সাদা পোশাকে দুর্দশা চলছেই বাবরের!
আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই নিরীহ একটা বল। শরীফুল ইসলামের লেগ স্ট্যাম্প বরাবর গুড লেন্থে পিচ করা বলটাকে হয়তো মাঠের যেকোন দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারতেন বাবর আজম। গ্লান্স করার চেষ্টা করেছিলেনও, কিন্তু সময়টা খারাপ হলে যা হয়, বাবরের আউটসাইড এজটা বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্তভাবে গ্লাভসবন্দী করলেন বাংলাদেশের উইকেটরক্ষক লিটন কুমার দাস। আর তাতেই নিশ্চিত হলো, সাদা পোশাকে বাবর আজমের চলমান দুর্দশা এত তাড়াতাড়ি শেষ হচ্ছে না!
লিটনের এই দুর্দান্ত ক্যাচেই বাবরের বিদায়; Image Source: X
অথচ বাবরের টেস্ট পারফরম্যান্স কিন্তু খারাপ ছিল না। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত তাঁর টেস্ট গড় ছিল প্রায় ষাট ছুঁইছুঁই। নিজের দেশে হোক বা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-শ্রীলঙ্কা-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে, বাবর আলো ছড়িয়েছেন সব জায়গাতেই। বরং যে ‘জিম্বাবর’ বলে ট্রল করা হতো বাবরকে নিয়ে, সেই জিম্বাবুয়ের মাটিতে বাবরের পারফরম্যান্স ছিল সবচেয়ে খারাপ।
স্বাগতিক দেশ | বাবরের টেস্ট গড় |
পাকিস্তান | ৭৫.৭৮ |
অস্ট্রেলিয়া | ৫২.৫০ |
ইংল্যান্ড | ৪৮.৭৫ |
শ্রীলঙ্কা | ৬৭.৭৫ |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৪৮.২৫ |
জিম্বাবুয়ে | ১.০০ |
কিন্তু এরপর থেকেই যেন কী হলো বাবরের!
২০২৩ এর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সাদা পোশাকে কোন সেঞ্চুরি তো দূরের কথা, ফিফটিও নেই বাবরের। এই সময়ে সাতটা টেস্ট খেলেছেন তিনি, কিন্তু গড় মাত্র ২১.০৮। চলমান বাংলাদেশ সিরিজের আগে, তিনি টেস্ট খেলেছিলেন গত বছরের শেষভাগে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ওই সিরিজের তিন ম্যাচে বাবরের গড় ছিল ২১, ২০১৭-১৮ মৌসুম থেকে আজ অবধি তাঁর এর চেয়ে কম গড় ছিল শুধু ২০২১ সালের জিম্বাবুয়ে সিরিজেই।
তবে বাবরকে পুরোপুরি ফর্মহীন বলাটাও হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। গত বারো ইনিংসের মধ্যে দশবারই দুই অংকে পৌঁছেছেন তিনি, কিন্তু একবারও ফিফটি অবধি টেনে নিতে পারেননি ইনিংসকে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজেই যেমন, ছয় ইনিংসের পাঁচটাতেই শুরু পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শুরু পেয়েও ইনিংসগুলোকে লম্বা করতে পারেননি তিনি, ওই সিরিজে তাঁর সর্বোচ্চ ইনিংসটাও ছিল ৪১ রানের। এর আগে শ্রীলঙ্কা সিরিজের তিনটা ইনিংসেও একই ব্যর্থতা দেখা গেছে বাবরের।
কিন্তু বাবরের এই দুর্দশার কারণ কী?
