• বাংলাদেশ-পাকিস্তান
  • " />

     

    মিরাজ-সাকিবের ঘূর্ণিজাদু আর পাকিস্তানের ভুল

    মিরাজ-সাকিবের ঘূর্ণিজাদু আর পাকিস্তানের ভুল    

    মুশফিকের সেঞ্চুরি, সাদমান-মুমিনুল-লিটন-মিরাজের ফিফটি, নতুন বলে শরীফুল-হাসানের জ্বলে ওঠা, কিংবা দুর্দান্ত ফিল্ডিং, বাংলাদেশের জয়ের পেছনে বড় প্রভাব রেখেছিল সবগুলো ব্যাপারই। কিন্তু চতুর্থ দিন শেষেও যে টেস্টের ভাগ্যে আপাতদৃষ্টিতে ‘ড্র’-ই লেখা ছিল, পঞ্চম দিনের সকালে একের পর এক উইকেট নিয়ে সেই ম্যাচটাকেই বাংলাদেশের দিকে হেলিয়ে দিয়েছিলেন দুই স্পিনার সাকিব আল হাসান আর মেহেদী হাসান মিরাজ। অথচ ওই একই পিচে কোন বিশেষজ্ঞ স্পিনার ছাড়াই মাঠে নেমেছিল পাকিস্তান দল। পাকিস্তানের ভুলটাই যেন ফুল হয়ে ধরা দিলো বাংলাদেশের জন্য!

    মিরাজ পেয়েছেন চার উইকেট; Image Source: Associated Press

    ২১ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই টেস্টের চার দিন আগেই টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান কামরান গুলাম এবং রিস্ট স্পিনার আবরার আহমেদ এই ম্যাচের স্কোয়াড থেকে বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়  বাংলাদেশ ‘এ’ দলের বিপক্ষে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য চার দিনের ম্যাচের পাকিস্তান শাহীনস দলে। আর সাথে নিশ্চিত হয়ে যায়, বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণটা হবে পুরোপুরি পেস-নির্ভর। চারজন পেসারের সাথে পার্টটাইমার হিসেবে সালমান আলী আগাকে নিয়েই বোলিংয়ের পরিকল্পনা সাজায় পাকিস্তানি টিম ম্যানেজমেন্ট।

    কিন্তু সফরকারীরা হাঁটেনি স্বাগতিকদের পথে। স্কোয়াডে চারজন স্পিনার তো ছিলেনই। তাঁদের মধ্যে তাইজুল ইসলাম আর নাঈম হাসানকে বেঞ্চে রেখে সাকিব-মিরাজকে মাঠে নামে বাংলদেশে, আর সাথে  তিন পেসার হিসেবে শরীফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ আর নাহিদ রানা তো ছিলেনই। নতুন বলে উইকেট নেওয়ার কাজটা দুই ইনিংসেই দারুণভাবে সম্পন্ন করেছেন পেসাররা, আর দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তানকে ধ্বসিয়ে দিয়েছেন দুই বাংলাদেশী স্পিনার।

    দিনের শুরুটা হয়েছিল হাসান মাহমুদ আর নাহিদ রানার সফলতা দিয়ে, কিন্তু এরপরের গল্পটা শুধুই স্পিনারদের। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা আবদুল্লাহ শফিককে ফিরিয়ে দিলেন সাকিব, রানের খাতা খোলার আগেই ফিরতে হলো সৌদ আর সালমানকে। ইনিংসের সমাপ্তি টানার ক্ষেত্রেও দুই স্পিনার ভাগ করে নিলেন নিজেদের ভূমিকাটা। ভয় ধরানো রিজওয়ান আর টেলএন্ডার শাহীন আফ্রিদি-মোহাম্মদ আলীর উইকেট নিলেন মিরাজ, সাকিব ফিরিয়ে দিলেন নাসিম শাহকে। সাকিবের তিন আর মিরাজের চার উইকেটে পাকিস্তান মাত্র ৩০ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিতে পারলো বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। কোনো উইকেট না হারিয়েই সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় সফরকারীরা।

    তিন উইকেট নিয়ে সাকিবও রেখেছেন বড় অবদান; Image Source: Associated Press

    প্রথম ইনিংসে মূলত পার্শ্ব ভূমিকায় ছিলেন দুই স্পিনার, যদিও ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় রিজওয়ান-সৌদ শাকিলের বিশাল পার্টনারশিপ ভাঙা বা সালমানকে ইনিংস বড় করতে না দেওয়া, মিরাজ-সাকিব কৃতিত্ব পাবেন তাতেও!

    আর হ্যাঁ, পাকিস্তানের মাটিতে স্পিনারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ভর করে পাকিস্তানকে হারানো, বাংলাদেশের স্পিন বোলিং কোচ মুশতাক আহমেদ বাড়তি কৃতিত্ব চাইতেই পারেন। পাকিস্তানি কিংবদন্তিকে ব্যবহার করে পাকিস্তানকেই পরাজিত করা, 'কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা' বোধ হয় একেই বলে!

