'পেস ইজ পেস ইয়ার' !
পেস ইজ পেস ইয়ার!
পাকিস্তান ক্রিকেট মহলে কথাটা বেশ চালু। পেস বোলিংয়ে গতিই সবসময় পাকিস্তানের বড় বিজ্ঞাপন হয়ে থেকেছে। কিন্তু কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো পাকিস্তানকে সেই পেস দিয়েই বধ করছে বাংলাদেশ। শোয়েব আখতারের রাওয়ালপিন্ডির উইকেটে আজ গতির ঝড় তুলেছেন কোনো পাকিস্তানি পেসার নন, বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের এক লিকপিকে তরুণ নাহিদ রানা। আর তার সাথে সুইং আর গতি মিলিয়ে ত্রাস ছড়িয়েছেন আরেক বাংলাদেশ পেসার হাসান মাহমুদ। আর তাদের সাথে তাসকিন আহমেদ যোগ দিয়ে পাকিস্তানের ১০ উইকেটই নিয়েছেন বাংলাদেশের পেসাররা, যেটা বাংলাদেশের জন্য নতুন এক ইতিহাসই!
পেসাররা বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে অনেকদিন ধরেই সতীনের ঘরের ছেলে ছিল। দেশের মাটিতে বাংলাদেশ খুব কমই পেস বান্ধব উইকেট পেয়েছে, ঘরের মাঠে স্পিন-জয়ের অব্যর্থ বটিকার শুরু কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদেই। সেই স্পিন-ঔষধে বুঁদ হয়ে কোনো স্পেশালিস্ট পেসার ছাড়াই নেমে গিয়েছিল ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ঘরের মাঠে সাকিব, মিরাজ, তাইজুলের ওপর করেই বাংলাদেশ পেতে চাইত সাফল্যের দেখা, পেসারদের অবদানটা ছিল একরকম দ্বাদশ ক্রিকেটার হিসেবে ফিল্ডিং করার মতোই।
স্পিন-বিপ্লবে আড়ালে চলে যাওয়া পেসারদের ডাক পড়ত বিদেশের মাটিতে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা নিউজিল্যান্ডে গেলে আবার তাদের সামনে থেকে পথ দেখাতে হতো। কিন্তু অনভ্যাসে বিদ্যাহ্রাসের মতো সেই পথ দেখানোর কাজটা করতে গিয়ে নিজেরাই দিশেহারা হয়ে যেতেন তারা। সেজন্য টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ২২ বছরে ঘরের বাইরে বাংলাদেশের পেসারদের ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি ছিল মাত্র চারবার। দুইবার সেটা ছিল রবিউল ইসলামের। জিম্বাবুয়েতে তার দারুণ বলের গল্পের জাবর কাটিয়ে পার করতে হয়েছে অনেক দিন। অথচ জিম্বাবুয়ে ফেরত রবিউল দেশের মাটিতে এসে মাথা খুটে মরেছেন উইকেট পেতে, শেষ পর্যন্ত ছিটকে গেছেন পাদপ্রদীপের আলো থেকে।
সেই পেসাররাই গত কয়েক বছরে আবার নিজেদের চেনাতে শুরু করেছেন টেস্টে। শুরুটা অবশ্যই এবাদত হোসেনের হাত ধরে। ২০২২ সালে মাউন্ট মঙ্গানুইতে তার স্পেলটা বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা স্পেল। গতি আর সুইং দিয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডকে, যে নিউজিল্যান্ড তার আগের ১৭ টেস্টে দেশের মাটিতে হারেনি। তাসকিন আহমেদ আগে থেকেই ছিলেন। ঠিক মূল ভূমিকায় না থাকলেও পার্শ্বচরিত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মাউন্ট মঙ্গানুইতে, আর এবার রাওয়ালপিন্ডিতেও।
এর মধ্যেই উঠে এলেন আরও একঝাঁক পেসার। এবাদতের সাফল্যে উজ্জ্বীবিত হয়ে খালেদ আহমেদ ওয়েস্ট ইন্ডিজে নিলেন ৫ উইকেট, মিরপুরে আফগানিস্তানকে গুড়িয়ে দেওয়ার জয়ে তাসকিন-এবাদতের সাথে যোগ দিলেন শরিফুল ইসলামও। বাংলাদেশ যে ঘরের মাঠেও পেসাররা জেতাতে পারেন, সেটা দেখা গেল প্রথমবার। আর সিলেটে একমাত্র পেসার হিসেবে খেলেও শরিফুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন নিউজিল্যান্ড-বধে।
এর মধ্যে কোর্টনি ওয়ালশ, ওটিস গিবসন, অ্যালান ডোনাল্ডদের মতো সাবেকরা কাজ করে গেলেন পেস বোলিং কোচ হিসেবে। এবাদত, তাসকিন, মোস্তাফিজ, হাসান মাহমুদ ও শরিফুলের সাথে ডোনাল্ডের একটা ছবি বেশ সাড়া ফেলেছিল। বাংলাদেশের পেস ব্যাটারি যে সত্যিই কিছু করতে পারে, সেটার প্রমাণ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রশ্ন ছিল পাইপলাইন কতটা ভালো? পেস বোলারদের অবশ্যাম্ভাবী শত্রু ইনজুরির থাবায় এবাদত-তাসকিনরা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় প্রশ্ন উঠল, তাদের শূন্যতা পুরণ করা যাবে তো?
রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে উত্তর এলো, যাবে এবং খুব ভালোমতোই যাবে। প্রথম টেস্টেও শরিফুলের বড় ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের জয়ে, কিন্তু দ্বিতীয় টেস্ট থেকে তিনি ছিটকে গেলেন। সেটা না হলে হয়তো নাহিদ রানাকে জায়গা করে দিতে হতো তাসকিন আহমেদের জন্য, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হলো সেটা। নাহিদ রানা দ্বিতীয় ইনিংসে দেখালেন গতির সাথে লাইন ও লেংথের ঠিক কম্বিনেশন কতটা ভয়ংকর হতে পারে। বাবর, রিজওয়ানদের কোনো উত্তরই ছিল না তার কাছে। ১৫০ এর আশেপাশে বল করেছেন নিয়মিতই, সেই সাথে নিজের মাথাটাও খাটিয়েছেন দারুণ। বাবর ক্রিজে আসার পরেই তাকে আনা হয়েছে এবং যেভাবে বাবারকে শুরুতেই আউট করেছেন, সেটা বলে দেয় বাবরকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা ছিল নাহিদের। ভাগ্য সহায় হলে আজ ৫ উইকেট তারই হতে পারত, তবে সেটা শেষ পর্যন্ত হয়েছে আরেক পেসার হাসান মাহমুদের। রানার মতো গতি না থাকলেও জায়গামতো বল করার কঠিন কাজটা করে গেছেন ভালোভাবেই।
বাংলাদেশের সাবেক বোলিং কোচ ওয়ালশ একটা কথা বলেছিলেন, পেস বোলারদের আক্রমণ করতে হয় জোড়ায় জোড়ায়, দল বেঁধে, অনেকটা শিকারী নেকড়ে বাঘের মতো। ক্রিকেট ইতিহাসে ওয়াসিম-ওয়াকার, লিলি-টমসন বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্শাল-গার্নার-রবার্টস-হোল্ডিংদের কথা সবাই জানেন। হাসান-রানা আর তাসকিন দেখালেন তারাও শিকার করতে পারেন দল বেঁধে। হাসান যেমন বলছিলেন, রানার স্পেলের পর যখন পাকিস্তান একটা জুটি বেঁধে ফেলছিল, তিনি এসে সেই জুটিটা ভেঙে দিয়েছেন। রানার বলে রিজওয়ানরা হাঁসফাঁস করছিলেন, হাসান পরে এসে সেটার সুবিধাই নিয়েছেন। আবার সকালে যখন সাইম-শান মাসুদ জুটি বেঁধে ফেলেছিলেন, সেটা ভেঙেছেন তাসকিন। যে নাহিদ রানা ১৫২ কিলোমিটার গতিতে বল করে বাংলাদেশের গতির রেকর্ড ভেঙেছেন, সেখানে পাকিস্তানের দুই সেলেব্রিটি পেসার নাসিম শাহ আর শাহীন শাহ আফ্রিদি খেলার সুযোগই পাননি। বাবর আজমের মতো ব্যাটারকে আউট করার পরও নাহিদের প্রায় নির্লিপ্ত উদযাপন বলে দেয়, বয়সের তুলনায় দ্রুতই পরিণত হচ্ছেন পেসাররা, নিতে শিখেছেন দায়িত্ব। পাকিস্তানের মাটিতে তাদের পেসারদের আড়াল করে দেওয়ার কীর্তিটা এই সিরিজে বাংলাদেশের অর্জনের শুরুর দিকেই থাকবে।
বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের পুলের মধ্যে এই মুহূর্তে যেমন দলের বাইরে আছেন খালেদ, তানজিম হাসান সাকিবরা। অভিষেকের কাছাকাছি গিয়েও হয়নি রেজাউর রহমান রাজা, মুশফিক হাসানদের। দীর্ঘ ইনজুরি থেকে ফেরার অপেক্ষায় এবাদত হোসেন। সামনে অবশ্য কাজটা আরও কঠিন হবে, পরীক্ষা ভারতের। তবে পাকিস্তান থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ ২.০ এর মতো পেস বিপ্লব ২.০ এর নতুন অধ্যায়ের স্বপ্ন তো দেখাই যায়!