• ইউরো
  • " />

     

    ভাই যখন "শত্রু"

    ভাই যখন "শত্রু"    

    ১.

    নিজের দেশ ছেড়ে স্বামীর সাথে পাড়ি জমিয়েছিলেন এখানে। তাও খুব বেশিদিন আগের কথা নয়! সুইজাল্যান্ডের এই শহরটায় এলমেজের পরিচিত মুখের বড্ড অভাব। কসোভো থেকে তাঁদের মতো আরও যারা এসেছিলেন বাসেলে, তাঁদের নিয়ে ছোট্ট একটা কমিউনিটি আছে এখানে। ওদের সাথেই উঠবস। এর বাইরে তেমন পরিচিত নেই বললেই চলে।

    রাগিপ শাকা আর এলমেজের ঘরে দুই ছেলে। দু’জনের মাঝে বয়েসের পার্থক্যটা মাত্র বছর দুয়েকের, চেহারার গড়নও একই ধাঁচের। ছুটির দিনে মা একই জামা-কাপড় পরিয়ে দু’জনকে নিয়ে ঘুরতে বেরুলে অনেকেই প্রথম দেখায় যমজ ভেবে ভুল বুঝত। এলিও বোধ হয় বেশ উপভোগই করতেন ঘটনাটি!

    সুইজারল্যান্ডে নতুন এসে বাগানের মালীর কাজ নিয়েছিলেন রাগিপ; দু সন্তান নিয়ে নিয়ে রাগিপের একার রোজগারে সংসার চলত না। বাসেলের বাড়ি ভাড়ার পুরোটাই আসত এলমেজের বেতন থেকে।  

    ২.

    রাগিপ আর এলমেজের ছোট্ট বাড়ির পাশেই এফসি বাসেলের একাডেমি। সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব! ইউরোপেও তাদের দাপট কম নয়। বাবার সিদ্ধান্তে তলান্ত আর গ্রাণিত দুই ছেলেকেই ভর্তি করান হল শহরের এক ফুটবল দলে, কনকর্ডিয়া বাসেল। প্রতিভার অভাব ছিল না, সাথে ছিল প্রচন্ড ইচ্ছে শক্তি। বয়স বাড়তেই তাই সুযোগ হয়ে গেল এফসি বাসেলেও। দুজনেরই একসাথে!

    দেখতেই শুধু যমজ নয়, দু’ ভাইর আচরণেও যথেষ্ট মিল! মাথাটাও বেশ গরম, রগচটা স্বভাবের! মাঠের খেলায়ই তার প্রমাণ। আবার অমিলগুলোও কম নয়। মায়ের মতে ছোট ছেলেটাই বেশি দায়িত্ববান। বাড়ির চাবিটা বড় ছেলের চেয়ে বরং ছোটছেলে গ্রাণিতকে দিয়েই শান্তিমতো কাজে যেতে পারতেন নাকি! বড় ছেলেটা নাকি কেমন একটু আনমনা, কর্তব্যপরায়ণতা তার সাথে ঠিক সেভাবে খাপ খায়না! 

    ৩.

    ফুটবলে একই দলে দুই সহোদরের খেলা নতুন কিছু নয়। জেরম বোয়াটেং- কেভিন প্রিন্স বোয়াটেংরা তো বিশ্বকাপ খেলেছেন একে অপরের বিপক্ষে, জার্মানি আর ঘানার হয়ে। তবে আপন ভাই না হওয়ায় তা বোধ হয় মেনেই নেয়া যায়! একই দেশের হয়ে মোট ৪ জোড়া ভাই খেলছেন এবারের ইউরোতেও।

    কিন্তু তলান্ত শাকা আর গ্রাণিত শাকার পরীক্ষাটা আরও কঠিন! সেই যুগের প্লাতিনি থেকে এখনকার ইনিয়েস্তা- ইউরো পরীক্ষা নিতে ছাড়েনি কাউকেই। ভাই-ভাইয়ের যুদ্ধটাই বাকী থেকে গিয়েছিল এতোদিন!

