ডি টুকোমস্টের দুঃসময় এবং আয়াক্সের মলিন বর্তমান। লা মাসিয়া সিরিজ। পঞ্চম পর্ব
ডি টুকোমস্ট। দ্যা ফিউচার। ভবিষ্যৎ। আয়াক্স আমস্টারডামের একাডেমি।
এই একাডেমি আর আয়াক্সের হোম ভেন্যু দ্য ইয়োহান ক্রুইফ এরেনার মাঝে একটা পদচারী সেতু আছে। পায়ে হেঁটে একাডেমি থেকে স্টেডিয়ামে যেতে সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা দারুণ একটা চিত্র তুলে ধরে। এই পাঁচ মিনিটের দূরত্বটা অতিক্রম করে আয়াক্সের মূল দলের জার্সি গায়ে তোলার স্বপ্ন বুকে নিয়েই নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একাডেমিতে এসে পৌঁছায় বিভিন্ন বয়সী শিশু-কিশোররা।
Image Source: ANP
প্যাভিলিয়নের ‘লা মাসিয়া সিরিজের’ পঞ্চম পর্বে থাকছে আয়াক্স এবং এর একাডেমি ডি টুকোমস্টের গৌরবোজ্জ্বল অতীত, খেলোয়াড় বাছাইয়ের প্রক্রিয়া আর মলিন বর্তমানের গল্পগুলো।
ডি টুকোমস্টের শুরুটা আজ থেকে প্রায় ১২৪ বছর আগে। ১৯০০ সালের ১৮ মার্চ নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে প্রতিষ্ঠিত হয় আয়াক্সের এই একাডেমি। এই মুহূর্তে একাডেমির ধারণক্ষমতা প্রায় ৫,০০০। একেবারে ৫ বছরের শিশু থেকে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ উনিশ বছরের তরুণও রয়েছেন এই একাডেমিতে। এই খেলোয়াড়দের বাছাই করার জন্য নেদারল্যান্ডসে রয়েছেন আয়াক্সের ৫০ জন স্কাউট, আর পুরো ইউরোপজুড়ে রয়েছেন আরো অন্তত ৫ জন। প্রাথমিক বাছাইয়ের পরে ’ট্যালেন্টডাগেন’ নামের একটা প্রতিভা-অন্বেষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় শিশু-কিশোরদের জন্য। সেই প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রতিভা দেখিয়েই আয়াক্সের একাডেমিতে সুযোগ পায় প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা।
একাডেমিতে খেলোয়াড়দের ট্রেনিংটা হয় মূল দলের খেলার স্টাইলেই। স্টাইল বলতে রাইনাস মিশেলের সেই ‘টোটাল ফুটবল’। বল নিয়ন্ত্রণ, পজিশনাল প্লে, মুভমেন্ট, মাইন্ডসেট, কৌশল, বুদ্ধিমত্তা, আর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গঠনের সাথে সাথে ছোটবেলা থেকেই ৪-৩-৩ ফরমেশনের টোটাল ফুটবলে অভ্যস্ত করে ফেলা হয় খেলোয়াড়দের, যেন পরবর্তীতে এদের মধ্য থেকেই আসেন ভবিষ্যতের ইয়োহান ক্রুইফ, মার্কো ফন বাস্তেন, ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডরা।
Image Source: Getty Images
শুধু ক্রুইফ-বাস্তেন-রাইকার্ড নন, আয়াক্সের এই একাডেমি থেকে উঠে আসে কিংবদন্তির তালিকায় রয়েছে আরো কিছু বড় বড় নাম। ডেনিস বার্গক্যাম্প, ক্লারেন্স সিডর্ফ, প্যাট্রিক ক্লাইভার্ট, ওয়েসলি স্নেইডারদের এই তালিকায় ইয়োহান নিসকেন্স, মাইকেল রেইজিগার, এডউইন ফন ডার সার, এডগার ডেভিডস, রুড গুলিত, ফ্রাঙ্ক ডি বোর, নাইজেল ডি ইয়ং, রাফায়েল ফন ডার ভার্টদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। রোনাল্ড কোম্যান, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, ক্রিস্টিয়ান চিভু, ক্লাস-ইয়ান হান্টেলারদের ক্যারিয়ারও শুরু হয়েছিল আয়াক্সের একাডেমি থেকেই। এই বড় বড় নামগুলোই বলে দেয়, একাডেমি হিসেবে আয়াক্সের ডি টুকোমস্ট ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা।
