• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    বর্ণাঢ্য ইতিহাস, মলিন অতীত, উজ্জ্বল বর্তমান, সোনালি ভবিষ্যৎ। লা মাসিয়া সিরিজ। পর্ব ১

    বর্ণাঢ্য ইতিহাস, মলিন অতীত, উজ্জ্বল বর্তমান, সোনালি ভবিষ্যৎ। লা মাসিয়া সিরিজ। পর্ব ১    

    কাতালান ভাষায় “লা মাসিয়া”। ইংরেজিতে “ফার্মহাউজ”। বাংলায় বলা যেতে পারে “খামারবাড়ি”। সহজ ভাষায়, লা মাসিয়া হলো ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার ফুটবলার তৈরির আঁতুড়ঘর।

    শুধু বার্সেলোনা বললে ভুল হবে, যুগে যুগে লা মাসিয়া দারুণ সব খেলোয়াড় সরবরাহ করে এসেছে সারা বিশ্বেই। লিওনেল মেসি, জাভি হার্নান্দেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, কার্লেস পুয়োল, সার্জিও বুসকেটস থেকে শুরু করে হালের লামিন ইয়ামাল, দানি অলমো, পাবলো গাভি, আনসু ফাতি -এদের প্রত্যেকেই উঠে এসেছেন লা মাসিয়া থেকে। একটা সময়ে মূলত লা মাসিয়ার ওপর ভর করেই ইউরোপে রাজত্ব করেছে বার্সেলোনা। এখনও যদি অর্থনৈতিক সংকট বা অন্য কোন কারণে খেলোয়াড় কিনতে না পারে কাতালান ক্লাবটি, লা মাসিয়াই এগিয়ে আসে ত্রাতা হয়ে। আর শুধু বার্সেলোনা নয়, জেরার্ড পিকে-সেস্ক ফ্যাব্রিগাস-দানি অলমোর মতো লা মাসিয়ানরা আলো ছড়ান পুরো পৃথিবীতেই।

    Image Source: Getty Images

    গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দিকে যখন বার্সার হোম ভেন্যু ক্যাম্প ন্যু তৈরি করা হচ্ছিলো, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাছেপিঠের একটা একটা পুরোনো ধাঁচের কটেজকে নিজেদের কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পুরোনো ধাঁচের ওই কটেজটা তৈরি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিনশ বছর আগে, ১৭০২ সালে। ক্যাম্প ন্যু পুরোপুরি প্রস্তুত হওয়ার পরে বার্সেলোনা তাদের অফিস এবং যাবতীয় কার্যক্রম সেখানে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। আর ১৯৭৯ সালে ওই কটেজটাই পরিণত হয় বার্সেলোনার তরুণ খেলোয়াড়দের একাডেমি হিসেবে, যাকে আজ সবাই চেনেন লা মাসিয়া হিসেবে।

    যেসব তরুণ খেলোয়াড় বার্সেলোনায় খেলতে আসতেন দূরদূরান্ত থেকে, পরিবারের সাথে যাদের বসবাসের সুযোগ ছিল না, তাঁরাই মূলত লা মাসিয়াতে থাকতেন। পরবর্তীতে এখান থেকেই উঠে এসেছেন পেপ গার্দিওলা, কার্লেস পুয়োল, ভিক্টর ভালদেস, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাদের মতো বার্সেলোনার একেকজন কিংবদন্তি। একই একাডেমি থেকে লিওনেল মেসি আর জাভি হার্নান্দেজরাও উঠে এসেছেন, তবে তাঁরা লা মাসিয়াতে থাকতেন না। শুধু নিয়মিত ট্রেনিং আর খাবারের সময়ে একাডেমিতে উপস্থিত থাকতেন তাঁরা।

    ২০১১ সালে বার্সেলোনা তাদের একাডেমির জায়গা পরিবর্তন করে। ক্যাম্প ন্যু থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, সেন্ট হোয়ান ডেসপিতে অবস্থিত সিউটাট এস্পোর্তিভো হোয়ান গ্যাম্পার কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয় এই একাডেমিটা। তবে অবস্থানের পরিবর্তন হলেও একে এখনো ‘লা মাসিয়া’ বলেই ডাকা হয়।

    এই লা মাসিয়াতেই এখন বসবাস করেন লামিন ইয়ামাল, পাউ কুবারসিরা। তাঁদের বেডরুম থেকে ট্রেনিং গ্রাউন্ডের দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটা পথ।

