• Other
  • " />

     

    রোনালদো, পেলে, পুসকাস নাকি রোমারিও- কার গোল সবচেয়ে বেশি?

    রোনালদো, পেলে, পুসকাস নাকি রোমারিও- কার গোল সবচেয়ে বেশি?    

    ফুটবল ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোল করেছেন কে?

    প্রশ্নটা “সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে”-এর মতোই বহুল চর্চিত, এবং অবশ্যই অমীমাংসিত। তবুও কিছুদিন পরপর এই বিতর্কটা উসকে ওঠে, বিশেষত মেসি-রোনালদো যেকোন মাইলফলক স্পর্শ করলেই আলোচনা শুরু হয় অতীতের গোলস্কোরারদের নিয়ে। পেলে-রোমারিও-বিকান-পুসকাসদের ‘আমলনামা’ ঘেঁটে দেখা হয়, অফিশিয়াল-আনঅফিশিয়াল বিতর্কের আগুনে আরেকবার ঘি পড়ে।

    নতুন করে সেই আলোচনাটা আবারও সামনে এসেছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কারণে। এই মুহূর্তে ক্যারিয়ারের ৯০০ গোল থেকে এক গোল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আল নাসরের এই পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড নিজের ইউটিউব চ্যানেলে রীতিমতো ‘খোঁচা’ মেরেছেন পূর্বসূরী পেলে-ডি স্টেফানোদের!

    নিজের চ্যানেলে ফার্দিনান্দের সাথে পডকাস্ট করেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো; Image Source: UR Cristiano (Youtube Channel)

    “আমি এক হাজার গোল করতে চাই,” রিও ফার্দিনান্দের সাথে এক পডকাস্টে রোনালদো বলেন, “এটাই আপাতত আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত এই অর্জনের মাধ্যমেই ফুটবলে আমি আমার সবচেয়ে বড় ছাপটা রেখে যেতে পারবো।”

    “আমি যত গোল করেছি, তার প্রত্যেকটার ভিডিও আছে,” রোনালদো আরো বলেন, “দেখুন, তাঁদের (পেলে এবং ডি স্টেফানো) প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আর আপনি যদি আমার আরো গোল দেখতে চান, আমার ট্রেনিংয়ের গোলগুলোও যোগ করতে পারেন।” 

    রোনালদোর কথায় তেমন ভুল নেই। তাঁর বা লিওনেল মেসির প্রতিটি গোলের ভিডিও ফুটেজই যেখানে পাওয়া সম্ভব, গত শতাব্দীর শুরু বা মাঝের দিকে খেলা বেশিরভাগ খেলোয়াড়েরই সেটা সম্ভব নয়। পেলে-বিকান-পুসকাসদের গোলসংখ্যা নিয়েও তাই বিতর্ক থাকে, সাথে ‘অফিশিয়াল ম্যাচ’ বিতর্ক তো রয়েছেই।

    আল নাসরের হয়ে নিয়মিত গোল পাচ্ছেন রোনালদো; Image Source: Getty Images

    পেলের কথাই ধরা যাক।

    ফিফার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের মতে, পেলের সর্বমোট গোল ১,২৮১টি। কিন্তু গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের মতে, সংখ্যাটি ১,২৮৯। ওদিকে পেলের ক্লাব সান্তোসের দাবি অনুসারে, তাঁর গোল ১,২৮২টি। আর পেলে নিজে বলছেন, সংখ্যাটি ১২৮৩।

    সংখ্যাগুলোর মধ্যে এমন পার্থক্য কেন? আর এর মধ্যে কোনটা সঠিক?

