• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    প্রিমিয়ার লিগে ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়: এক অম্লমধুর সম্পর্ক

    প্রিমিয়ার লিগে ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়: এক অম্লমধুর সম্পর্ক    

    তথ্যটা আপনি হয়তো ইতোমধ্যেই জেনেছেন।

    গত শুক্রবারেই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ইকুয়েডর এবং প্যারাগুয়ে ম্যাচের জন্য ঘোষিত হলো ব্রাজিল দল। স্বাভাবিকভাবেই গোলরক্ষক হিসেবে ডাক পেয়েছেন লিভারপুল এবং ম্যানচেস্টার সিটির দুই তারকা, যথাক্রমে আলিসন বেকার এবং এডারসন মোরায়েস। এছাড়া সেন্টারব্যাক হিসেবে আছেন আর্সেনালের গ্যাব্রিয়েল মাঘালেস। এর বাইরে নিউক্যাসলের মিডফিল্ডার ব্রুনো গিমারেস, উলভারহ্যাম্পটনের জোয়াও গোমেজ, ওয়েস্ট হ্যামের লুকাস পাকেতা এবং ম্যানচেস্টার সিটির উইঙ্গার স্যাভিনহোও আছেন দলে। আর দলের অধিনায়ক এবং রাইটব্যাক দানিলোও একসময়ে খেলতেন ম্যানচেস্টারের নীল অংশের হয়ে।

    এছাড়া কোপা আমেরিকার পরে দল থেকে বাদ পড়েছেন ফুলহ্যামের আন্দ্রেস পেরেইরা, আর্সেনালের গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেল্লি, বোর্নমাউথের এভানিলসন প্রমুখ। গত বছরের শেষে এবং চলতি বছরের শুরুর দিকে ব্রাজিলের স্কোয়াডে ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাসেমিরো এবং অ্যান্টনি, টটেনহ্যামের রিচার্লিসন, নিউক্যাসলের জোয়েলিন্টন, আর্সেনালের গ্যাব্রিয়েল জেসুস, উলভারহ্যাম্পটনের ম্যাথিয়াস কুনহা প্রমুখ।

    প্রিমিয়ার লিগে ব্রাজিলের পতাকা বহন করছেন ব্রুনো গিমারেস; Image Source: Getty Images

    এই তথ্যগুলো উপস্থাপনের উদ্দেশ্য একটাই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রিমিয়ার লিগে ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া।

    অথচ মাত্র ৩০ বছর আগেও পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৯৫ সালের আগে প্রিমিয়ার লিগে কোন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়ই খেলেননি। ওই বছরেই কভেন্ট্রি সিটি দলে টানে ফরোয়ার্ড ইসাইয়াসকে। সেই থেকেই শুরু, এরপর থেকে ‘ঝাঁকে ঝাঁকে’ ব্রাজিলিয়ান যোগ দিতে থাকেন প্রিমিয়ার লিগে। ১৯৯২ সাল থেকে নতুন রূপে চালু হওয়া প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশি খেলোয়াড় আসা দেশগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে ব্রাজিল। প্রথম পাঁচটি দেশই ইউরোপীয়; ফ্রান্স, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং নেদারল্যান্ডস।

    কিন্তু আগে কেন ব্রাজিলিয়ানরা খেলতেন না প্রিমিয়ার লিগে? আর কীভাবেই বা পরিবর্তন এলো এক্ষেত্রে?

    ১। বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়া

    শুনতে অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত বিদেশি লিগ, বিশেষত ইউরোপীয় লিগে খেলা খেলোয়াড়দের বিশ্বকাপ দলে টানার ক্ষেত্রে ছিল এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। ‘৮২-এর বিশ্বকাপে এই গেরোটা খোলে, দুজন খেলোয়াড় সুযোগ পান ওইবার। পরের বিশ্বকাপেও চিত্রটা একই থাকে। ‘৯০ বিশ্বকাপে ১২ জন বিদেশি লিগে খেলা খেলোয়াড়কে দলে ডাকে ব্রাজিল, ২০০৬ সালে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ২০-এ।

    ব্রাজিলের '৮২ বিশ্বকাপ দল; Image Source: Getty Images

    এই অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণেই মূলত আশির দশক পর্যন্ত বিদেশি লিগে খেলতে অনাগ্রহী ছিলেন ব্রাজিলিয়ানরা।

    ২। দেশ এবং লিগের প্রতি আকর্ষণ

    ১৯৯৫ সালে ইসাইয়াসের কভেন্ট্রি সিটিতে গমনের মাধ্যমে ব্রাজিলিয়ানদের ইংল্যান্ড-যাত্রার দুয়ার খোলে, তবে ওই একই বছরে মিডলসব্রো এফসির সাথে জুনিনহো পাউলিস্তার চুক্তির আগ পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগ ব্রাজিলিয়ানদের জন্য তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলোতেও সম্প্রচারিত হতো না প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচগুলো।

    Image Source: Getty Images

    তবে ১৯৯৬ সালে যখন ইংল্যান্ডের মাটিতে ইউরো অনুষ্ঠিত হলো, নতুন নতুন স্টেডিয়াম আর দারুণ সম্প্রচার মিলে যেন খুলে গেল ফুটবলের এক নতুন বাজার। স্পেন এবং ইতালির লিগের মতো খেলোয়াড়দের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগও।