    শাকা ভাতৃদ্বয়ের কল্যাণে আজ সেই ঘটনারও সাক্ষী হতে চলেছে ইতিহাস! আপন দুই ভাই, যাদের যমজ ভেবে ভুল করতেন অনেকেই, চলনে-বলনে, কথায় যাদের তফাত মেলা ভার- তাঁদেরকেও আজ মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আলবেনিয়া-সুইজারল্যান্ড ম্যাচ। লাল-কালো রঙের আলবেনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবেন তলান্ত। আর সুইজারল্যান্ডের সাদায় দেখা যাবে গ্রাণিতকে।

    ৪.

    এফসি বাসেলের সেন্ট্রাল ডিফেন্সে খেলেন তলান্ত শাকা। কিশোর বয়সে যোগ দেয়ার পর এই ক্লাবের বাইরে আর কোথাও যাওয়া হয়নি তার। মাঝে অবশ্য এক বছর ধারে ছিলেন গ্রাসহপার্স নামের এক ক্লাবে।

    গ্রাণিতের শুরুটা বড় ভাইয়ের হাত ধরেই। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বড় ভাইয়ের চেয়ে বরং নিজেই বেশি নজর কাড়তে শুরু করেন। কৌশল, গতি, মেধা সবদিক থেকেই এগিয়ে থাকায় তলান্তের আগে বাসেলের মূল একাদশে জায়গা হয় গ্রাণিতেরই। ততোদিনে অবশ্য সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে দুজনই প্রতিনিধিত্ব করছিলেন নিজেদের দেশকে।

    ২০১২ সালে জার্মান ক্লাব মশেনগ্লাডবাখের নজর পড়ে গ্রাণিতের ওপর। গ্রাণিতকে ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা না করে তলান্তকে গ্রাসহোপার্স থেকে ফিরিয়ে দলে আনে বাসেল। সেই থেকে বাসেল দলের নিয়মিত সদস্য তলান্ত শাকা।

    আর মশেনগ্লাডবাখে পাড়ি জমান গ্রানিত। চার মৌসুম জার্মানিতে নিজের জাত চিনিয়ে মাত্র ক’দিন আগেই আর্সেনালে নাম লিখিয়েছেন গ্রাণিত শাকা। এবারের সুইজারল্যান্ড দলের সবচেয়ে বড় তারকাও তিনিই।

    ৫.

     

    নব্বইর দশকের শেষের দিকে যুগোস্লাভিয়ার  জাতিগত বিদ্বেষ রূপ নিয়েছে আন্দোলনে। দানা বাঁধা আন্দোলন একটু একটু করে যুদ্ধের দিকেই গড়াচ্ছে। সে আন্দোলনে অনেকের মতো যোগ দিয়েছিলেন রাগিপ শাকাও। অপরাধটা ছিল যুগোস্লাভিয়া সরকারের বিরোধীতা করা। কসোভো আলবেনিয়ান হবার দোষে জেল খাটতে হল ৩ বছর। ওই তিন বছরে পনের দিন পর পর রাগিপের সাথে দেখা করার সুযোগ হত এলমেজের।

    ১৯৯০ সালে যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে মুক্তি মেলে রাগিপের। তবে শর্ত জুড়ে দেয়া হল- ছাড়তে হবে দেশ। স্ত্রীকে নিয়ে সুইজ্যারল্যান্ড যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেখানেই জন্ম হল তলান্ত, গ্রাণিত ভাতৃদ্বয়ের। তাঁদের মতো আরও প্রায় দুই লাখ শরনার্থী সেবার এসেছিলেন সুইজারল্যান্ডে। যাদের কল্যাণে এখন ইউরোপের শীর্ষস্তরের ফুটবলে নিজেদের নাম উজ্জ্বল করছে সুইজারল্যান্ড! 

    ৬.

    ২০১২ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে মুখোমুখি সুইজারল্যান্ড-আলবেনিয়া। ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার সময় প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে গোলরক্ষককে একা পেয়ে শুট না করে আস্তে বলটা ঠেলে দেন বারের দিকে। গোলরক্ষকও লুফে নেয় সেই দূর্বল কিকটি। গোলে শট নেয়া সেই খেলোয়াড়টি ছিলেন গ্রাণিত শাকা। অমন মিসের পর গোটা সুইজারল্যান্ড জুড়েই বয়ে গিয়েছিল সমালোচনার ঝড়। আলবেনিয়ার প্রতি টানটা আছে বলেই নাকি ইচ্ছে করে গোল করেননি গ্রাণিত শাকা!

