"এ সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ার"
*
অক্টোবরের রেকিয়াভিকের রাতটা অন্যান্য সময়ের চেয়ে যেন একটু বেশিই ঠান্ডা ছিল। সাধারণত নভেম্বরের আগে ঠান্ডাটা জেঁকে বসে না এখানে। ফাক্সাফলি উপসাগর থেকে বয়ে আসা কনকনে হিমেল হাওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছিল এবার শীতের রাতগুলো আরও ভয়ঙ্করভাবেই হানা দেবে আইসল্যান্ডে! এরই মধ্যে রাজধানীর জাতীয় স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছে হাজার দশেক সমর্থক। লগারডাসভ্লার স্টেডিয়ামের স্থাপত্য শৈলী আবার অনেকটা ইংল্যান্ডের তৃতীয় সারির দলগুলোর স্টেডিয়ামের মতো। দুই গোলবারের পেছনেই ফাঁকা, কয়েকশ মানুষের ছোট গ্যালারি। পার্থক্য শুধু এই স্টেডিয়ামের সাথে অতিরিক্ত একটা অ্যাথলেটিক ট্র্যাকের সংযোজন! উত্তর সাগর থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ দূরত্ব স্টেডিয়ামটার। রেকিয়াভিকে যে কান পাতলেই শোনা যায় সাগরের গর্জন !
*
রেকিয়াভিকের মাঠে সেদিন আইসল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল মাত্র চার মাস আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া দল; ভ্যান বাস্তেন, ইয়োহান ক্রুইফদের টোটাল ফুটবলের দেশ। তিনবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দল। আর আইসল্যান্ড? সব মিলিয়ে ২৩ বারের চেষ্টায়ও কোনদিন মুখ দেখেনি প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টের। দু’দলের অমন আকাশ পাতাল ফারাক না থাকলে বাকী পাঁচ হাজার আসন নিয়ে কাড়াকাড়ি বেঁধে যেত শান্তির শহরে!
ইউরো বাছাই পর্বের প্রথম ম্যাচে তুরস্ক আর পরের ম্যাচে লাটভিয়াকে হারিয়ে কিছুদিন আগেই নিজেদের ইতিহাসে প্রথম টানা দু ম্যাচ জয়ের রেকর্ড গড়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটি। এই তো অনেক! নেদারল্যান্ডের বিপক্ষের যত কম গোলে হারা যায় ততোই ভালো- এমন একটা বিশ্বাস নিয়েই খেলা দেখতে হাজির হয়েছিলেন আইসল্যান্ডাররা। হতাশ হবার প্রস্তুতি নিয়ে এসে উল্টো নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেদের জীবনের সেরা প্রাপ্তি, দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন!
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওই ম্যাচে ডাচদের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় তুলে নেয় আইসল্যান্ড। টানা তিন জয়ে ইউরোর বাছাইপর্বে তখন চেক প্রজাতন্ত্রের সাথে গ্রুপের শীর্ষে অবস্থান আইসল্যান্ডের। ইউরোর মূলপর্বে খেলার স্বপ্নটা আসলে তখন থেকেই বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে ছোট্ট দেশটার।
*
বাছাইপর্বে ডাচদের বিপক্ষে হোম-অ্যাওয়ে সহ মোট ৬ জয় নিয়ে গ্রুপের দ্বিতীয় দল হয়ে সরাসরি ইউরোতে জায়গা করে নেয় আইসল্যান্ড। বাদ পড়ে ডাচরা! মাত্র ৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষের দেশটা কাঁপিয়ে দেয় আসলে গোটা ফুটবলটাকেই। আর ইউরোর প্রথম ম্যাচেই পর্তুগালের সঙ্গে ড্র করে এরই মধ্যে আইসল্যান্ডাররা জানান দিয়ে দিয়েছে ইউরোর বাছাইপর্বের সাফল্যটা আর যাই হোক ‘ফ্লুক’ ছিল না।
এরই মধ্যে হয়ত আইসল্যান্ড রূপকথার সাথে মিল খুঁজে পেয়েছেন লেস্টার সিটির মহাকাব্যিক উত্থানের! তবে পার্থক্যটা হল ইংল্যান্ডের ওই শহরের জনসংখ্যাও আইসল্যান্ডের চেয়ে তিন গুণ বেশি। আদতে লেস্টারের চেয়ে বড় রুপকথারই জন্ম দিয়েছে ফায়ার আর আইসের দেশটি!