    কুবারসির লা লিগা অভিষেক হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে, সতেরোতম জন্মদিনের দুই দিন আগে। লামিনের অভিষেক হয় ২০২২-২৩ মৌসুমের একেবারে শেষ ভাগে, তখনো তাঁর বয়স ষোলো পূর্ণ হয়নি। এরপর তো কেবল এগিয়েই চলেছেন দুজনে, লামিনকে তো ধরা হচ্ছে মেসি-উত্তর বার্সেলোনার সবচেয়ে বড় প্রতিভা হিসেবে।

    Image Source: Getty Images

    সিআইইএস ফুটবল অবজারভেটরির সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, শতাংসের হিসেবে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলার রয়েছেন বার্সেলোনার ২০২৩-২৪ মৌসুমের স্কোয়াডে। মূল দলের প্রায় ১৫ শতাংশই এখনো ‘টিনেজার’। এর ‘কৃতিত্ব’ অথবা ‘দায়’, দুটোর সিংহভাগই জাভির প্রাপ্য। ২০২১ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একাডেমির খেলোয়াড়দের ওপর ভরসা করছেন তিনি, তাঁর অধীনে অভিষেক হয়েছে মোট ১৬ জন তরুণের।

    এই তরুণদের মধ্যে লামিন-কুবারসি-ফারমিনদের কথাই আসে সবার আগে, পাশাপাশি আসে ১৭ বছর বয়সী ফুলব্যাক হেক্টর ফোর্ট এবং চেলসিতে পাড়ি জমানো ১৮ বছর বয়সী স্ট্রাইকার মার্ক গুইউর নামও। হ্যান্সি ফ্লিকের অধীনে অভিষেক হয়ে গেছে মার্ক বের্নালের (১৬), চোটে পড়ার আগ পর্যন্ত নজর কেড়েছেন তিনি। এর বাইরে উনাই হার্নান্দেজ (১৯), কুইম জুনিয়েন্ত (১৭), পাউ প্রিম (১৮), গিল ফার্নান্দেজরাও (১৫) মূল দলের আশেপাশে রয়েছেন।

    জাভির দৃষ্টিতে এই তরুণরা ‘নির্ভীক’, আর সেটাই তাদেরকে আলাদা করে আগের প্রজন্মগুলো থেকে।

    Image Source: Getty Images

    মেসি-বুসকেটস-আলবার পরে, এবং এখনকার ফাতি-বালদে-লামিন-কুবারসির আগে, এক সার্জি রবার্তো বাদে লা মাসিয়ার কোনো খেলোয়াড়ই নিজের জায়গা পাকা করতে পারেননি বার্সার মূল একাদশে। এর কারণ কী? 

    এই প্রশ্নের উত্তরে লা মাসিয়ার সাবেক ডিরেক্টর অরেলি আলতিমিরা আঙুলটা তুলেছেন ক্লাবের অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে।

    “লা মাসিয়া সম্প্রতি আবারও ভালো করছে,” তিনি বলেন, “এর মূল কারণ হলো অর্থনৈতিকভাবে ক্লাবের করুণ দশা।”

    বার্সেলোনার কয়েকটা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোর্সের মতে, ক্লাবের এই চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার সময়ে লা মাসিয়ার ওপর পূর্ণ আস্থাই পারে কাতালান ক্লাবটির পুরোনো উজ্জ্বল অতীতকে ফিরিতে আনতে। 

    “বার্সেলোনার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খেলোয়াড় তৈরি করার ক্ষেত্রে লা মাসিয়ার ভূমিকা ব্যাপক। দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় প্রোফাইলের খেলোয়াড় পাওয়ার জন্য তাই লা মাসিয়াই ভরসা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই একে দেখা হয় অবহেলার দৃষ্টিতে। আর এখন আমাদের যেমন অর্থনৈতিক অবস্থা, একই সাথে বর্তমান প্রজন্মটা যতটা প্রতিভাবান, তাতে এদের যত্ন নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।”

    Image Source: Getty Images

    ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর।

    বার্সেলোনা এবং লা মাসিয়ার ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে স্মরণীয় দিন ছিল সেটিই। লা লিগায় লেভান্তের বিপক্ষের ম্যাচে সেদিন একই সাথে মাঠে ছিলেন এগারোজন লা মাসিয়ান।