ইয়োহান ক্রুইফ এবং ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড; Image Source: AP
‘ছিল’-ই বলতে হচ্ছে, কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্লাব হিসেবে আয়াক্সের মাঠের পারফরম্যান্সে যেমন অধঃপতন দেখা দিয়েছে, একই সাথে দুঃসময় চলছে একাডেমিতেও। আগে যেভাবে নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলেও আয়াক্সের একাডেমির খেলোয়াড়দের দেখা যেত, সেই সংখ্যাটাও এখন কমে গেছে।
এখন পর্যন্ত বড় মঞ্চে নেদারল্যান্ডসের সাফল্য বলতে ১৯৮৮-এর ইউরো জয়। সেই দলের পাঁচজন ছিলেন আয়াক্সের খেলোয়াড়, পাশাপাশি রোনাল্ড কোম্যান-ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড-মার্কো ফন বাস্তেন ছিলেন ওই একাডেমি থেকে উঠে আসা।
২০১০ সালের পরে কোন বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা হয়নি নেদারল্যান্ডসের। কিন্তু চৌদ্দ বছর আগের ওই দলেও ছিলেন আয়াক্সের একাডেমির কিছু গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। গোলরক্ষক মার্টেন স্টেকেলেনবার্গ তো ছিলেনই, সাথে ওয়েসলি স্নেইডার, রাফায়েল ফন ডার ভার্ট, নাইজেল ডি ইয়ং, জনি হেইটিঙ্গার মতো মূল খেলোয়াড়রাও বেড়ে উঠেছিলেন ডি টুকোমস্ট থেকে।
এবার ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে আসা যাক ২০২৪ সালে।
চোটের কারণে মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং দলের বাইরে চলে যাওয়ায় চলতি বছরের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ডি টুকোমস্টের খেলোয়াড় বলতে ছিলেন ম্যাথিয়াস ডি লিখট, রায়ান গ্রাভেনবাখ আর স্টিভেন বার্গউইন। এদের মধ্যে স্টিভেন বার্গউইনই মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন যা একটু।
নেদারল্যান্ডস দলে এখন আর নেই আয়াক্স-আধিক্য; Image Source: Getty Images
আগের মতো আয়াক্সের একাডেমির খেলোয়াড়দের দিয়ে নয়, নেদারল্যান্ডসের এই দলের মেরুদণ্ডটা তৈরি হয়েছে এফসি গ্রোনিঞ্জেনের ভার্জিল ফন ডাইক, ফেইনুর্দ এবং চেলসির নাথান আকে, পিএসভি আইন্দহোভেনের কোডি গাকপো আর বার্সেলোনা এবং পিএসজির জাভি সিমন্সদের নিয়ে। রূঢ় বাস্তবতা এটাই, যে চোটমুক্ত ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ছাড়া ডি টুকোমস্টের কোন খেলোয়াড়ই এখন নেদারল্যান্ডস দলের জন্য অপরিহার্য নন।
ওদিকে আয়াক্সের মাঠের দুরবস্থা বোঝার জন্য ডাচ লিগে তাদের অবস্থান দেখাটাই যথেষ্ট। চলতি মৌসুমে, নিজেদের প্রথম চার ম্যাচের পরে এরেদিভিসিতে আয়াক্সের অবস্থান দশে। এর আগে গত মৌসুমটা দলটা শেষ করেছিল পাঁচে। কে বলবে, ২০২২-২৩ মৌসুমের আগে এই দলটাই টানা চারবার শিরোপা জিতেছিল ডাচ লিগে। ২০১৮-১৯ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে লুকাস মৌরার হ্যাটট্রিকে টটেনহ্যামের কাছে নাটকীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ফাইনাল-বঞ্চিত হয় দলটি, আর সেই দলটাই কিনা এখন সুযোগই পায় না ইউয়েফার ক্লাবগুলোর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে।
কেন এই দুরবস্থা আয়াক্সের?