    কিন্তু প্রশ্নটা আসতেই পারে, স্বাগতিক দল হয়েও পিচের আচরণ পড়তে এমন ভুল কীভাবে করলো পাকিস্তান, যেখানে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ তিনটা টেস্টেই পেসারদের সাথে পাল্লা দিয়ে ভালো করেছেন স্পিনাররা। 

    বাংলাদেশের বিপক্ষে এই ম্যাচের আগে রাওয়ালপিন্ডিতে সর্বশেষ টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই টেস্টে পাকিস্তানের হয়ে দুই ইনিংসে যথাক্রমে চারটি ও দুটি উইকেট নেন পাকিস্তানের লেগ স্পিনার জাহিদ মাহমুদ। একই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের স্পিনার উইল জ্যাকসও তুলেছিলেন ছয়টি উইকেট। ম্যাচের ফলাফলটাও গিয়েছিল ইংরেজদের পক্ষে। ৭৪ রানে পাকিস্তান হেরে যায় ম্যাচটি।

    এর আগে, ২০২২ এর মার্চে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একই মাঠে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান। ব্যাটসম্যানদের জন্য স্বর্গতুল্য ওই পিচে পুরো টেস্টে পড়েছিল মাত্র ১৩টা উইকেট। এর মধ্যেও, পাকিস্তানের বাঁহাতি স্পিনার নোমান আলী তুলেছিলেন ছয়জন অজি ব্যাটসম্যানকে। আর ম্যাচের ফলাফলটা অবধারিতভাবেই ‘ড্র’ ছিল।

    ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডিতে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান। সেই ম্যাচেও বেশ সফল হয়েছিলেন স্পিনাররা। দক্ষিণ আফ্রিকার বাঁহাতি স্পিনার কেশব মহারাজ উভয় ইনিংসে তুলেছিলেন তিনটি করে উইকেট। আরেক বাঁহাতি জর্জ লিন্ডে প্রথম ইনিংসে উইকেটশূন্য থাকলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ফাইফার পেয়ে যান, যদিও ম্যাচটা পাকিস্তান জিতেছিল ৯৫ রানে।

    পাকিস্তানি পেসারদের হতাশা বাড়িয়েছেন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা; Image Source: Associated Press

    শুধু সর্বশেষ তিন ম্যাচ নয়, এর পাশাপাশি রাওয়ালপিন্ডির উত্তাপ, দলের বোলিংয়ের ওভাররেট আর লেগ স্পিনের বিপক্ষে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের চিরাচরিত দুর্বলতা বিবেচনা করেও একজন বিশেষজ্ঞ স্পিনারকে একাদশে রাখতেই পারতো পাকিস্তান। ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দীর্ঘ সময় ধরে বোলিং করা পেসারদের পক্ষে বেশ কঠিন, পাকিস্তানের পেসাররাও পারেননি লম্বা স্পেলে বল করতে। এর সাথে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দৃঢ়তায় তেমন সাফল্যও পাননি তাঁরা।

    স্বাভাবিকভাবেই পার্টটাইমার সালমান আলী আগা, সায়েম আইয়ুব আর সৌদ শাকিলের দ্বারস্থ হতে হয় অধিনায়ক শান মাসুদকে। মোট ১৬৮ ওভারের মধ্যে এই তিন স্পিনার মিলে করেছিলেন পুরো পঞ্চাশ ওভার, কিন্তু সাফল্য বলতে শুধুই সায়েম আইয়ুবের বলে সাকিব আল হাসানের আউট হওয়া। এর বাইরে ক্রিজে থিতু হওয়ার পরে উল্টো স্পিনারদের ওপরেই চড়াও হয়েছিলেন মুশফিক-মিরাজরা। 

    ম্যাচ-পরবর্তী পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন পাকিস্তানের অধিনায়ক শান মাসুদ, "প্রথমত, পিচ দেখে আমরা ভেবেছিলাম যে পেসারদের জন্য আরো বেশি কিছু থাকবে। দ্বিতীয়ত, আমি তিনজন পেসার খেলানোর পক্ষে ছিলাম। কিন্তু তিনজন পেসার খেলানোর অর্থ মাঠে তাঁদের তিনজনকেই একেবারে নিংড়ে ফেলতে হবে, এর সাথে ২৫-৩০ ওভার বোলিং করবেন একজন স্পিনার। আমরা তেমনটা চাইনি। আর পঞ্চম দিনে স্পিনারদের সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারটা... আসলে আবহাওয়ার যেমন অবস্থা ছিল, পুরো পাঁচদিন যে খেলা হবে, সেটাই নিশ্চিত ছিল না। তবে হ্যাঁ, দিনশেষে আমরাই ভুল ছিলাম, আর সেই ভুল শোধরাতে আমাদেরকেই কাজ করতে হবে।"

    কিন্তু এত কিছুর পরও ওভাররেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি পাকিস্তানিরা। প্রথম দিন বৃষ্টির কারণে দেরিতে খেলা শুরু হওয়ায় পরের দিনগুলোতে নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগে খেলা শুরুর ঘোষণা হয়। এই অতিরিক্ত সময় পাওয়ার পরও দিনের নির্ধারিত নব্বই ওভারই সম্পন্ন করতে পারেননি পাকিস্তানের বোলাররা।

    ম্যাচের শেষটা হলো বাংলাদেশের হাসিতে; Image Source: Associated Press

    অবশ্য বাংলাদেশ দলের এত কিছু ভাবার সময় বা প্রয়োজনীয়তা কোথায়! প্রতিপক্ষ নিজেদের মাঠের পিচ পড়তে বা একাদশ নির্বাচনে ভুল করেছে, সেই সুযোগটাই তো দুই হাত ভরে নিয়েছে বাংলাদেশ। এমনটাই তো করে বড় দলগুলো! কে জানে, হয়তো এই জয়টাই ছিল ‘বড় দল’ হয়ে ওঠার সিঁড়িতে নতুন বাংলাদেশের প্রথম পদক্ষেপ!