যেভাবে আল নাসরের 'গলার কাঁটা' আল হিলাল
সৌদি প্রো লিগ, কিংস কাপ, বা সুপার কাপ। প্রতিযোগিতার না যেটাই হোক না কেন, আল হিলালের কাছে পরাজয়টাই যেন হয়ে গেছে আল নাসরের নিয়তি। নেইমারবিহীন আল হিলালও হেসেখেলে হারিয়ে দিচ্ছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দলকে। কিন্তু তারকাবহুল দল নিয়েও কেন আল হিলালের সাথে পেরে উঠছে না আল নাসর?
এই প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল মূলত চারটা ব্যাপার।
১. দলীয় ভারসাম্যের পার্থক্য
আল হিলাল এবং আল নাসর, টাকাপয়সা খরচ করে দলে তারকা টানার দিক থেকে দুটো দলই সমানে সমান। বিদেশী তারকাদের মধ্যে এই মুহূর্তে আল নাসরে খেলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, সাদিও মানে, আয়মেরিক লাপোর্তে, মার্সেলো ব্রোজোভিচ, আলেক্স টেলেস, ওটাভিও, তালিস্কা প্রমুখ। অপর দিকে আল হিলালে রয়েছেন নেইমার, আলেকজান্ডার মিত্রোভিচ, ম্যালকম, রুবেন নেভেস, মিলিঙ্কোভিচ-স্যাভিচ, কালিদু কুলিবালি, ইয়াসিন বোনো, রেনান লোদিরা।
দলীয় ভারসাম্যই আল হিলালের সাফল্যের সূত্র; Image Source: Getty Images
কিন্তু শক্তিশালী স্কোয়াডই তো আর শিরোপা জয়ের জন্য শেষ কথা নয়, দলীয় ভারসাম্যটাও সেখানে বেশ জরুরী। এবং ঠিক এই ক্ষেত্রেই আল নাসরের চেয়ে আল হিলাল এগিয়ে রয়েছে অনেকটা। ইনজুরির কারণে নেইমারের সার্ভিসটা বলতে গেলে একেবারেই পায়নি আল হিলাল, তবুও দলের পারফরম্যান্সে তার মোটেই ছাপ পড়েনি। মিত্রোভিচ, ম্যালকমরা ঠিকই পূরণ করে দিচ্ছেন নেইমারের অভাবটা, রক্ষণ সামলাচ্ছেন কালিদু কুলিবালি-রেনান লোদি, আর গোলপোস্টের নিচে প্রতিনিয়ত ভরসা দিচ্ছেন ইয়াসিন বোনো।
উল্টো দিকে আল নাসর এই মুহূর্তে পুরোপুরি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো-নির্ভর দল। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সাদিও মানে বা তালিস্কার কাছ থেকে ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স যেন হ্যালির ধূমকেতুর মতোই বিরল। গোলরক্ষক বেন্তোও সময়ে সময়ে অদ্ভুত সব ভুল করে দলকে বিপদে ফেলছেন। সব মিলিয়ে, কোচের দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় লুইস ক্যাস্ত্রো পড়ে গেছেন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। নিজের দলের ভারসাম্যের অভাব, আর আল হিলাল নামক ‘গলার কাঁটা’ যে তাঁকে স্বস্তি দিচ্ছে না এক মুহূর্তও!
২. দেশী ও বিদেশী খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের পার্থক্য
চোটের কারণে নেইমারের অনুপস্থিতিতে আল হিলালের লেফট উইংটা খুব ভালোভাবে সামলাচ্ছেন সৌদি আরবের সালেম আল-দাউসারি। গত মৌসুমের ৪২ ম্যাচে করেছেন ২২ গোল, ম্যাচে তাঁর রাখা প্রভাব বিবেচনায় তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। রক্ষণে সৌদ আবদুলহামিদের কাছ থেকেও নিয়মিত পারফরম্যান্স পেয়েছে দলটি। দলের অন্য তারকাদের ওপর থেকে চাপটাও কমে গেছে তাতে।
আল-দাউসিরির পারফরম্যান্স অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে আল হিলালকে; Image Source: Getty Images
অন্যদিকে, আল নাসরের দেশী খেলোয়াড়রা মোটাদাগে হতাশ করেছেন। গত মৌসুমে দলের সর্বোচ্চ চার গোলদাতাই ভিনদেশী: ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তালিস্কা, সাদিও মানে এবং ওটাভিও। মাঝমাঠ বা রক্ষণেও বলার মতো কোন পারফরম্যান্স নেই সৌদি জাতীয়তার খেলোয়াড়দের। দুই দলের দেশী খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের এই তফাতের ব্যাপারটাও পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে দুই দলের ম্যাচে, এবং পুরো মৌসুমজুড়েই।
৩. মানসিক শক্তির পার্থক্য
শুধু মাঠের পারফরম্যান্স না, আল নাসর পিছিয়ে পড়ছে মানসিক শক্তিতেও। সদ্যসমাপ্ত সৌদি সুপার কাপের ফাইনালের কথাই ধরা যাক। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোলে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে গেলো আল নাসর। উজ্জীবিত হয়ে যেখানে দ্বিতীয়ার্ধে আরো প্রতিপক্ষকে চেপে ধরার কথা, আল নাসর সেখানে করলো উল্টোটা। ১৭ মিনিটের মধ্যে চারটা গোল করে ম্যাচ থেকে তাদের ছিটকে ফেললো আল হিলাল। বিরক্ত রোনালদো অঙ্গভঙ্গি করে যেন বোঝাতে চাইলেন, মাঠেই ঘুমিয়ে গেছেন সতীর্থরা!
