নাহিদ রানা: ছুটছে চাঁপাই এক্সপ্রেস!
গত কয়েকদিন ধরেই রাওয়ালপিন্ডির তাপমাত্রা একটু বেশিই। দুপুরের দিকে তাপমাত্রাটা উঠছে ৩৪-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, রাওয়ালপিন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেটা অনুভূত হচ্ছিল প্রায় ৩৬-৩৭ ডিগ্রি পর্যন্ত।
এই উত্তাপের মধ্যে হাওয়া হয়ে এসেছিলেন ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা এক হালকা পাতলা গড়নের তরুণ। ‘৪৫’ নম্বর জার্সি পরা এই তরুণের নাম নাহিদ রানা। লু হাওয়া হয়ে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের জীবন ওষ্ঠাগত করে দিয়েছিলেন তিনি, আবার সেই তিনিই শীতল হাওয়া হয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেন বাংলাদেশী দর্শক-সমর্থকদের হৃদয়ে।
নাহিদ রানা, রিমেম্বার দ্যা নেম!
Image Source: Associated Press
সাদা পোশাকে বাংলাদেশের পেস আক্রমণকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই ২১ বছর বয়সী তরুণ। গতি দিয়ে নাভিশ্বাস তুলে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের। ঘণ্টায় নিয়মিত ১৪৫ কিলোমিটার গতি তুলছেন। আর মাত্র তিনটা টেস্টের ক্যারিয়ারেই হয়ে গেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম পেস বোলার। আর যেভাবে এগোচ্ছেন, নিজের ‘১৫২.০’ রেকর্ডকে নিজেই ফেলে দিয়েছেন হুমকির মুখে!
তাঁর এই বাড়তি গতিটাই ‘প্রাণ’ কেড়ে নিচ্ছে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের। সাধারণভাবে ঘণ্টায় ১৩০-১৩৫ বা বড়জোর ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতির বল খেলেই অভ্যস্ত থাকেন ব্যাটসম্যানরা। নাহিদ রানার অতিরিক্ত গতিটা তাই হয়ে উঠছে তাঁদের অস্বস্তির কারণ। স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা দ্রুতই বলটা চলে আসছে ব্যাটের কাছে, একটু তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভুলচুক করে ফেলছেন তাঁরা। ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে কিপার বা স্লিপের কাছে বল যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
স্ট্যাম্পের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডারদের জন্যও কাজটা একটু কঠিন। এত গতির সাথে তো তাঁরাও অভ্যস্ত নন! কিছু ক্যাচ তাই তাঁদেরও হাত ফসকেছে।
তবে কিছু ক্যাচ হাত ফসকালেও, মোটাদাগে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছেন নাহিদ রানা। অধিনায়ক শান মাসুদ থেকে তারকা বাবর আজম, ইনফর্ম মোহাম্মদ রিজওয়ান থেকে সহ-অধিনায়ক সৌদ শাকিল, নাহিদের গতির কাছে ভুগেছেন সবাই।
Image Source: Associated Press
দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে নাহিদের করা তৃতীয় বলেই ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে উইকেটরক্ষক লিটন দাসের তালুবন্দী হন শান মাসুদ। পরের ওভারের প্রথম বলেই বাবর আজমের আউটসাইড এজ ধরা পড়ে স্লিপে সাদমানের হাতে। পরের বলে যেন দেখা গেল ‘অ্যাকশন রিপ্লে’, তবে এক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানের নাম মোহাম্মদ রিজওয়ান, আর বলটা সাদমানের হাতে আটকানোর বদলে গলে বেরিয়ে যায় বাউন্ডারির দিকে। উইকেটটা পেলে প্রথম দুই ওভারেই তিন উইকেট হয়ে যেত নাহিদের, স্বপ্নের শুরুর আক্ষরিক বাস্তবায়ন আর কী!
তবে রিজওয়ানের উইকেট না পেলেও নাহিদের জন্য অপেক্ষা করছিলো আরো কিছু উপহার। প্রথমে সৌদ শাকিল, পরে আবরার আহমেদ।
এই সিরিজের আগে সৌদ শাকিলের গড় ছিল ৬১.৫৫। মাসুদ-বাবরদের সাথে তাই তাঁর নামটাও উচ্চারিত হচ্ছিল বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান হিসেবে। কিন্তু পাকিস্তান হয়তো জানতো না, এই তিনজনকে আটকানোর জন্যই বাংলাদেশের কাছে ছিল একটা অস্ত্র, নাহিদ রানার গতি। গতিময় নাহিদ রানা যে কতটা ‘প্রাণঘাতী’, এই ইনিংসের ওই তিন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে মুখোমুখি হওয়া প্রথম ওভারেই তাঁদের উইকেট তুলে নেওয়া থেকে সেটা আন্দাজ করা যেতেই পারে।
আর শোয়েব আখতারের রাওয়ালপিন্ডিতেই যেন উত্থান ঘটলো বাংলাদেশের ‘চাঁপাই এক্সপ্রেস’-এর!