    ভিক্টর ভালদেস, জর্দি আলবা, কার্লেস পুয়োল, জেরার্ড পিকে, মার্টিন মনতোয়া (দানি আলভেজের ইনজুরির কারণে যিনি পনেরোতম মিনিটে মাঠে নেমেছিলেন), সার্জিও বুসকেটস, জাভি হার্নান্দেজ, সেস্ক ফ্যাব্রিগাস, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, পেদ্রো রদ্রিগেজ এবং লিওনেল মেসি। বার্সেলোনা ওই অ্যাওয়ে ম্যাচটা জিতেছিল ৪-০ ব্যবধানে।

    কিন্তু ওই দলের প্রত্যেকে কিন্তু সরাসরি লা মাসিয়া থেকে বার্সার মূল দলে সুযোগ পাননি। ২০০৩ সালে, ১৬ বছর বয়সে সেস্ক ফ্যাব্রিগাস বার্সেলোনা ছেড়ে আর্সেনালে যোগ দেন। বার্সেলোনার তারকাসমৃদ্ধ মূল দলে জায়গা পাওয়ার জন্য তখনো নিজেকে যোগ্য মনে করছিলেন না তিনি। তাই আর্সেনালে কয়েক মৌসুম কাটিয়ে, নিজেকে প্রমাণ করেই আবার ফিরে আসেন বার্সায়। জেরার্ড পিকেও মাঝে খেলেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে।

    একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তারকাবহুল বার্সেলোনা দলে সুযোগ পাওয়াটা আরো কঠিন হয়ে যায় লা মাসিয়া থেকে সদ্য ‘গ্র্যাজুয়েশন’ শেষ করা তরুণদের জন্য। এক সার্জি রবার্তো বাদে এই সময়ে বার্সার মূল দলে খেলা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য লা মাসিয়ানকে পাওয়া যায় না।

    এরপর ২০১৯ সালের দিকে লা মাসিয়া থেকে অমিত সম্ভাবনা নিয়ে বার্সেলোনার মূল দলে আসেন ফরোয়ার্ড আনসু ফাতি। সেন্টারব্যাক রোনাল্ড আরাউহোর উত্থানও ঘটে একই সময়ে, তবে লা মাসিয়ায় যোগ দেওয়ার সময়ে তাঁর বয়স ১৯ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই তাঁকে অন্যদের মতো পুরোপুরি ‘লা মাসিয়া গ্র্যাজুয়েট’ বলতে রাজি নন।

    তবে অরেলি আলতিমিরা কিন্তু লা মাসিয়ানদের মূল দলে জায়গা না পাওয়ার জন্য তাদের প্রতিভা বা কোয়ালিটির অভাবকে বিবেচনা করতে রাজি নন, বরং তিনি দায়ী করেছেন লা মাসিয়ার প্রতি ক্লাবের ‘বিমাতাসুলভ’ আচরণ এবং অন্য ক্লাব থেকে খেলোয়াড় কেনার প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়াকে।

    “দেখুন, আমাদের কাজ ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের জন্য খেলোয়াড়দের তৈরি করে দেওয়া,” আলতিমিরা বলেন, “এরপরের স্তরটা হলো বার্সা বি টিম (বর্তমানে বার্সেলোনা অ্যাথলেটিক হিসেবে পরিচিত। বার্সার রিজার্ভ দল, যারা এই মুহূর্তে স্পেনের তৃতীয় পর্যায়ে খেলে)। এই বার্সা বি দলে এমন কিছু ঘটনা ঘটছিলো, যাকে ঠিক স্বাভাবিক বলা চলে না।”

    “লা মাসিয়ার বদলে বি টিমে বাইরের ক্লাব থেকে খেলোয়াড় টানা শুরু হলো। এতে করে লা মাসিয়ানদের যেমন পরের ধাপে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল, ফলে তাদের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকলো। আবার বাইরের ওই খেলোয়াড়রাও তেমন ভালো মানের ছিলেন না বিধায় তাঁরাও মূল দলে জায়গা করে নিতে পারছিলেন না।”

    ওই সময়েই বার্সেলোনা বোর্ড বেশ কিছু ব্রাজিলিয়ান তরুণ খেলোয়াড়কে দলে টানে, কিন্তু তাঁদের কেউই ক্লাবে তেমন কোন প্রভাব রাখতে পারেননি।