    ওই এক তুচ্ছ ঘটনায় শত্রু বনে যেতে পারতেন নিজ দেশ সুইজারল্যান্ডে। আবার নিজের আরেকদেশ আলবেনিয়াও যে তাতে আনন্দিত হত তাও নয়। আলবেনিয়ায় ফিরতি ম্যাচে পুরো ৯০ মিনিট জুড়েই দুয়ো শুনতে হয়েছিল গ্রাণিত শাকাকে। অপরাধ ছিল আলবেনিয়ার হয়ে না খেলতে চাওয়া!

    নিজ দেশের সমর্থকদের এমন আচরণে পাওয়া দুঃখটা নাকি বুকে বিঁধেছিল অনেকদিন। নিজেকে আলবেনিয়ানই ভাবেন এখনও কিন্তু  পেশাদারিত্বে আবেগের ছাপ ফেলার জায়গা নেই। সুইজারল্যান্ডের হয়েই মন প্রাণ উজাড় করে খেলেন। আলবেনিয়ার বিপক্ষে তো বটেই, নিজের আপন ভাইয়ের বিপক্ষে এমন প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচেও নাকি খেলতে চাননি কখনই। বড় ভাই তলান্তের সেই একই মত!   

    দুই ভাইয়ের দুই দেশের হয়ে খেলা নিয়ে আবেগটা বোধ হয় ছুঁয়ে যাচ্ছে আপনাকেও! তবে জেনে রাখুন, ওরা দুজনই শুধু নয়! আজকের সুইজারল্যান্ড-আলবেনিয়া ম্যাচে দুই দলে মোট ১৫ জন খেলোয়াড় আছেন যারা খেলতে পারতেন দু দেশের হয়েই! কারনটা অনুমান করতে পারছেন নিশ্চয়ই? ২৬ বছর আগের যুগোস্লাভিয়া ভাগের যুদ্ধের সময় শরনার্থী হয়ে আসা খেলোয়াড়েরই আসলে সুযোগ পেয়েছিলেন আলবেনিয়ার হয়ে খেলার। শাকিরি, বেহরামিরাও শাকা ভাতৃদ্বয়ের মতোই কসোভো আলবেনিয়ান।

    ওই ১৫ জনের ছয় জন বেছে নিয়েছেন আলবেনিয়াকে। তাঁদের মধ্যে একজন তলান্ত। সুইজারল্যান্ডের জাতীয় দলের কাছ থেকে কোনো প্রস্তাব না পেয়েই আলবেনিয়াকে বেছে নিয়েছেন তলান্ত। একই কথা প্রযোজ্য গ্রাণিতের ক্ষেত্রেও! আলবেনিয়ার চেয়ে সুইজারল্যান্ড তাঁর আগে যোগাযোগ করায় নাকি সুইসদের হয়েই খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই মিডফিল্ডার। অন্তত দুই দেশে দুই ভাইয়ের খেলার ব্যাপারেও তাঁদের নিজের ভাষ্যটা এমনই!  

    ৭.

     

    স্টেডিয়ামের গ্রান্ড স্ট্যান্ডে বসে দুই ছেলের খেলা দেখতে আজ মাঠে হাজির হবেন রাগিপ শাকা। ওই মুহুর্তে তিনিই বোধ হয় পৃথিবীর সব থেকে গর্বিত বাবা। কাকে সমর্থন যোগাবেন? সে প্রশ্নের জবাব জানা নেই ভদ্রলোকের। তবে ছোট ছেলে বলে রেখেছেন বাবা সুইজ্যারল্যান্ড হলে মাকে করতে হবে আলবেনিয়া! নইলে ঠিক উল্টোটা।

    আলবেনিয়া আর সুইজারল্যান্ডের ম্যাচটা আসলে শুধু এই দুই ভাইয়ের একে অপরের বিপক্ষে খেলার জন্যই আলাদা নয়। এই সংঘাত-হানাহানির যুগে বন্ধুত্বের বড় একটা নিদর্শনও বটে।