রোনালদোর সেই অঙ্গভঙ্গি; Image Source: X
এটাই কিন্তু আল নাসরের ভেঙে পড়ার প্রথম উদাহরণ নয়। গত মৌসুমের শেষভাগে, কিংস কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল এই দুই দল। ম্যাচের শুরুতে গোল করে এগিয়ে যাওয়া আল হিলাল শেষ দিকে দুটো লাল কার্ড দেখে পরিণত হয় নয়জনের দলে। ততক্ষণে ম্যাচে সমতা এনে ফেলেছে একটা লাল কার্ড দেখেছিল আল নাসরও, কিন্তু এরপর মাঠে একজন খেলোয়াড় বেশি থাকার সুবিধাটা নিতে পারেনি তারা। উল্টো পেনাল্টি শুটআউটে ৫-৪ ব্যবধানে হেরে যায় তারা। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ওই ক্লাব মৌসুমটা শেষ করেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
Image Source: Getty Images
এই হুটহাট ম্যাচের মোমেন্টাম হারিয়ে ফেলা, ম্যাচে তৈরি হওয়া সুযোগগুলো নিতে না পারা, আর আল হিলালের দারুণ মানসিক শক্তির কাছেই যেন বারবার হেরে যাচ্ছে আল নাসর। এই মানসিক বাধা থেকে বেরোতে না পারলে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি শিরোপা ছোঁয়া হবে না রোনালদোর দলের।
৪. আল হিলাল একটু বেশিই ভালো!
কয়েকটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। গত মৌসুমে সৌদি প্রো লিগের ৩৪ ম্যাচের মধ্যে ৩১ ম্যাচেই জিতেছিল আল হিলাল, বাকি তিন ম্যাচ ড্র। পুরো লিগে তারা গোল হজম করেছিল মাত্র ২৩টা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা আল নাসরের সাথে তাদের ছিল ১৪ পয়েন্টের ব্যবধান।
অথচ আল হিলালের এই অর্জনে খুব সামান্যই অবদান রাখতে পেরেছিলেন দলের সবচেয়ে বড় তারকা নেইমার। চোটের কারণে লিগের ৩৪ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৩টা ম্যাচে মাঠে নামতে পেরেছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান। কিন্তু তাঁকে ছাড়াও শিরোপা জিততে অসুবিধা হয়নি আল হিলালের। মৌসুমজুড়ে মিত্রোভিচ করেছেন ৪০ গোল, ম্যালকম আর সালেম আল-দাউসারি করেছেন যথাক্রমে ২৩ ও ২২টা করে গোল। নেইমারকে ছাড়াই আক্রমণে-মাঝমাটে-রক্ষণে এতটা দুর্দান্ত আল হিলাল, নেইমার ফিরলে তো আরো ভালো করার কথা তাঁদের!
Image Source: Getty Images
মুদ্রার অপর দিকে, আল নাসরকে কার্যত একাই টানছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তালিস্কা-মানে-ওটাভিওদের সাহায্যটা শিরোপা জেতানোর জন্য যথেষ্ট হচ্ছে না। বড় ম্যাচে ভুল করছে রক্ষণভাগও। সুপার কাপের ফাইনালেই তো ‘অদ্ভুতুড়ে’ ভুল করে দলের বিপদকে ঘনীভূত করেছিলেন গোলরক্ষক বেন্তো। এমন উদাহরণ রয়েছে ভুরিভুরি।
২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের পরে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন রোনালদো। এরপর থেকে কোনো স্বীকৃত শিরোপা জিততে পারেনি আল নাসর। অপর দিকে, একই সময়ব্যপ্তিতে পাঁচটা শিরোপা জিতেছে আল হিলাল, যার মধ্যে আছে একটা সৌদি প্রো লিগ, দুইটা কিংস কাপ আর দুইটা সৌদি সুপার কাপ।
সব মিলিয়ে, এই মুহূর্তে কোচের ট্যাকটিক্স, মাঠের পারফরম্যান্স বা খেলোয়াড়দের মানসিক শক্তি, প্রতিটি ব্যাপারেই আল নাসরের চেয়ে যোজন যোজন দূরত্বে এগিয়ে রয়েছে আল হিলাল। এশিয়ার অন্যতম সেরা এই ক্লাবকে টপকে ঘরোয়া শিরোপার স্বাদ পেতে হলে বিশেষ কিছুই করে দেখাতে হবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দলকে!