    ব্রাজিলের জার্সিতে পেলের ৯২ ম্যাচে মোট ৭৭ গোল করেছেন, এটা নিয়ে তেমন কোন বিতর্ক নেই। তাই ক্লাব পর্যায়ে সান্তোস এবং নিউ ইয়র্ক কসমসের হয়ে পেলে মোট কতটি গোল করেছেন, মূলত আলোচনা সেটা নিয়েই। এবং এখানেই চলে আসে ‘অফিশিয়াল-আনঅফিশিয়াল’ বিতর্ক। 

    বর্তমান সময়ের ক্লাব ফুটবলে ফিফা, মহাদেশীয় এবং দেশীয় ফুটবল সংস্থা-নিয়ন্ত্রিত ক্লাব প্রতিযোগিতাগুলোতে করা গোলগুলোকেই ধরা হয় অফিশিয়াল গোল হিসেবে। অর্থাৎ আপনি যদি বার্সেলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় হন, সেক্ষেত্রে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ, ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউয়েফা ইউরোপা লিগ, ইউয়েফা কনফারেন্স লিগ, ইউয়েফা সুপার কাপ, লা লিগা, কোপা দেল রে, স্প্যানিশ সুপার কাপ, এবং এই প্রতিযোগিতা-সংশ্লিষ্ট প্লে-অফে করা আপনার গোলগুলোকেই অফিশিয়াল হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আপনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা লিভারপুলের খেলোয়াড় হলে লা লিগা, কোপা দেল রে এবং স্প্যানিশ সুপার কাপের বদলে আসবে প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ, লিগ কাপ এবং কমিউনিটি শিল্ড। এর বাইরে যাবতীয় প্রীতি ম্যাচ এবং টুর্নামেন্ট, প্রি-সিজনে খেলা সকল ম্যাচকে ধরা হয় ‘আনঅফিশিয়াল’ হিসেবে। আনঅফিশিয়াল ম্যাচে করা গোলগুলো আলাদাভাবে হিসাব করা হয়, অফিশিয়াল গোল থেকে আলাদা রাখা হয়। রোনালদোর বর্তমান অফিশিয়াল গোল ৮৯৯, আর মেসির ৮৩৮।

    সান্তোসের হয়ে খেলছেন পেলে; Image Source: Getty Images

    ওদিকে সান্তোসের হয়ে পেলের ‘অফিশিয়াল’ গোলসংখ্যা ৬৪৩, এই তথ্যটাও মোটামুটি বিতর্কমুক্ত। নিউ ইয়র্ক কসমসের হয়ে তাঁর অফিশিয়াল গোল ৩৭। সব মিলিয়ে, অফিশিয়াল গোলের যোগফল দাঁড়ায় ৭৫৭। 

    কিন্তু এই সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে সান্তোসের। বর্তমানের মাপকাঠিতে, শুধু অফিশিয়াল গোলসংখ্যা দিয়েই পেলেকে বিচার করতে চান না তাঁরা। সান্তোসের মতে, ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটির হয়ে পেলে সর্বমোট ১,০৯১টি গোল করেছেন, এবং এর মধ্যে ৪৪৮টি এসেছে প্রীতি ম্যাচ এবং টুর্নামেন্টগুলোতে। ওই প্রীতি ম্যাচগুলোকে বর্তমানের মতো গুরুত্বহীন মনে করতে রাজি নন তাঁরা। 

    উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৯ সালে ইউরোপীয় সফরে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ৭০,০০০ দর্শকের সামনে রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হয়েছিল সান্তোস। ইউরোপ এবং লাতিনের এই দুই পরাশক্তির ম্যাচকে নাকি ‘ম্যাচ অব দ্যা সেঞ্চুরি’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন স্থানীয় সাংবাদিকেরা। 

    দুই সপ্তাহের মধ্যে আটটা ম্যাচ খেলা সান্তোস অবশ্য রিয়াল মাদ্রিদকে হারাতে পারেনি। তবে ৫-৩ ব্যবধানে পরাজয়ের ওই ম্যাচটা ছিল সান্তোসের খেলোয়াড়দের কাছে কেবলই একটা ‘দুর্ঘটনা’। সান্তোসের ভাষ্য অনুসারে, ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে পরের বছরগুলোতে আবারও রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হতে চেয়েছিলেন সান্তোসের খেলোয়াড়রা, কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদই নাকি ‘ভয়’ পেয়ে ব্যস্ততার হয়ে আর মুখোমুখি হতে চায়নি সান্তোসের। সান্তোসের তখনকার গোলরক্ষক গিলমার দস সান্তোস নেভেসের কণ্ঠেও ফুটে উঠেছিল ব্যাপারটি, “আমরা তাদের দুমড়ে মুচড়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আর ম্যাচ খেলতে চায়নি। ওরা বাজে ভাবে হেরে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিলো।”

