• বাংলাদেশ-পাকিস্তান
  • " />

     

    কখনো ডাক, কখনো পুল-হুক: কেমন ছিল ফারুকের দ্বিতীয় ইনিংসের 'ক্যাপ্টেনস নক'?

    কখনো ডাক, কখনো পুল-হুক: কেমন ছিল ফারুকের দ্বিতীয় ইনিংসের 'ক্যাপ্টেনস নক'?    

    সাত বছর আগে ফারুক আহমেদ মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনের কক্ষে যখন ছেড়ে গিয়েছিলেন, তার পরিচয় ছিল প্রধান নির্বাচক। সেই সময় তিনি মিরপুর ছেড়েছিলেন ক্ষোভ আর অভিমানের ম্রিয়মাণ মুখে। তখন যার জন্য ফারুক আহমেদকে পদ ছাড় হয়েছিল, বিসিবির সাবেক সভাপতি সেই নাজমুল হাসানের জায়গাতেই ফারুক আবার ফিরলেন মিরপুরে। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন কক্ষে তার ফেরাটা হলো বিসিবির অভিভাবক হয়ে। আর দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই সাংবাদিকদের করা একের পর এক বাউন্সার ধেয়ে এলো তার দিকে। ফারুক তার কিছুটা ডাক করলেন, কিছু পুল আর হুক করে জানিয়ে দিলেন, বিসিবির নতুন অধ্যায়ে তার কাছ থেকে দেশের আইসিউতে চলে যাওয়া ক্রিকেট কেন দ্বিতীয় জীবন আশা করছে।

     

    মিডিয়ার বাউন্সার সামলানো ফারুকের জন্য নতুন কিছু নয় মোটেই। দুই মেয়াদে আগে প্রধান নির্বাচক ছিলেন, ছিলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক। ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফি তার অধীনেই খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সাংবাদিকদের অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নতুন কিছু নয় তার জন্যে। তবে আজ বিসিবির অভিভাবক হয়ে ফেরার এই সময়ে অপ্রিয় বেশ কিছু মুহূর্ত এছিল তার জন্য, যার কোনো কোনোটি তার জন্য কিছুটা বিব্রতকরও। যে বিসিবি গত ১৫ বছরে হয়ে উঠেছিল দেশের অন্যান্য আরও অনেক জায়গার মতোই দুর্নীতি আর জবাবদিহিহীনতার জতুগৃহ, সেখানে স্রেফ সভাপতির বিদায়ে সবকিছু এক লহমায় শুদ্ধ হয়ে গেছে, সেটা ভাবা অনুচিত। তার ওপর ফারুককে এমন একটা আবহে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে, যখন আগের সময়ের অনেক পরিচালক এখনো বহাল তবিয়তে, কয়েকজন তো ছিলেন আজ তার পাশেই। তাদের মতো প্রশ্নবিদ্ধ লোকদের পাশে নিয়ে ফারুক কতটা সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন, সেই প্রশ্ন উঠল সরাসরি। ফারুক অবশ্য দক্ষ কুটনৈতিকের মতো তাদের ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিয়ে বললেন, অনেকেই হয়তো আগে নানা কারণে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। আবার অনিয়ম প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দিলেন। বললেন, আরও অনেক জায়গার মতো ক্রিকেট থেকেও দুর্নীতির বীজ উৎপাটন করা হবে। 

     

    অনিয়ম আর দুর্নীতি ক্রিকেটকে আষ্টেপৃষ্ঠে যেভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে, তার তালিকা করতে গেলে আসলে শেষ হবে না। মিরপুরের ধানক্ষেত মাঠ, তৃতীয় বিভাগে ম্যাচ ফিক্সিং, দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের হতশ্রী দশা, বিসিবিতে কমিশন বাণিজ্য, সিন্ডিকেট- সবকিছু মিলে বাংলাদেশের রুগ্ন ক্রিকেটের প্রতিভূ যেন আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ দলের হতশ্রী পারফরম্যান্সও। এ নিয়েই একের পর এক প্রশ্ন যেভাবে উঠল, ফারুককে একরকম অসহায় হয়েই বলতে হলো একদিনেই সব সমস্যা সমাধানের জাদুর কাঠি তার কাছে নেই। 

     