মোহাম্মদ রিজওয়ান আর সালমান আলী আগার বিপক্ষেও দুর্দান্ত ছিলেন নাহিদ রানা। গতির সাথে লাইন-লেন্থ দিয়ে বারবার ভড়কে দিয়েছেন দুজনকেই। সাপের ছোবলের মতো তাঁর ‘বিষাক্ত’ বাউন্সার আঘাত করে রিজওয়ানের হেলমেটে, সালমানের ব্যাটের বাইরের কানা ঘেঁষে বল বেরিয়ে যায় কয়েকবার। আর টেল এন্ডার আবরার আহমেদের গ্লাভসে লেগে বল তো স্লিপেই চলে গেলো। তবে অসাধারণ বোলিং করে পাঁচ উইকেট পাওয়া হয়নি নাহিদের, আরেক দুর্দান্ত পেসার হাসান মাহমুদ ছুঁয়ে ফেলেছেন ওই মাইলফলক। অবশ্য দল যেখানে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জিতছে পাকিস্তানের বিপক্ষে, তাতে ব্যক্তিগত এই না পাওয়াটা হয়তো খুব একটা কষ্ট দেবে না তাঁকে!
পাঁচ মাস আগেও কি এমনটা ভাবতে পেরেছিলেন নাহিদ!
Image Source: Associated Press
২০২২-২৩ মৌসুমে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৩২ উইকেট পেয়েছিলেন তিনি, ২০২৩ বিপিএলেও দেখিয়েছিলেন গতির ঝড়। লাল বলে তাঁর সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই টেস্ট দলে সুযোগ দেওয়া হয় তাঁকে, মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেকও হয়ে যায় তাঁর। সিলেটের ওই টেস্টে মোট পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন তিনি। গতি নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও তাঁর লাইন-লেন্থ নিয়ে একটু খচখচানি ছিল অনেকের মনেই।
পাঁচ মাস পরে দেখা গেল, লাইন-লেন্থের জায়গাতে বেশ উন্নতি করেছেন নাহিদ রানা। ইনসুইং-আউটসুইং পেয়েছেন টুকটাক, রিজওয়ানকে পরাস্ত করেছেন বাউন্সারে। চাতুর্যের সাথে লেন্থ পরিবর্তন করে বাবরকেও আউট করেছেন দুই টেস্টেই। আর সাথে গতির ব্যাপারটা তো আছেই, তাঁর ঘণ্টায় দেড়শ কিলোমিটার ছুঁইছুঁই গতি বারবার শীতল স্রোত বইয়ে দিয়েছেন দর্শকদের মেরুদণ্ড দিয়ে।
গতিময় পেসার যে কখনোই বাংলাদেশ পায়নি, ব্যাপারটা এমন না।
ক্যারিয়ারের শুরুতে দারুণ গতি ছিল মাশরাফির, কিন্তু বারংবার চোটে পড়ে সেই ক্ষেত্রে আপস করতে হয় তাঁকে। শাহাদাত হোসেনও ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি আশানুরূপভাবে। রুবেল হোসেন লাল বলে তেমন ভালো করতে পারেননি কখনোই। ইবাদত-খালেদদের এখনো পাড়ি দিতে হবে বহুদূর।
তবে বাংলাদেশের এই পেস আক্রমণটা স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
Image Source: Associated Press
শরীফুল-তাসকিন-হাসান-নাহিদ-খালেদ, গতি-সুইংয়ের সাথে আগ্রাসন দিয়েও প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করতে পারেন তাঁরা। আর এই আক্রমণভাগের তরুণতম নাম ওই নাহিদ রানা-ই, সম্ভবত সবচেয়ে ‘এক্সাইটিং’-ও।
বাড়তি যত্ন তাই অবশ্যই প্রাপ্য তাঁর। একসাথে তিন ফরম্যাটের বোঝা চাপিয়ে না দিয়ে, আপাতত তাঁকে চোটমুক্ত রেখে, সচেতনভাবে শুধু লাল বলের জন্য ব্যবহার করাটাই সম্ভবত বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আর হ্যাঁ, লাইন-লেন্থ নিয়ে কাজ করতেই হবে, কিন্তু গতির সাথে কোনো আপস নয়!
তবে ভবিষ্যতের করণীয় ব্যাপারগুলো সময়ের হাতেই তোলা থাক। আপাতত এই মুহূর্তটা শুধুই অভূতপূর্ব সাফল্য এবং উজ্জ্বল সম্ভাবনা উদযাপনের।
‘চাঁপাই এক্সপ্রেস আসছে’ না, চাঁপাই এক্সপ্রেস চলে এসেছে!