    ২০১৩ সালে সান্তোস থেকে বার্সেলোনা দলে টেনেছিল ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারকে। তবে ওই চুক্তির আরো কিছু ধারা ছিল। সেই ধারা অনুসারে বার্সেলোনা সান্তোসকে অতিরিক্ত ৭.৯ মিলিয়ন ইউরো প্রদান করেছিল তিনজন ব্রাজিলিয়ান তরুণ খেলোয়াড়কে পরবর্তীতে দলে টানার জন্য।

    এরপর ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বার্সেলোনায় এসেছেন রবার্ট গনকালভেস, মারলন সান্তোস, ভিতিনহো, গ্যাব্রিয়েল নোয়াভেস, গুস্তাভো মাইয়া, ম্যাথিয়াস ফার্নান্দেজ, ম্যাথিয়াস পেরেইরার মতো ব্রাজিলিয়ানরা। কিন্তু তাঁরা মূল দলে জায়গা পাননি, বা পেলেও পারফরম্যান্স দেখিয়ে নিজেদের জায়গা পাকা করতে পারেননি।

    ওই একই সময়ে বার্সেলোনা থেকে অন্য ক্লাবে চলে যান বেশ কিছু তরুণ লা মাসিয়ান। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এরিক গার্সিয়া, জাভি সিমন্স, সার্জিও গোমেজ, আদ্রিয়ান বের্নাবে, রবার্ট নাভারো প্রমুখ। এর আগে ২০১৪ সালে ক্লাব ছাড়েন দানি অলমো।

    Image Source: Getty Images

    “আমরা চেয়েছিলাম বার্সেলোনা ব্র্যান্ডকে ধরে রাখতে, কিন্তু অনেক খেলোয়াড় এবং তাদের পরিবারই তখন অন্য কিছু চেয়েছিলেন,” আলতিমিরা বলেন, “তখন বার্সা ছেড়ে যারা অন্য ক্লাবে গেছেন, তার মধ্যে কিছু ছিল অর্থনৈতিক কারণে, আর কিছু ছিল স্পোর্টিং কারণে।”

    একই সময়ে বার্সেলোনা আরো কিছু প্রশ্নবিদ্ধ সাইনিং করায়।

    ২০১৬ এর জুলাইয়ে লেফটব্যাক জর্দি আলবার বিকল্প হিসেবে প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইন থেকে বার্সেলোনা ১৬.৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে নিয়ে আসে লুকাস দিনিয়েকে। অথচ একই সময়ে বার্সার সামনে সুযোগ ছিল লা মাসিয়ার আলেক্স গ্রিমালদোকে (বর্তমানে স্পেন এবং বেয়ার লেভারকুসেনের হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন) ‘পদোন্নতি’ দিয়ে মূল দলে নিয়ে আসার। দুই বছর পরে, বার্সার খেলার ধরনের সাথে মানিয়ে নিতে না পারায় এভারটনের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় দিনিয়েকে। আবার এক বছর পরে, ২০ মিলিয়ন দিয়ে রিয়াল বেতিস কিনে আনা হয় আরেক লেফটব্যাক জুনিয়র ফিরপোকে, যদিও লা মাসিয়ান হিসেবে মার্ক কুকুরেয়া (বর্তমানে স্পেন এবং চেলসির হয়ে খেলছেন) এবং হুয়ান মিরান্দা (রিয়াল বেতিসে এখন নিয়মিত খেলছেন) হতে পারতেন বিকল্প।

    Image Source: Getty Images

    এসব ব্যাপারে কথা বলেছিলেন বার্সেলোনার বর্তমান সেন্টারব্যাক এরিক গার্সিয়া। ২০১৭ সালে বার্সা ছেড়ে ম্যানচেস্টার সিটিতে গিয়েছিলেন এরিক, পরবর্তীতে ২০২১ সালে আবারও ফিরে আসেন তিনি।

    “আমার বয়স তখন ১৬,” এরিক বলেন, “আমার সাথে বার্সেলোনার চুক্তি তখন শেষের দিকে। বার্সা আমার সাথে নতুন চুক্তি করবে, বা আমাকে মূল দলে প্রোমোশন দেবে, এমন কোনো আশা আমার ছিল না। সিটি তখন আমার সাথে যোগাযোগ করে। তাদের স্পোর্টিং প্রজেক্টেও আমাকে সরাসরি মূল একাদশে জায়গা দেওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা অনুসারে আমার যে উন্নতি হতো, লা মাসিয়ায় সেটা সম্ভব ছিল না।”