    ইতিহাসের বয়ানগুলো একেক পক্ষের প্রেক্ষাপটে একেকভাবে ভেসে আসে। সেই বিতর্কে না গিয়ে বরং সে সময়ের ‘প্রীতি ম্যাচ’-এর গুরুত্ব নিয়েই আলোচনা করা যাক।

    শুধু রিয়াল মাদ্রিদ নয়, বিভিন্ন সময়ে সান্তোস মুখোমুখি হয়েছে বার্সেলোনা, জুভেন্টাস, ফেইনুর্দ, রোমা, ইন্টার মিলানের। বলা বাহুল্য, প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল পেলের। ইন্টার মিলানকে ৭-১ ব্যবধানে হারানোর ম্যাচে চার গোল করেছিলেন তিনি, এরপর বার্সাকে ৫-১ ব্যবধানে হারানোর ম্যাচে করেন জোড়া গোল।

    অর্থাৎ, একটা ব্যাপার পরিষ্কার, তখনকার প্রীতি ম্যাচগুলো মোটেই এখনকার মতো ‘গুরুত্বহীন’ ছিল না। আর ইউরোপীয় দলগুলোর বিপক্ষে পেলের পারফরম্যান্স যথেষ্ট ভালো ছিল। তাই ‘আনঅফিশিয়াল’ হলেও গোলগুলোকে অবহেলা করে একেবারে ফেলে দেওয়ার সুযোগ নেই।

    তবে এই আনঅফিশিয়াল ম্যাচে পেলের গোলের সংখ্যা নিয়েই রয়েছে বিতর্ক। সান্তোসের হিসাবের সাথে ফিফার, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের, বা পেলের নিজের হিসাব পুরোপুরি মেলে না। উপযুক্ত প্রযুক্তি, ভিডিও ফুটেজ, এবং পরিসংখ্যানে সূক্ষ্মতার অভাবের কারণেই পেলের মোট গোল সংখ্যায় পার্থক্য দেখা দেয়। বিতর্ক এড়ানোর জন্য ইদানীং তাই ফিফাসহ অনেক ওয়েবসাইট পেলের মোট গোলকে ১২০০+ বলে উল্লেখ করতে দেখা যায়।

    রোমারিও; Image Source: Getty Images

    প্রায় একই ব্যাপার ঘটে রোমারিওর সাথেও। ২০০৭ সালে স্পোর্ত রেফিফের বিপক্ষে ভাস্কো দা গামার হয়ে পেনাল্টি থেকে গোলটাকে ব্রাজিলিয়ান দাবি করেছিলেন নিজের ‘হাজারতম গোল’ হিসেবে। অবধারিতভাবেই এই সংখ্যাটা নিয়ে বিতর্ক আছে। ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার ওয়েবসাইট অনুসারে, কাতালান ক্লাবটির এই সাবেক তারকার মোট ‘অফিশিয়াল’ গোলসংখ্যা ৭৬৮। তবে রয়টার্স, গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মতে, গোলের সংখ্যাটাকে চার অঙ্কে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রীতি ম্যাচের পাশাপাশি এই ফরোয়ার্ড যোগ করেছেন যুবদল এবং বিভিন্ন প্রদর্শনী ম্যাচে নিজের করা গোলগুলোও। স্পোর্টস ম্যাগাজিন প্ল্যাকারের মতে, অ্যামেচার এবং অবসরপ্রাপ্ত খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খেলা ম্যাচের গোলগুলোও হিসাবে নিয়েছেন এই ফরোয়ার্ড, এমনকি এর মধ্যে অনেক ম্যাচ নাকি ৯০ মিনিটও দীর্ঘ ছিল না। রোমারিওকে দ্রুত এক হাজার গোলের মাইলফলকে পৌঁছে দিতে ভাস্কো দা গামা তাদের অনুশীলন সেশনগুলোকেও ধরেছে প্রীতি ম্যাচ হিসেবে- এমন অভিযোগও পাওয়া যায়।