বাবরের দুর্দশার কারণ কী? Image Source: Getty Images
অস্ট্রেলিয়া সিরিজের ছয় ইনিংসের মধ্যে তিনবারই বোল্ড বা এলবিডব্লিউয়ের শিকার হয়েছিলেন বাবর। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসেও একটা কোমর বরাবর ধেয়ে আসা বলেই পরাস্ত হলেন তিনি। সব মিলিয়ে, ইনকামিং বলের বিপক্ষে বাবরের দুর্বলতা বেশ লক্ষ্যণীয়।
২০১৯ থেকে ২০২২, এই সময়ব্যপ্তিতে ৪১ ইনিংসের মধ্যে মাত্র ১১ বার বোল্ড বা এলবিডব্লিউয়ের শিকার হয়েছিলেন বাবর, অথচ এর পরের ১৭ ইনিংসেই সংখ্যাটা ৮। অর্থাৎ ইনকামিং বলের বিপক্ষে নিজের টেকনিক নিয়ে কাজ করার সময় সম্ভবত এসে গেছে বাবরের।
টেকনিক্যাল কারণ ছাড়াও, শুরুগুলোকে বড় ইনিংসে রূপান্তর করতে না পারার পেছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক কারণও। ২০১৭-১৮ সালের দিকে নিয়মিতই লাঞ্চ, টি ব্রেক অথবা যেকোন বিরতির আগে আউট হয়ে যেতেন বাবর। পরবর্তীতে সেই সমস্যাটা কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি। এবারও তাঁর ইনিংস বড় করতে না পারার পেছনে হঠাৎ মনোযোগ বা ফোকাস হারিয়ে ফেলার কোনো ব্যাপার ঘটছে কিনা, সেটাও হয়তো যাচাই করে নিতে চাইবেন তিনি। পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের কর্তৃত্বে নিয়মিত বদল আসা, ড্রেসিংরুমের বিরূপ পরিবেশে, অধিনায়কত্বে পরিবর্তন, এগুলোও প্রভাব রাখতে পারে বাবরের মনস্তত্ত্বে।
কবে ফর্মে ফিরবেন বাবর? Image Source: Getty Images
এই সমস্যার আরো একটা কারণ হতে পারে, দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট ক্রিকেট খেলা। গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলার পর প্রায় সাত-আট মাসের বিরতি দিয়ে আবারও সাদা পোশাকে মাঠে নেমেছে পাকিস্তান। ওই অস্ট্রেলিয়া সিরিজটাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত বছরের জুলাইতে শ্রীলঙ্কা সিরিজের প্রায় পাঁচ মাস পরে। অর্থাৎ প্রতি ছয়-সাত মাসে মাত্র একটা করে টেস্ট সিরিজ খেলার সুযোগ পাচ্ছে পাকিস্তান।
অথচ ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২-এর ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানের দুটো টেস্ট সিরিজের মধ্যে সর্বোচ্চ বিরতি ছিল চার মাসের। অর্থাৎ সাম্প্রতিক দীর্ঘ বিরতিগুলো বাবরের টেস্ট ব্যাটিংয়ের ছন্দে বেশ প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি, এই সমস্যা থেকে সহসা উত্তরণের পথও দেখা যাচ্ছে না, কেননা আগামী জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের পর আবারও দশ মাসের বিরতিতে যেতে হবে পাকিস্তানকে।
বাবরের সমস্যাটা আরো বেশি বাড়াচ্ছে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশ করতে না পারাটা। ২০১৯ সালে কায়েদ-ই-আজম ট্রফির ফাইনাল খেলার পরে আর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা হয়নি তাঁর।
তবে বাবরের সামনে নিজের সেরা ফর্মে ফেরার সুযোগটা থাকছেই। চলতি মৌসুমে নয়টা টেস্ট খেলবে পাকিস্তান, এর মধ্যে সাতটাই নিজের দেশে। অধিনায়কত্বের চাপটাও আর থাকছে না কাঁধে, পুরো মনোযোগটাই দিতে পারবেন ব্যাটিংয়ে। বাঁহাতি স্পিনের বিপক্ষে উন্নতির জায়গা আছে তাঁর, দ্রুতগতির ইনকামিং বলগুলোর বিপক্ষেও চাইবেন নিজেকে আরেকটু শাণিত করতে। সব মিলিয়ে, নিজের হারানো সাম্রাজ্য ফেরানোর লড়াইটা এই বাংলাদেশ সিরিজ দিয়েই শুরু করেছেন বাবর আজম।
তবে সেই লড়াইয়ের সাফল্যটা যদি পরবর্তী সিরিজ থেকে আসতে শুরু করে, বাংলাদেশের বাবর-সমর্থকরা খুব একটা কষ্ট পাবেন না নিশ্চিতভাবেই!