলের খেলোয়াড়রা। এরপর সত্তরের দশকে ‘অপারেসিওন রেতের্নো’ নামক নীতির আওতায় পুরো বাস্ক অঞ্চলের খেলোয়াড়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কয়েক বছর পরে, বাস্কের বাইরে জন্ম কিন্তু বাস্ক অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন, এমন খেলোয়াড়দেরও এই নীতির আওতায় আনা হয়।

    শেষোক্ত নীতির আওতায়ই অ্যাটলেটিক বিলবাওতে খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন আর্নেস্তো ভালভার্দে। স্পেনের পশ্চিমাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে বাস্ক অঞ্চলে বেড়ে উঠেছিলেন ভালভার্দে, সেই সুবাদেই তাঁর গায়ে ওঠে বিলবাওয়ের জার্সি। বর্তমানে তো কোচিংই করাচ্ছেন ক্লাবটিকে।

    আর্নেস্তো ভালভার্দে যখন বিলবাওয়ের খেলোয়াড়; Image Source: Athletic Club

    একইভাবে সুযোগ পেয়েছিলেন স্পেন জাতীয় দলের বর্তমান ম্যানেজার লুইস দে লা ফুয়েন্তে এবং সেন্টারব্যাক আয়মেরিক লাপোর্তে। দে লা ফুয়েন্তে জন্মেছিলেন লা রিওহাতে। কিন্তু বাস্ক অঞ্চলে বেড়ে ওঠা এবং পনেরো বছর বয়সে একাডেমীতে যোগদানের ফলে বিলবাওয়ের হয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পেরেছিলেন তিনি। বিলবাওয়ের জার্সিতে ২৩৩টা ম্যাচ খেলেছিলেন দে লা ফুয়েন্তে।

    লাপোর্তের গল্পটাও প্রায় একই। তাঁর জন্মও বাস্ক অঞ্চলের বাইরে, ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। তবে তিনিও বেড়ে উঠেছিলেন বাস্ক আবহাওয়ায়, এরপর পনেরো বছর বয়সে যোগ দেন যুবদলে। ২০১২ থেকে ২০১৮, এই বছরগুলোতে খেলেছেন অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের মূলদলে।

    “শুরু থেকেই এই নীতিটা প্রয়োগ করা হয়ে আসছে,” ১৯৯০ থেকে ২০০১-এর মধ্যে দুইবার অ্যাটলেটিকের বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হওয়া হুয়ান এলেহালদে বলেন, “এই নীতিটা কখনোই লিখিত ছিল না। তবে বোর্ড সদস্যরা সবসময়েই এই নীতির প্রয়োগ করে এসেছেন।”

    এই নীতি কি বিলবাওয়ের বৃহত্তর সাফল্যের অন্তরায়? 

    আগেই বলা হয়েছে, স্প্যানিশ দলগুলোর মধ্যে দুই পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদ (১০৫) এবং বার্সেলোনাকে (৯৯) আলাদা বন্ধনীতে রাখলে বাকিদলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ট্রফি জিতেছে অ্যাটলেটিক বিলবাওই (৩৬)। তবে ১৯৮৪ সালের পর কোন লিগ শিরোপা জেতেনি দলটি, এই সময়ে শিরোপা বলতে জিতেছে সুপারকোপা আর কোপা দেল রেই। এই সময়ে কয়েকটা ফাইনালও হেরেছে দলটি।

    কোপা দেল রের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অ্যাটলেটিক বিলবাও; Image Source: Getty Images

    সব মিলিয়ে, এই বাস্ক-নীতিকে বিলবাওয়ের সাফল্যের অন্তরায় বলা যেতে পারে, কিন্তু এই নীতিটাই বাস্কদের পৃথক করেছে অন্য সব ক্লাব থেকে। আর এই সাফল্য-খরাতেও আপত্তি নেই বিলবাও-সমর্থকদের, সাফল্যের চেয়ে এই নীতিতে অটল থাকাটাই বেশি জরুরি তাঁদের জন্য। এই নীতি থেকে সরে যাওয়ার চেয়ে যেন আত্মহত্যাও শ্রেয় তাঁদের কাছে! 

    “এই নীতিতে পরিবর্তন আনা যাবে না,” দলটির সাবেক খেলোয়াড় গয়কোয়েৎজিয়া বলেন, “অ্যাটলেটিকের এই নীতিটা অনেক অনেক বছর টিকে থাকবে। এই নীতির কারণেই আমরা সবার চেয়ে আলাদা। এই নীতি আমাদের ধরে রাখতেই হবে।”

    অ্যাটলেটিকের এই নীতিতে কি স্পেনের কোন উপকার হয়েছে?

    নিকো উইলিয়ামস এবং আয়মেরিক লাপোর্তে, দুজনেই এসেছেন অ্যাটলেটিক বিলবাও থেকে; Image Source: Getty Images

    এই বাস্ক-নীতির ফলে বাস্ক অঞ্চল থেকে বেশ কিছু ফুটবলার উঠে এসেছেন, ফলে আখেরে লাভটা হয়েছে স্পেনের ফুটবলেরই। আর্নেস্তো ভালভার্দে, লুইস দে লা ফুয়েন্তে, আয়মেরিক লাপোর্তেদের কথা তো বলা হলোই, এর পাশাপাশি তেলমো জারা, আরিজ আদুরিজ, ফার্নান্দো লরেন্তো, কেপা আরিজাবালাগা, নিকো উইলিয়ামসের মতো খেলোয়াড়রাও সুযোগ পেয়েছেন নিজেদের মেলে ধরার।

    এমন নীতি কি অন্য কোন দল অনুসরণ করে?

    বিলবাও এবং সোসিয়েদাদ, দুটো দলই মূলত বাস্ক অঞ্চলের ক্লাব; Image Source: Getty Images

    একই নীতি অনুসরণ করতো বাস্ক অঞ্চলের আরেকটা ক্লাব রিয়াল সোসিয়েদাদ। প্রায় ত্রিশ বছর বাস্ক অঞ্চলের বাইরের কোন খেলোয়াড়কে দলে টানেনি তারা, যদিও এর মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক দুরবস্থা। এই নীতির অবসান ঘটে ১৯৮৯ সালে লিভারপুল থেকে আয়ারল্যান্ডের স্ট্রাইকার জন অলড্রিজকে স্বাক্ষর করানোর মাধ্যমে। তবে এরপরও, ২০০২ সাল পর্যন্ত কোন নন-বাস্ক স্প্যানিশ খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতো না সোসিয়েদাদ। যদিও এই মুহূর্তে দলের অবস্থাটা ভিন্ন। তাকেফুসা কুবো, হামারি ত্রাওরে, উমার সাদিকদের মতো ভিনদেশী খেলোয়াড়দের নিয়েই দল সাজিয়েছে রিয়াল সোসিয়েদাদ।

    তবে রিয়াল সোসিয়েদাদ এই নীতি থেকে সরে গেলেও, অ্যাটলেটিক বিলবাও এখনো অটল রয়েছে এই নীতিতেই। আর যেহেতু বাস্কদের আঞ্চলিক গৌরবের সাথে মিশে গেছে এই অলিখিত নিয়মটা, সম্ভবত আরো অনেকগুলো বছর চলবে এভাবেই।