    ফেরেঙ্ক পুসকাস এবং ইয়োসেপ বিকান; Image Source: Getty Images

    ফেরেঙ্ক পুসকাস এবং ইয়োসেপ বিকানের ক্ষেত্রেও মোট গোল এবং অফিশিয়াল গোল নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। ইয়োসেপ বিকানের অফিশিয়াল গোলসংখ্যা ৮০৫ বলে ফিফা স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু প্রীতি ম্যাচ, প্রদর্শনী ম্যাচ এবং অন্যান্য যাবতীয় ম্যাচকে হিসাবে নিলে সংখ্যাটা চলে যায় ১,১৩৭-এর আশেপাশে। অফিশিয়াল ম্যাচগুলোতে ফেরেঙ্ক পুসকাস মোট ৮০৬ গোল করেছেন, এমনটাই হিসাব দিয়েছিল ফুটবলের পরিসংখ্যান বিষয়ক ওয়েবসাইট আরএসএসএসএফ, সব মিলিয়ে তাঁর ক্ষেত্রেও সংখ্যাটা সহস্রাধিক।

    আর্তুর ফ্রেইডেনরিখ; Image Source: Getty Images

    এর বাইরে, ১৯০৯ থেকে ১৯৩৫ সাল অবধি ব্রাজিলের বিভিন্ন ক্লাবে খেলা আর্তুর ফ্রেইডেনরিখের মোট গোল সংখ্যা ১,৩২৯ বলে অনেকে দাবি করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রমাণসহ গোলের সঠিক সংখ্যা এবং পর্যাপ্ত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, ফিফাও এত গোলের স্বীকৃতি দেয় না তাঁকে। অফিশিয়াল হিসেবে গোলের সংখ্যাটা ৪৫০-এর আশেপাশে হবে বলেই পরিসংখ্যানবিদরা ধারণা করেন। ১৯১৯ এবং ১৯২২ সালে ব্রাজিলের কোপা আমেরিকা জয়ে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর, এছাড়া সাও পাওলো লিগেও তিনি আটবার সর্বোচ্চ গোল সংগ্রাহক হয়েছেন বলে অনেকেই দাবি করেন।

    ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং রিও ফার্দিনান্দের আলোচনায় উঠে এসেছিলো ইউসেবিও এবং আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর নামও। আইএফএফএইচএসের হিসেবে ইউসেবিওর মোট অফিশিয়াল গোল ৫৭৮টা, আর আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর ৫৩৭টা। তবে অন্যান্য সূত্রে সংখ্যাটা ভিন্ন হবে, আনঅফিশিয়াল গোল হিসাব করলে ৮০০ বা তার ওপরেও যেতে পারে সংখ্যাটা।

    তবে সব কথার শেষ কথা, পেলে-ম্যারাডোনার সাথে মেসি-রোনালদোর তুলনার ক্ষেত্রে যেমন ভিন্ন যুগের পার্থক্য একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, যেভাবে দুটো আলাদা সময়ের ফুটবলের নিয়ম আর রীতিনীতি দিয়ে ভিন্ন যুগের খেলোয়াড়দের তুলনা করা যায় না, ঠিক তেমনি গোলসংখ্যার ক্ষেত্রেও সময়ের ভিন্নতাই বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই ষাটের বা সত্তরের দশকের ফুটবলের সাথে একবিংশ শতাব্দীর ফুটবলের তুলনা করা যেমন পাগলামি, বর্তমানের মাপকাঠিতে অতীতের ফুটবলারদের গোলসংখ্যা বিচার করাটাও সম্ভবত একই পর্যায়ের বোকামি।

    তাই ‘গোলসংখ্যায় কে এগিয়ে’ বিতর্কটা খুব তাড়াতাড়ি সমাপ্ত হবে না বলেই মনে হচ্ছে!