*
ফায়ার, আইস? তেল-জল মেলে কী করে! ফুটবলের মতোই এই দেশটিও আরেক বিস্ময়! দুই পাশে উত্তর আর আর্কটিক সাগর। পুরো দ্বীপটাই ওই ‘ভলকানিক’ রকের।
রাজধানী রেকিয়াভিকেই বসবাস দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষের। অল্প মানুষের দেশ হওয়ায় এখানকার মানুষের মাঝের আত্মার সম্বন্ধটাও বেশি। ছোটখাট, ছিমছাম সাজান শহরটায় তাই পুলিশের প্রয়োজনও পড়ে না তেমন। আইসল্যান্ডের এমন রূপ বৈচিত্র্যের কারনেই বোধ হয় বিশ্বের গড় মানুষপ্রতি সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশও হয় এ দেশ থেকেই। আইসল্যান্ডের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভাইকিংসরাও বনে গিয়েছিলেন কবি সাহিত্যিক!
গ্রীষ্মের দিনগুলোয় এখানে সূর্য অস্ত যায় না। তখন বেশ আমোদ-প্রমোদেই দিন কাটে আইসল্যান্ডারদের। আর বরফে ঢাকা শীতকালে সেই সূর্যের দেখাই মেলে না অনেকদিন! লেখা-লেখি, আর নানান রকমের খেলায় মজে থেকেই দিনগুলো পার হয়ে যায় তখন। যে কোন খেলায় আইসল্যান্ডারদের সর্বোচ্চ সাফল্য ২০০৮ অলিম্পিকে হ্যান্ডবল দলের রৌপ্য পদক অর্জন আর ফুটবলে এডার গুডিয়েনসেনের চেলসি আর বার্সেলোনার হয়ে শিরোপা জেতা!
অহেতুক সাহিত্য রচনা নয়, বরং এই ব্যাপারগুলোর সবই আইসল্যান্ডের ফুটবল সম্পর্কিত। মাত্র ছ’মাস সবুজ ঘাসে ফুটবল খেলা যায় যে দেশে সেখান থেকে একটা জাতীয় ফুটবল দল থাকাটাই সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর ইউরোর মতো প্রতিযোগিতা তো রূপকথা!
*
কিন্তু এমন সাহসী স্বপ্নই দেখেছিলেন আইসল্যান্ডের হর্তা-কর্তারা। নব্বই এর দশকের শেষের দিকে দেশের ফুটবলকে ঢেলে সাজান তারা। এই শতাব্দীর শুরু থেকে আলো দেখতে শুরু করে সেসব প্রকল্প। আর তার ষোল বছরের মাঝেই হাতে নাতে তার ফল পাচ্ছে এখন আইসল্যান্ড। আমাদের দেশের ফুটবলের উন্নয়নে যে জাদুর কাঠির স্বপ্ন দেখি আমরা সেটিই সত্যি করে দেখিয়েছে আইসল্যান্ড।
মাত্র ছয় মাস খেলার সুযোগ থাকায় ফুটবল শুধুই একটি ‘শখের খেলা’য় পরিণত হয়েছিল আইসল্যান্ডারদের কাছে। সারা বছর খেলার সুযোগ না থাকলে এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক! আইসল্যান্ডের ফুটবল ফেডারেশন কেএসআই এর জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল আসলে এটাই।
সেই সমস্যা নিরসনে কেএসআই প্রথম ২০০০ সালে তৈরি করে ইনডোর পিচ। সারা দেশে প্রথম দফায় ১৫টি ইনডোর পিচ তৈরি করে ফুটবলকে শখের খেলা থেকে পেশায় রুপান্তর করার চেষ্টা! সাফল্যের মুখ দেখায় পরে আরও ২০ টি আর্টিফিশিয়াল টার্ফ আর ১০০ টি ছোট পিচের ব্যবস্থা করে কেএসআই। ততোদিনে গুডিয়েনসেনদের দেখে বড় হওয়া আইসল্যান্ড তরুন প্রজন্ম ফুটবলকেই ক্যারিয়ার হিসেবে নেবার স্বপ্নে বিভোর!