বায়ার্ন মিউনিখ, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের মতো দলগুলোকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে খেলা ওই আয়াক্স দলের মূল কারিগর ছিলেন স্পোর্টিং ডিরেক্টর মার্ক ওভারমার্স এবং ম্যানেজার এরিক টেন হ্যাগ। তাঁদের পরিকল্পনা, প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ানো এবং খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স, সব মিলিয়ে এসেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগে আয়াক্সের ওই সাফল্য। তরুণ ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, ম্যাথিয়াস ডি লিখট, হাকিম জিয়েখ, ডনি ফন ডি বিকের সাথে অভিজ্ঞ দুসান তাদিচ আর ডেলি ব্লিন্ডের দারুণ সমন্বয়ে আয়াক্সের স্বর্ণালী ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন অনেকেই। পরের মৌসুমে কয়েকজন মূল খেলোয়াড় ক্লাব ছাড়লেও আয়াক্সের ঘরোয়া সাফল্য ছিল অব্যাহত।
কিন্তু আয়াক্সের সেই সুখস্বপ্ন স্থায়ী হলো না।
মার্ক ওভারমার্স; Image Source: Getty Images
নারী সহকর্মীদের সাথে অশোভন আচরণ করার কারণে ২০২২ সালে বরখাস্ত হন স্পোর্টিং ডিরেক্টর মার্ক ওভারমার্স। এর কিছুদিন পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটডের দায়িত্ব নেন ম্যানেজার এরিক টেন হ্যাগ। এই দুজনের প্রস্থানের পরই ক্লাবে দেখা দেয় ‘পাওয়ার ভ্যাকিউম’। কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতায় ওভারমার্সের সমমানের কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। যাদেরকে নিয়োগ করা হলো, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন অনভিজ্ঞ এবং অদক্ষ। সদ্য লিগ জেতা দলটার অধঃপতনও শুরু তখন থেকেই। ততদিনে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, ম্যাথিয়াস ডি লিখট, ফন ডি বিক, সার্জিনিও ডেস্টের পর ওই গ্রীষ্মে ক্লাব ছেড়েছেন অ্যান্টনি, লিসান্দ্রো মার্তিনেজ, সেবাস্টিয়ান হলার, রায়ান গ্রাভেনবাখ, নিকোলাস তাগলিয়াফিকোরা। ওই তালিকায় পরের মৌসুমে যুক্ত হয়েছেন এডসন আলভারেজ, হাকিম জিয়েখ, মোহাম্মদ কুদুস আর ক্যাসপার ডলবার্গরাও।
কিন্তু এই খেলোয়াড়দের প্রস্থানটা আয়াক্সের জন্য সমস্যা হতো না, যদি মার্ক ওভারমার্সের কেউ দারুণভাবে প্রতিভা বাছাই করে আনতে পারতেন, কিংবা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারতেন দক্ষিণ আর মধ্য আমেরিকায়। কিন্তু ওভারমার্সের স্থলাভিষিক্ত হওয়া স্ভেন মিসলিনটাট সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেন পুরোপুরি। তিনি যে খেলোয়াড়দের আনতেন, তাঁদের প্রায় সবাই-ই ছিলেন অপ্রমাণিত। এমনকি নিজেদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতেও তাঁরা ছিলেন অপারগ।
এদিকে আয়াক্সের মাঠের পারফরম্যান্স খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকলো। লিগ চ্যাম্পিয়ন দলটি ধীরে ধীরে নেমে যেতে থাকলো পয়েন্ট টেবিলের নিচের দিকে, ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকেও নাম কাটা গেল। সব মিলিয়ে নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে গেল আয়াক্স। আর ওদিকে টেলিভিশন স্বত্ত্বের কারণে এরেদিভিসি থেকেও খুব বেশি অর্থ আসে না। ২০২২-২৩ মৌসুমে টিভি রাইটস রেভিনিউ থেকে মাত্র ১০ মিলিয়ন ইউরো পায় আয়াক্স। তুলনার স্বার্থে বলে রাখা, ওই মৌসুমে লা লিগা থেকে একই খাতে রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনা পেয়েছিল যথাক্রমে ১৫৫.৭৯ ও ১৫৫.১ মিলিয়ন ইউরো।
এসব কারণে, ক্লাবের বাড়তি আয়ের জন্য প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বিক্রি করার প্রয়োজন হয় আয়াক্সের। কিন্তু পাশাপাশি নতুন খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স আশানুরূপ না হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাবটা পড়ে মাঠের পারফরম্যান্সে। চলমান এই দুঃসময়ে আয়াক্স আরো একবার শরণাপন্ন হয়েছে নিজেদের একাডেমির। স্কোয়াডে থাকা তরুণ ডিফেন্ডার ইয়োরেল হাটো, ডিয়েস জানসে, ইয়ুরি বাস, ডেভিন রেন্স, মিডফিল্ডার কেনেথ টেইলর, ডেভি ক্লাসেন, ফরোয়ার্ড হুলিয়ান রাইকফ, প্রত্যেকেই উঠে এসেছে ডি টুকোমস্ট থেকে।
আর ইতিহাস যেমনটা বলে, আয়াক্সের হারানো সুসময় ফিরিয়ে আনতে হলে এগিয়ে আসতে হবে ওই ডি টুকোমস্টকেই!