    এমন আরেকটা উদাহরণ হতে পারেন আলেক্স কোয়াদো।

    ২০১৮ সালে আর্নেস্তো ভালভার্দে যখন বার্সা ম্যানেজার, একাডেমি-প্রোডাক্ট কোয়াদো তখন প্রতিনিয়ত চলে আসছিলেন মূল দলের কাছাকাছি। ভালভার্দের কাছের সূত্রগুলোও তখন বলছিল, কোয়াদো ভালভার্দের আস্থা অর্জন করে নিচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু এরপরই যা ঘটলো, তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন না ভালভার্দে। বোর্দো থেকে রাইট উইঙ্গার ম্যালকমকে ৪১ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে দলে ভেড়ায় বার্সেলোনা।

    বার্সেলোনায় ম্যালকমের সময়টাও ভালো যায়নি একেবারেই। এক মৌসুম পরে তিনি বিদায় নেন। ওদিকে কোয়াদোরও বার্সায় থাকা হয়নি। কিছু দিন বার্সেলোনা অ্যাথলেটিক আর লোনে বিভিন্ন দলে খেলেছেন, এরপর গত মৌসুমে তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয় রিয়াল বেতিসের কাছে। সেখানেও স্যালারি-লিমিট সংক্রান্ত সমস্যা হওয়ায় তাঁকে লোনে সৌদি আরবের আল ওখদুদ ক্লাবেও যেতে হয়েছিল।

    ২০১২ সালে পেপ গার্দিওলার প্রস্থানের পর থেকে বার্সেলোনার স্পোর্টিং ডিরেক্টর পদে পরিবর্তন এসেছে বারবার। আন্দোনি জুবিজারেতা, আইয়েদো ব্রাইদা, হাভিয়ের বোর্দাস, কার্লেস রেক্সাস, জর্দি মেস্ত্রে, রবার্ত ফার্নান্দেজ, এরিক আবিদাল, পেপ সেগুরা, র‍্যামন প্ল্যানেস, মাতেউ আলেমানি, জর্দি ক্রুইফের পর এখন ডেকো রয়েছেন এই অবস্থানে।

    লা মাসিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, এই সময়কালে লা মাসিয়ার ট্রেনিং মেথড এবং দর্শনেও এসেছে পরিবর্তন। সেগুরার প্রভাবে খেলোয়াড়দের টেকনিক্যাল স্কিলকে এই সময়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হতো।

    “বার্সেলোনার একাডেমিতে প্রতিভার কোনো অভাব নেই। আর এর সাথে যদি শারীরিকভাবে সুবিধা পাওয়া যায়, তাহলে লা মাসিয়া আরো উন্নত হবে,” সেগুরা বলেছিলেন, “তাই আমার সময়ে (২০১৭-২০১৯) আমি খেলোয়াড়দের শারীরিক সামর্থ্যের উন্নতির দিকে বেশি নজর দিয়েছিলাম, প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে প্রোগ্রামও ঠিক করেছিলাম।”

    ২০২১ সালের শেষ দিকে বার্সেলোনার ম্যানেজারের দায়িত্ব নেন জাভি। কিন্তু ২০১৫ সালে খেলোয়াড় হিসেবে যে বার্সেলোনাকে দেখে গিয়েছিলেন তিনি, তার চেয়ে এই বার্সা ছিল অনেক আলাদা। যদিও প্রধানত মূল দলের ট্রেনিংয়ের ব্যাপারেই মন্তব্য করেছিলেন তিনি, কিন্তু যুব পর্যায়েও অনেকটা পাল্টে গিয়েছিল বার্সেলোনা।

    “বার্সেলোনায় অনেক দিন পজিশনাল প্লে (জোগো দে পজিশন)-এর চর্চা হচ্ছে না,” জাভি বলেন, “এটা অবিশ্বাস্য। অনেক খেলোয়াড়ের কোন ধারণাই নেই যে আমরা আসলে কীভাবে খেলে থাকি। বার্সার মূল দলের খেলোয়াড়রা পজিশনাল প্লে বুঝতে পারছে না, এটা অদ্ভুত, অকল্পনীয়।”

