ইতালির ফুটবলে কোমো-রূপকথা
গল্পটা ইতালির ঘরোয়া ফুটবলের দ্বিতীয় ধাপ সিরি বি-এর গত মৌসুমের শেষ ম্যাচ ডে-এর।
সিরি আতে নিজেদের উত্থান নিশ্চিতের লক্ষ্যে কোসেনজা ক্যালসিওর বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল কোমো ১৯০৭। তবে ম্যাচের ৩০ মিনিটেই জেনারো তুতিনোর গোলে এগিয়ে যায় ক্যালসিও। ম্যাচে ফিরতে মরিয়া কোমো সুবর্ণ সুযোগটা পেয়ে যায় ৭৪ মিনিটে। পেনাল্টি থেকে সিমোনে ভার্দির গোলে সমতা ফেরায় কোমো। ম্যাচের বাকি সময়টুকুতে আর কোনো গোল হলো না, তবে পয়েন্ট টেবিলের তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভেনেজিয়ার পরাজয়ে নিশ্চিত হয়ে গেল, একুশ বছর পর আবারও সিরি আতে উঠছে ইতালির উত্তরাঞ্চলের ক্লাবটি।
সিরি আতে উঠে এলো কোমো; Image Source: Como 1907
একুশ বছর!
এই একুশ বছরে উত্থান-পতনের প্রতিটা পরত দেখে ফেলেছেন কোমোর সমর্থকেরা। খেলোয়াড়দের মারামারি থেকে দর্শকদের সহিংসতা, একের পর এক অবনমন, অথবা ক্লাবের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, কী ঘটেনি এই একুশ বছরে! জুভেন্টাসের বিপক্ষে পরাজয় দিয়ে নতুন মৌসুমটা শুরু করলেও কোমোর সমর্থকরা হয়তো তেমন মন খারাপ করবেন না। ইতালিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে তাদের উঠে আসার এই গল্পটা এতটাই বিশেষ, প্রথম ম্যাচে হেরে গেলেও বোধ হয় তেমন কিছু যায় আসে না!
১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি প্রথমবারের মতো সিরি আতে সুযোগ পায় ১৯৪৯ সালে। তবে ইতালির শীর্ষ পর্যায়ে দীর্ঘ সময় ধরে খেলার মতো যোগ্যতা কখনোই পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি দলটি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘোরাঘুরি করতে হতো সিরি বি আর সিরি সিতে।
কোমোর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে আছেন থিয়েরি অঁরিও; Image Source: Como 1907
তবে পঞ্জিকা বদলে নতুন শতাব্দীর আগমনের সাথে কোমোর ভাগ্য বদলাতে শুরু করে, সেটা ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই অর্থেই। ২০০১ সালে সিরি সি থেকে সিরি বিতে ‘পদোন্নতি’ পায় দলটি। ওই বছরেই মদেনার বিপক্ষের ম্যাচে ঘটে যায় একটা অনভিপ্রেত ঘটনা। মদেনার ফ্রান্সেসকো বার্তোলোত্তিকে বাজে ফাউল করে লাল কার্ড দেখেছিলেন কোমো অধিনায়ক মাসিমিলিয়ানো ফেরিনো। ম্যাচটা কোমো জিতেছিল ১-০ ব্যবধানে, কিন্তু শেষ বাঁশি বাজার পরে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন দুই দলের খেলোয়াড়রা। পরবর্তীতে ফেরিনোকে নিষিদ্ধ করা হয় তিন বছরের জন্য, ওদিকে চোটগ্রস্ত বার্তোলোত্তি আর কখনোই ম্যাচ খেলার মতো ফিট হতে পারেননি।