*
খেলাটাকে ছড়িয়ে দেবার পর এবার কোচ নিয়োগের পালা! কম খরচে উয়েফা 'এ' আর 'বি' লাইসেন্স দেবার ঘোষণা দিল দেশটি। দলে দলে কোচরাও হাজির আইসল্যান্ডে। তাদেরকে লাইসেন্স দিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হল পুরো দেশে। ফলাফল? আইসল্যান্ডের প্রতি ৫০০ মানুষের জন্য রয়েছেন অন্তত একজন করে উয়েফা ‘এ’ লাইসেন্স ধারী কোচ! ইংল্যান্ডে সংখ্যাটা প্রতি দশ হাজারে একজন।
বয়সভিত্তিক দল তৈরির কাঠামো দাঁড় করিয়ে ঘরোয়া লিগের দিকে মনোযোগ দিল আইসল্যান্ড। প্রায় প্রতিটি ক্লাবকেই বেঁধে দেয়া হল নির্দিষ্ট নিয়ম। সেই নিয়মের সুফলই আসলে এখন ভোগ করছে দেশটির ফুটবল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্রেইডাবলিক। একসময় রেলিগেশনে যুদ্ধ করা আইসল্যান্ডের ক্লাবটি এখন দেশের গর্ব। কেএসআই এর বাধা নিয়মের আদলে ফুটবল কাঠামো বানিয়ে তারা তৈরি করেছে সিগার্ডসন, আলফ্রেড ফিনবোগাসনদের মতো খেলোয়াড়। যারা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ আর লা লিগা। আর বয়সভিত্তিক দলে থাকা তরুন সব আইসল্যান্ডের খেলোয়াড়রাও তাদের দেখান পথ অনুসরণ করেই পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপের বড় লিগগুলোয়।
কেএসআই এর নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর সুফল অবশ্য আরও আগেও ভোগ করতে পারত আইসল্যান্ড। অথবা অল্পের জন্য ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়াটা দমিয়ে দিতে পারত আইসল্যান্ডের ফুটবলকে। দমে না গিয়ে বরং ওই দুঃখটা জমিয়ে রেখেই ইউরোর বাছাইপর্বে অমন চমক দেখাল তারা। আসলে আরও প্রায় পঁচিশ বছর আগে কেএসআই এর নেয়া সিদ্ধান্তগুলোই ছিল 'চমক', তার ফলটাই শুধু পাচ্ছে এখন আইসল্যান্ড।
আইসল্যান্ডের সরকারের সাথে অবশ্য এই সাফল্যের সমান ভাগীদার দলের দুই কোচও! ভুল নয়, ঠিকই পড়েছেন। এই দলটার হেড কোচ দু জন। ২০১১ সালে প্রথমে দায়িত্ব দেয়া হয় সুইডিশ কোচ লার্স ল্যাগারব্যাককে। এর দশদিন পর ওই একই পদেই নিয়োগ পান হেইমির হালগ্রিমসন। যিনি পেশায় একজন ডেন্টিস্টও বটে! জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েও মায়ের ইচ্ছেয় উত্তরের এক দ্বীপে নিজের চেম্বারে এখনও রোগী দেখেন হালগ্রিমসন।
*
২০১০ সালে নাইজেরিয়াকে বিশ্বকাপে নেয়া কোচ ল্যাগারব্যাক আইসল্যান্ডে এসেই ‘বিশ্বমানের’ সুযোগ সুবিধার লিস্ট ধরিয়ে দেন বোর্ডকে। তাতে দলের জন্য একজন শেফ থেকে শুরু করে দলের জন্য ভাড়া করা বিমান- সবই ছিল। দলের ভেতর হার না মানা মনোভাবটাও এই লোকেরই তৈরি করা। ছোট দেশের মানুষের একটা দল হয়ে খেলা যে আরও সহজ এই দীক্ষাও ল্যাগারসনেরই দেয়া।
যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন আইসল্যান্ডের ফিফা র্যাংকিং ছিল ১৩১। ওই সময়ে আমাদের বাংলাদেশের র্যাংকিংটাও ছিল ১৫০ এর আশেপাশে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তারা এখন ৩৪ নম্বরে।
এই ইউরো শেষে হালগ্রিমসনের কাছে দায়িত্ব দিয়ে সুইডেন ফিরে যাবেন ল্যাগারব্যাক। দলটাকে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন তিনিই, এবার শুধু সামনে এগিয়ে নেবার পালা। একজন আইসল্যান্ডারই তো সবচেয়ে ভালো যত্ন নিতে পারবেন নিজের দেশের! এবার বোধ হয় পাকাপাকিভাবেই পার্ট টাইম ডেন্টিস্টের চাকরিটার পাট চুকিয়ে ফেলবেন হালগ্রিমসন!
*
আইসল্যান্ডের ফুটবলের উত্থানটা আসলে হলিউডের পান্ডুলিপিকেও হার মানায়। আইসল্যান্ডের ইউরো অভিযান নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে হলেও অবশ্য অন্যের দ্বারস্থ হতে হবে না সিগার্ডসন, আর্নাসনদের। দলের গোলরক্ষক হালডারসন ফুটবলের পাশাপাশি একজন ভিডিওগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেন অবসরে!
আইসল্যান্ড ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা এডার গুডিয়েনসেন মাত্র ক’দিন আগেই অবসর ভেঙে ফিরে এসেছেন জাতীয় দলে। ৩৭ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার আইসল্যান্ডের উত্থানের সবচেয়ে বড় সাক্ষী, দলের অভিভাবক। আর্নাসন একবার বলেছিলেন, ড্রেসিংরুমে গুডিয়েনসেনদের কাছে শোনা মেসির গল্প তাদের মনে শিহরণ জাগায়। রোনালদোকে আটকে দিয়েছেন তারা ক’দিন আগেই। পরের বিশ্বকাপে মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষ দল হিসেবে এই আইসল্যান্ডকে দেখলেও তাই অবাক হবার কিছুই থাকবে না!
'আইস ও ফায়ারে' গড়া যে ফুটবল সে অগ্নুৎপাত ও ঘটাবে, আর শুভ্র বরফের মতো শান্তিও বয়ে আনবে...