    ৩। স্কাউটিং এবং খেলোয়াড় সংগ্রহ

    অনাগ্রহটা যে শুধু ব্রাজিলিয়ানদের পক্ষ থেকে ছিল, এমন নয়। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত ক্লাবগুলোও ব্রাজিলিয়ানদের দলে টানার ক্ষেত্রে খানিকটা অমনোযোগীই ছিল। শুধু ‘আমোদ-প্রমোদ’ নয়, ব্রাজিলিয়ানরা যে ফুটবলও খেলতে পারে, সেই ব্যাপারটাও যেন নজরে আসে সবার।

    পাশাপাশি স্কাউটিং ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটে। একটা সময়ে খেলোয়াড়দের দলে টানার জন্য স্কাউটিং রিপোর্ট হিসেবে ভরসা করতে হতো ডিভিডির ওপর। কিন্তু এখন সেই অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। এখন তরুণ বয়সেই ব্রাজিলিয়ানদের দলে টানার চেষ্টা করে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো। এতে যেমন নতুন পরিবেশের সাথে খেলোয়াড়ের খাপ খাইয়ে নিতে বেশি সময় পাওয়া যায়, পাশাপাশি সার্ভিসও পাওয়া যায় অনেকদিন।

    ৪। রাজনৈতিক কারণ

    ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা অবস্থায় ব্রিটেনে ওয়ার্ক পারমিট পাওয়াটা একটু কষ্টকর ছিল নন-ইউরোপীয়দের জন্য। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের পর ইউরোপের বাইরের খেলোয়াড়রা বেশ সহজেই ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে যাচ্ছেন। এই কারণে ২০২২ সাল থেকে প্রিমিয়ার লিগে ব্রাজিলিয়ানদের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটা।

    তবে অনেক খেলোয়াড় এলেও সেই অর্থে ব্রাজিলিয়ান ‘সুপারস্টার’ পায়নি প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো। আর্জেন্টাইন সার্জিও আগুয়েরো যেমন ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য চূড়ায়, ব্রাজিলের কেউ এখনো সেই পর্যায়ে যেতে পারেননি। এমনিতেই গোলরক্ষক, ডিফেন্ডার বা মিডফিল্ডারদের জন্য কাজটা কঠিন, এর বাইরে ব্রাজিলের ফরোয়ার্ডরাও সেই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি। ম্যানচেস্টার সিটিতে গ্যাব্রিয়েল জেসুস ছিলেন আগুয়েরোরই ছায়ায়, আর লিভারপুলে রবার্তো ফিরমিনোর চেয়ে বড় তারকা ছিলেন মোহামেদ সালাহ।

    সিটিতে আগুয়েরো যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন, এর ধারেকাছে যেতে পারেননি কোন ব্রাজিলিয়ান; Image Source: CFP

    এমনিতে প্রিমিয়ার লিগ বিশ্বের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং কঠিন লিগ, শারীরিক সক্ষমতাও অনেক বেশি প্রয়োজন এখানে। অন্যান্য লিগে ভালো করলেও প্রিমিয়ার লিগে ভালো করাটা একটু শক্তই বটে। এই যেমন, অ্যান্টনির কথাই ধরা যাক। ডাচ ক্লাব আয়াক্সের হয়ে ভালো করে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর নজরে এসেছিলেন তিনি, কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তাঁর পারফরম্যান্সকে একেবারেই ভালো বলা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর কারিকুরিগুলো শুধুই হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে, অথচ ডাচ লিগে এই কারিকুরি দিয়েই প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পরাস্ত করতেন তিনি।

    পাশাপাশি, ব্রাজিলের সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়রাও অনেক ক্ষেত্রে বার্সেলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলগুলোর ডাককে অগ্রাহ্য করতে পারেন না। রোনালদো নাজারিও, রোনালদিনহো, নেইমার, ভিনিসিয়াস বা হালের এনড্রিক, প্রত্যেকেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেছে নিয়েছেন রিয়াল-বার্সাকেই। লিভারপুলের হয়ে দারুণ সময় কাটানো কৌতিনহো বা লিডসের রাফিনহা, তাঁরাও এড়াতে পারেননি বার্সার ডাক।

    লা লিগা থেকে ব্রাজিলিয়ান তারকারা যে একেবারেই প্রিমিয়ার লিগে যাননি, তা নয়। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আগমনের পর রিয়াল মাদ্রিদে গুরুত্ব কমে যাবে বুঝতে পেরে ম্যানচেস্টার সিটিতে চলে যান রবিনহো। তবুও, অর্জনে আগুয়েরোর কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেননি তিনি।

    প্রিমিয়ার লিগে ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার দেখার প্রতীক্ষাটাও তাই লম্বা হয়েছে। ম্যানচেস্টার সিটির ২০ বছরের উইঙ্গার স্যাভিনহো অথবা আগামী বছর চেলসিতে যোগ দিতে যাওয়া ফরোয়ার্ড এস্তেভাও কি পারবেন সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটাতে?

    উত্তরটা না হয় সময়ের হাতেই তোলা থাকুক।