এরপর ২০০২-০৩ মৌসুমে সিরি আতে প্রোমোশন পেয়েছিল দলটি। কিন্তু ওই মৌসুমেই ঘরের মাঠে কোমো-সমর্থকদের সহিংসতার ফলে অবধারিতভাবেই নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে দলটি। পরে সিরি আ থেকেও রেলিগেটেডও হয়ে যায় দলটি। একই সাথে অর্থনৈতিকভাবেও দুর্বল হতে থাকে দলটি। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয় ক্লাবটিকে।
নতুন মালিকের অধীনে ‘ক্যালসিও কোমো এসআরএল’ নাম নিয়ে ২০০৫-০৬ মৌসুমে সিরি ডিতে ফিরে আসে দলটি। তবুও ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয়নি দলটির, দৌড় ছিল সর্বোচ্চ সিরি বি পর্যন্তই।
২০১৬-১৭ মৌসুমে আরো একবার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে দেউলিয়া ঘোষিত হয় দলটি। ক্লাবকে নিলামে তোলারও ঘোষণা দেওয়া হয়।
স্বাভাবিকভাবেই পরের মৌসুমে আরো একবার ক্লাবের নাম-মালিকানা পরিবর্তন হলো, আবারও নবযাত্রা শুরু হলো সিরি ডি থেকে। এবারে ক্লাবের নাম ‘কোমো ১৯০৭ এসআরএল’।
২০১৯ সালে আবারও ক্লাবের মালিকানা পরিবর্তন হলো, আপাতত শেষবারের মতো। ইন্দোনেশিয়ান জারুম গ্রুপের অধীনে এসইএনটি এন্টারটেইনমেন্ট কিনে নিলো ক্লাবটিকে, শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে রইলো থিয়েরি অঁরি আর সেস্ক ফ্যাব্রিগাসের নামও।
সেস্ক ফ্যাব্রিগাস: কোমোর সাবেক খেলোয়াড়, বর্তমান কোচ; Image Source: Como 1907
২০২২ সালের গ্রীষ্মে খেলোয়াড় হিসেবে কোমোতে যোগ দেন ফ্যাব্রিগাস। এক মৌসুম খেলে পেশাদার খেলোয়াড়ি জীবনের সমাপ্তি টানেন তিনি। এরপর ২০২৩ সালের নভেম্বরে একই ক্লাবে যোগ দেন কোচ হিসেবে। তবে তখনো ইউয়েফা লাইসেন্স না থাকায় মূল কোচ হিসেবে ওসিয়ান রবার্টসকে নিযুক্ত করা হয়, যদিও দায়িত্বটা ছিল ফ্যাব্রিগাসের হাতেই। ফ্যাব্রিগাসের অধীনে সিরি বি-এর ২৫ ম্যাচের মধ্যে ১৫টা জয় আর ৬টা ড্র ছিল কোমোর। আর শেষের গল্পটা তো শুরুতেই বলা হয়েছে।
কোমোর সামনে এখন অনেক বড় স্বপ্ন।
আর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য কাজও শুরু করে দিয়েছেন ক্লাব-কর্তৃপক্ষ। রাফায়েল ভারানে, পেপে রেইনা, আন্দ্রেয়া বেলোত্তি, সার্জি রবার্তো, আলবার্তো মোরেনোদের মতো তারকাদের ইতোমধ্যে দলে ভিড়িয়েছে ন তাঁরা, নিকো পাজের মতো তরুণ খেলোয়াড়রাও আছেন রাডারেই। সব মিলিয়ে, প্রিমিয়ার লিগের লেস্টার সিটি, বুন্দেসলীগার বেয়ার লেভারকুসেনের মতো একেবারে শিরোপা না জিততে পারলেও না পারলেও অন্তত চমকজাগানিয়া কিছু পারফরম্যান্স তো আশা করাই যায় কোমোর কাছ থেকে। কিংবা কে জানে, যদি সেটা এবারই সম্ভব নাও হয়, হয়তো এই মৌসুমটাই হয়ে যাবে স্বপ্নসিঁড়ির প্রথম ধাপ।
তবে এই বর্তমানটা শুধুই কোমোর, এই মুহূর্তটা ইতালির ফুটবলের রূপকথার!