    কিছু জায়গায় ফারুক অবশ্য হুক করতে ছাড়েননি। বাংলাদেশ বর্তমান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের জন্যই মূলত আগের দফায় নির্বাচকের পদ ছেড়েছিলেন ফারুক, কদিন আগেও তার নিয়োগের বিরোধিতা করে কথা বলেছেন। আজ যখন সরাসরিই বললেন, সেই অবস্থান থেকে সরেননি, এরপর সম্ভবত ধরেই নেওয়া যায় বাংলাদেশে হাথুরুসিংহের অধ্যায়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে শিগগিরই। ফারুক বলেই দিলেন, নতুন কোচের ব্যাপারে বোর্ডের নীতিনির্ধারকদের সাথে বসবেন । বিসিবির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপতে হাথুরুসিংহে অধ্যায়ের পর বাংলাদেশের কোচ কে হন, সেটা বড় প্রশ্ন। 

     

    প্রশ্ন উঠল তামিম ইকবালকে নিয়েও। কদিন আগে ক্রীড়া উপদেষ্টার সাথে বিসিবিতে তার সাক্ষাত এবং ক্রীড়া উপদেষ্টাকে বিসিবি ঘুরিয়ে দেখানোর পর প্রশ্ন উঠল, তামিমকে কি বোর্ডে দেখা যাবে? ফারুক তামিমের মেধা কাজে লাগাতে চান, তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন আরও দুই-তিন বছর তিনি তামিমকে খেলতে দেখতে চান। আবার সাকিব আল হাসান যে নিজের ইচ্ছামতো জাতীয় দলে খেলতে পারবেন না, সেটারও আভাস দিলেন। এখানে তার আরেকটি চাওয়া জানয়ে দিলেন, রিশাদ হোসেনকে সীমিত ওভারে আটকে না রেখে বড় দৈর্ঘের ক্রিকেটে দেখা। প্রশ্ন উঠল, তার এসব চাওয়া কতটা নির্বাচকদের প্রভাবিত করবে? ফারুক অবশ্য জোর দিয়েই বললেন, তিনি নিজের ব্যক্তিগত মত জানিয়েছেন মাত্র। দিন শেষে নির্বাচকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে আগের সভাপতির নির্বাচক প্যানেলে বারবার অযাচিত হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের ক্রিকেটে খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সেখানে সাবেক অধিনায়ক হয়েও ফারুক কতটা নির্বাচকদের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে দিতে পারে, সেই প্রশ্ন উঠল বারবারই। 

     

    সাবেক অধিনায়কের ভারটা আসলে ফারুকের জন্য অনেক বড়। এর আগে কুটনৈতিক, রাজনৈতিক থেকে শুরু করে নানান ঘরানার লোক বিসিবি সভাপতির চেয়ারে বসলেও সাবেক অধিনায়কের কারও এই সৌভাগ্য হয়নি। ফারুক আজ সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন আরও দুইজন সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান ও খালেদ মাহমুদ সুজনকেও। গত এক দশকেে এই দুজন বিসিবির গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, তবে কতটা দক্ষতার সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন সেটা প্রশ্ন। ফারুক অবশ্য তার দুই ডেপুটির হয়ে ব্যাট ধরলেন, নানান কারণে তারা হয়তো নিজেদের কাজ ঠিকঠাক করতে পারেননি। 

     

    তবে আগে কেউ কিছু না পারলেও একটা কাজ ফারুক করে যেতে চান। সেটা হচ্ছে ঘুণে ধরা ক্রিকেটে একটা ‘সিস্টেম’ চালু করার। সবকিছু যেন একটা ‘প্রসেসের’ মধ্যে হয়, সেটা নিশ্চিত করার কথা বললেন বার বার।বাইরের চাপের কথা যেমন বললেন, ড্রেসিংরুমের কথা বাইরে ফাঁস হওয়ার অপেশাদার কথাও মনে করিয়ে দিলেন। যার মধ্যে বার বার ছিল সাবেক সভাপতিকে করা সূক্ষ্ম শ্লেষ। তবে সব মিলে ফারুকের কন্ঠে আশাবাদ বিসিবির প্রায় খুলে যেতে বসা চাকা লাগিয়ে ঠিক রাস্তায় ফেরত আনা। সেজন্য চাইলেন সবার সহযোগিতা।

     

    ব্যক্তিগতভাবে ফারুক আহমেদকে সৎ হিসেবেই জানে ক্রিকেটমহল। তিনি নিজেও আজ দাবি করলেন, ‘আমি একজন সৎ লোক’। তবে ফারুকের আশেপাশের লোকদের নিয়ে সেটা বড় করে বলা কঠিন। ক্রিকেটে যারা দীর্ঘদিন থেকেও কিছু করতে পারেননি, সেই প্রশ্ন বিদ্ধ দল নিয়ে নিঃসঙ্গ সেনানী হয়ে ফারুক এবারের ক্যাপ্টেনস নক কতটা বড় করতে পারেন, তার ওপরেই হয়তো নির্ভর করবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অদূর ভবিষ্যত।