    “মাত্র এক মাস হলো আমি এখানে এসেছি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি যে অনেক অনেক পরিবর্তন দরকার। নতুন খেলোয়াড়দের তো অবশ্যই আনতে হবে, পাশাপাশি আমাদের দর্শন, রুটিন এবং অন্যান্য ব্যাপারেও পরিবর্তন আনতে হবে।”

    সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বার্সার একাডেমিতে পরিবর্তন এসেছে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। লা মাসিয়াতে থাকা খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেড়েছে। লা মাসিয়ার আগের বিল্ডিংয়ে যেখানে ২০ জনেরও থাকার ব্যবস্থা ছিল না, ক্লাবটির ট্রেনিং কমপ্লেক্সে সেখানে এখন ৮০-এর বেশি তরুণ খেলোয়াড় থাকতে পারেন।

    তরুণ প্রতিভাদেরকে এখন ক্লাবে বিবেচনা করা হয় ‘স্পেশাল প্রজেক্ট’ হিসেবে। তাঁদেরকে ক্লাবে রেখে দেওয়ার জন্যও সব ধরনের চেষ্টা করা হয়।

    Image Source: Getty Images

    অতীতে টাকা-পয়সার প্রতি আগ্রহের জন্য অনেকে ক্লাব ছাড়তেন, সেটা আটকানোর জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ২০১৯ সালে আনসু ফাতি এবং ইলাইশ মরিবার সাথে চুক্তির ক্ষেত্রেও টাকা-পয়সার অঙ্কগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি ছিল। ফরাসি ক্লাব নিস তখন আনসু ফাতির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, আর মরিবার প্রতি আগ্রহ ছিল প্রিমিয়ার লিগের ম্যানচেস্টার সিটির। তাই এই দুজনের সাথে চুক্তি নবায়ন করে তাঁদের ক্লাবে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করে বার্সেলোনা। বার্ষিক ২ মিলিয়ন ইউরো তো ১৬ বছর বয়সীদের জন্য একটা বড় অঙ্কই বটে!

    “আমাদের ধারণা ছিল, সবচেয়ে খারাপ ক্ষেত্রে হয়তো আমরা তাদেরকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবো,” আলতিমিরা বলেন, “এবং মরিবার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।”

    ২০২১ সালে ১৬ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সা থেকে লাইপজিগে পাড়ি জমান ইলাইশ মরিবা।

    ইউরোপের এসব ট্রান্সফারে ভূমিকা রেখেছে ব্রেক্সিটও। এখন ইংলিশ ক্লাবগুলো ভিনদেশের অনূর্ধ্ব-১৮ বয়সী খেলোয়াড়দেরও স্বাক্ষর করাতে পারে। গত মৌসুমেই ম্যানচেস্টার সিটি আগ্রহ দেখিয়েছিল পাউ কুবারসির দিকে। মূলত সিটি ফুটবল গ্রুপের (সিএফজি) অধীনে প্রথমে স্প্যানিশ ক্লাব জিরোনার হয়ে কুবারসিকে খেলিয়ে পরবর্তীতে ম্যানসিটিতে খেলানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। কুবারসির সাথে অবশ্য নতুন চুক্তি করে ফেলেছে বার্সেলোনা। ২০২৭ অবধি ওই চুক্তিতে তাঁর রিলিজ ক্লজ রাখা হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ইউরো। 

    এই তরুণ লামিন-কুবারসিদের পথ ধরেই চলতি মৌসুমে বার্সেলোনায় নিয়মিত হয়েছেন মিডফিল্ডার মার্ক বের্নাল এবং মার্ক কাসাদো। এর আগে আলেহান্দ্রো বালদে, ফারমিন লোপেজ, পাবলো গাভিও আলো ছড়াতে শুরু করেছেন বার্সেলোনার মূল দলের হয়ে, লাইপজিগ থেকে ফিরে এসেছেন দানি অলমোও। নিজেদেরকে মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তা-পুয়োলদের কাতারে তাঁরা নিয়ে যেতে পারবেন কিনা সেটা সময়েই বলে দেবে, কিন্তু এই চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থায় মুহূর্তে লা মাসিয়ার ওপরেই ভরসা রাখতে হবে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনাকে।