• " />

     

    অল্প গল্পে অলিম্পিক-৬: যে রেকর্ড ভাঙ্গেনি ৪৮ বছরেও

    অল্প গল্পে অলিম্পিক-৬: যে রেকর্ড ভাঙ্গেনি ৪৮ বছরেও    


    'চেক লোকোমোটিভ'

    শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে আপনি কি কি করতে পারবেন? নেপাল দেখতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনি সিদ্ধান্ত নিবেন না এভারেস্ট জয় করার কিংবা ইংলিশ চ্যানেলে ঘুরতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনি সিদ্ধান্ত নিবেন না সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার হবার! এমিল জেটোপেককেও যদি আপনি আপনার কাতারে রাখেন তাহলে ভুল করবেন, শুধু আমি-আপনি আমজনতা কেন, সাধারণ অ্যাথলেটদের কাতারেও আপনি এমিলকে রাখতে পারবেন না। তাঁর গল্পটা অনেকটা এরকম- ‘দৌড়াতে ইচ্ছা করছে, তাই দৌড়ালাম, দৌড় শেষে দেখছি পদক জিতে গেলাম!’

    এমিলের জন্ম আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে, তৎকালীন চেকোশ্লোভাকিয়াতে। দূরপাল্লার দৌড়বিদ তিনি, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা। তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অনুশীলনের ব্যতিক্রমী ধরণ- শ্বাস আটকে রেখে অথবা ধীরে ধীরে শ্বাস টেনে তিনি অনুশীলনের প্রথম ল্যাপে দৌড়াতেন। পরবর্তী ল্যাপেই আবার দৌড়াতেন জোরে জোরে শ্বাস টেনে। ৫০০০ মিটার অথবা ১০০০০ মিটার যে দৌড়েরই অনুশীলন করতেন না কেন- সবসময়ই এই ধারাক্রম মেনে চলতেন। খেলাধুলার জগতে এই পদ্ধতিটা এখন বেশ জনপ্রিয়, যোগব্যায়াম তো পুরোটাই এই পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে করা হয়। ‘হাইপোভেন্টিলেশন ট্রেনিং’ এর প্রথমদিককার পুরোধা হিসেবে তাই এমিলকে বেশ সম্মান প্রদান করা হয়।

    তবে এমিলের আসল কারিশমা সেখানে নয়। আপনি ক্রিকেট খেলতে পারেন ঠিক আছে, ফিটনেসও ওয়ানডে খেলার জন্য বেশ চমৎকার। কিন্তু সেই ফিটনেস দিয়ে কি আপনি টেস্ট খেলতে পারবেন? হয়তো পারবেন কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সামর্থ্যের পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ আপনি সেখানে দেখাতে পারবেন না। এমিল জেটোপেকের ব্যাপারটি এজন্যেই অনবদ্য। ১৯৫২ হেলসিংকি অলিম্পিকে গিয়েছিলেন ৫০০০ আর ১০০০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেয়ার জন্যে। দুটো ইভেন্টেই জিতলেন সোনা, কিন্তু এতে তাঁর মন ভরল না। ম্যারাথন ইভেন্টের আগের দিন সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যারাথনেও দৌড়াবেন এবং সব হিসাব নিকাশ উলট-পালট করে দিয়ে সোনা জিতলেন! ব্যাপারটি যে কতটা কঠিন তা আরেকটি উদাহরণ থেকেই বুঝা যায়- একই অলিম্পিকে ৫০০০, ১০০০০ এবং ম্যারাথন তিনটি ইভেন্টেই সোনা জেতার নজির আর একটিও নেই!
     


    শুধু বিশেষ ধরণের অনুশীলন পদ্ধতিই নয়, এমিলের দৌড়ানোরও একটি বিশেষ ভঙ্গিমা ছিল। দৌড়ানোর সময় মাথা আর টরসো (টরসো হচ্ছে মাথা এবং পা বাদে শরীরের বাকি অংশ) ছন্দময়ভাবে দুই পাশে দুলাতে থাকতেন, মুখ দিয়ে অদ্ভুত রকমের কিছু শব্দ বের করতেন। এই অদ্ভুত শব্দ আর অল্প সময়ে লম্বা দূরত্ব অতিক্রম করার অমানবিক ক্ষমতার জন্যে তাঁর নামই হয়ে যায় ‘চেক লোকোমোটিভ’। শুধু হেলসিংকি অলিম্পিকেই তাঁর কৃতিত্ব সীমাবদ্ধ নয়- তিনি ১০০০০ মিটার বিশ্বরেকর্ড দুবার ভেঙ্গেছেন, ২৯ মিনিটের মধ্যে ১০০০০ মিটার দৌড়ানো প্রথম মানবসন্তানও তিনি। এক ঘন্টার মধ্যে ২০ কিলোমিটার দৌড়ানোর প্রথম কৃতিত্বও তাঁর। তাঁর সময়ের দূরপাল্লার দৌড়ে এমন কোন রেকর্ড নেই যে তিনি ভাঙ্গেননি। কেউ তাঁর রেকর্ড ভেঙ্গে দিলে তিনি আবারও সেটি পুনরুদ্ধার করে ছেড়েছেন। ২০১৩ সালে ‘রানার্স ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন’ এজন্যেই তাঁকে সর্বকালের সেরা দৌড়বিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।


    আরো পড়ুনঃ
    অল্প গল্পে অলিম্পিক-২ঃ সিনেমা যেখানে হার মানে

    অল্প গল্পে অলিম্পিক-৫ঃ দ্বৈরথ, বিতর্ক আর আকাশ ছোঁয়ার গল্প


    'দ্য ফ্লাইং বব'

    আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় ‘বর্ণবাদ’ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন রবার্ট বব বিমন। এই 'দোষ' এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে একেবারে বহিষ্কারই করে দিল! সময়টা ১৯৬৮ সাল, আমেরিকানরা কিন্তু তখন চাঁদে মানুষ পাঠানোর হিসাব কেতাব প্রায় মিলিয়ে এনেছে! খুবই ‘পরস্পরবিরোধী’ লাগছে তাই না?

    কৃষ্ণাঙ্গ রবার্টের জন্ম নিউ ইয়র্কে, কিন্তু পড়তে গিয়েছিলেন টেক্সাসের এল পাসো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই বহিষ্কৃত হয়ে পড়লেন মহা বিপদে। ডিগ্রি নেই কোনো, ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে ক্যারিয়ার করতে চান তিনি আবার; কিন্তু নিজের খরচে কোচ রাখার সামর্থ্যও তাঁর নেই। এর উপর সেটাই ছিল অলিম্পিকের বছর, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় টুর্নামেন্টটা ছিল ওটার জন্যেই প্রস্তুতিমূলক একটি টুর্নামেন্ট। এই মহাবিপদে এগিয়ে এলেন রালফ বোস্টন, তিনিও ছিলেন অলিম্পিয়ান- সমসাময়িক লংজাম্পারদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা। ববের অলিম্পিয়ান হবার স্বপ্ন পূরণ করতে রালফ নিজের প্রস্তুতির সাথে সাথে ববকেও কোচিং করাতে লাগলেন। জাতীয় বাছাইপর্ব পেরিয়ে দুজনই পেলেন নিউ মেক্সিকো অলিম্পিকের টিকেট।

    বব ভাল জাম্পার ছিলেন ঠিক আছে, কিন্তু পদক জিতবেন এটা তিনি নিজেও বোধহয় বিশ্বাস করতেন না। হিটে মোটামুটি ভালমতই উতরে গেলেন। কোয়ার্টার ফাইনালও পার হলেন অনায়াসে, কিন্তু জট পাকালেন সেমিতে। পরপর দু'বার লাফ দিলেন, দু'বারই হলেন ডিসকোয়ালিফাইড। তৃতীয়বার ডিসকোয়ালিফাইড হলে অলিম্পিক থেকেই বাড়ি ফিরে যেতে হবে এমন একটা পরিস্থিতি দাঁড়ালো। বব ফাইনালে যাবার জন্যে নিজের রানিং মার্কই পরিবর্তন করে ফেললেন, লাফ দিলেন দাগের অনেক পিছন থেকে। এবার ‘ফেয়ার’ লাফ হল, তবে সিরিয়ালে সবার শেষে থেকে উঠলেন ফাইনালে!

    ফাইনালের প্রতিপক্ষ ১৯৬৪ অলিম্পিকের সোনাজয়ী ব্রিটেনের লিন ডেভিস, আগের দুই আসরের ব্রোঞ্জজয়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের ইগর টের-ওভানেসেয়ান। আরেকজন জাম্পার ছিলেন, যিনি সোনা জিতেছেন ১৯৬০ অলিম্পিকে; তাঁর সাহায্যেই বব বিমন মেক্সিকো সিটি অলিম্পিকের টিকেট পেয়েছেন, তাঁর কোচিংয়ে থেকেই উঠে এসেছেন ফাইনালে- তিনি রালফ বোস্টন! সে এক অদ্ভুত অবস্থা, কোচ-ছাত্র এবার মুখোমুখি হলেন অলিম্পিকের ফাইনালে। নিঃসন্দেহে ঐ বছর ফেভারিট ছিলেন বোস্টন। হয় বোস্টন কিংবা ব্রিটিশ ডেভিস সোনা জিতবেন এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন সবাই। অস্বাভাবিকও নয় এটা ধরা, ববের ব্যক্তিগত সেরা স্কোরই যে ছিল এই দুইজনের নিয়মিত স্কোরের সমান! তারপর যেমনটা বলা হয়, ইতিহাস! হিটে সবার পিছনে থাকা সেই ববই সোনা জিতলেন, দিলেন ইতিহাসের দীর্ঘতম লাফ। এতটাই দূরত্ব তিনি লাফিয়েছিলেন, ট্র্যাকে রাখা ‘মেজারিং ইকুইপমেন্ট’ দিয়েও সেটা মাপা সম্ভব হয়নি! আনতে হয়েছিল বাইরে থেকে গজ-ফিতা! ৮.৯০ মিটার অতিক্রম করা ববের সেই লাফটা বিশ্বরেকর্ড হয়ে টিকেছিল দীর্ঘ ২২ বছর! অলিম্পিকে যে রেকর্ড ভাঙেনি এখনও। 
     


    ববের ক্যারিয়ারের সারাংশ করলে ঐ লাফ আর ঐ বিশ্বরেকর্ডের কথাই আসবে কেবল। গোটা ক্যারিয়ারে তাঁর পদকই মাত্র দুটি, অলিম্পিকের ঐ সোনাটি বাদ দিলে প্যান অ্যামেরিকান গেমসের আরেকটি রৌপ্য পদকই কেবল অবশিষ্ট থাকে! অলিম্পিকের ঐ লাফের পর তিনি ৮.২২ মিটারের বেশিই আর কখনো লাফাতে পারেননি! ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকেও আর যাওয়া হয়ে উঠেনি বিমনের।

    অলিম্পিক আসলে এমনই, একদম অখ্যাত কাউকে অতিমানবীয় কিছু করার সুযোগ করে দেয়। আবার একদম শীর্ষ থেকে কাউকে ফেলে দেয় ব্যর্থতার অতল গহ্বরে।

     

    খ্যাপাটে সাঁতারু

    শূন্য থেকে নায়ক হবার উদাহরণ এই মর্ত্যে অজস্র। ১৭ বারের চেষ্টায় রবার্ট ব্রুস যুদ্ধ জিতেছিলেন; সমরখন্দ তিনবার হারিয়ে, ফারগানা থেকে বিতাড়িত হয়ে, বনে-পাহাড়ে-মরুতে দিনের দিনের পর দিন কষ্ট করে সৈন্য সংগ্রহ করে বাবর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি। এতো গেল যুদ্ধ-সাম্রাজ্যের হিসাব নিকাশ। ক্রিকেটে টানা ডাক মেরে সেঞ্চুরি করার নজিরই তো আছে অজস্র, মারভান আতাপাত্তু তো জীবনের প্রথম কয়েকটি আন্তর্জাতিক ইনিংসে রানের খাতাই খুলতে পারেননি। বীরেরা যুদ্ধে হারলেও মনোবল হারান না, আর প্রকৃত অ্যাথলেটরা গো হারা হারলেও সেখান থেকে ফিরে আসেন।

    মার্ক স্পিৎজ আমেরিকান সাঁতারু, ১৯৬৮ অলিম্পিকে যে কয়টি ইভেন্টে এককভাবে অংশ নিয়েছেন তার সবকয়টি হেরেছেন। বেশ ক'টি ইভেন্টের ফাইনালে অব্দি যেতে পারেন নি। ৪×১০০ মিটার রিলেতে শুধুমাত্র তাঁর ব্যর্থতার জন্যে পুরো আমেরিকান টিমকে পদক হারাতে হয়েছে। সমসাময়িক সাঁতারুদের মধ্যে অন্যতম সেরা, কোচের চোখে তৎকালীন বিশ্বের সেরা সাঁতার প্রতিভার এমন হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর স্বাভাবিকভাবেই নিদারুণ কটুক্তির শিকার হয়েছেন স্পিৎজ। ইহুদি বলে অনেক সতীর্থ তাঁকে ইসরায়েলেও পাঠিয়ে দিতে চেয়েছেন!

    সেই মার্ক স্পিৎজই পরে ফিরে এসেছেন। এমন প্রবলভাবেই ফিরে এসেছেন যে সেটার পুনরাবৃত্তি করা এক কথায় প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে সাতটি সোনা জিতেছেন। মাইকেল ফেলপস অবশ্য পরে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, মার্ককে সরিয়ে এক অলিম্পিকে আটটি সোনা জিতার একমাত্র নজিরও গড়েছেন; কিন্তু একদিক থেকে মার্ককে তিনি অতিক্রম করতে পারেননি ফেলপসও। মার্ক প্রত্যেকটা ইভেন্টেই সোনা জিতেছিলেন বিশ্বরেকর্ড গড়ে! একটু ঝুঁকি নিয়ে বলাই যায় যে, সাতটি ইভেন্টের সবকয়টিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে সোনা জয়ের এই বিরল রেকর্ড কখনোই ভাঙ্গবে না।
     


    মার্ক ছিলেন খ্যাপাটে, ১৯৬৮ সালের অপমানের শোধ তুলেছেন ১৯৭২-এ এসে। শোধ তোলা শেষ, এজন্যে বিদায়ই বলে দিলেন পুল থেকে! অথচ তাঁর বয়স তখন মাত্র ২২! এরপর টুকিটাকি সাঁতরেছেন, তবে সেটা উল্লেখ করার মত নয়। এরপর টিভি শো তে নাম লিখিয়েছেন, দুধ-চকলেট থেকে শুরু করে স্যুইমস্যুট-আন্ডার গার্মেন্টস এর মডেল পর্যন্ত হয়েছেন। সত্তরের দশকে মডেল হিসেবে তিনি যে পরিমাণ অর্থ কামিয়েছিলেন, অনেক প্রতিষ্ঠিত মডেলও সেটা কামাতে পারেননি।
     


    কী মনে করে দুই দশক পরে, বয়স যখন ৪০ এর কোঠায়, আবার সিদ্ধান্ত নিলেন সাঁতরানোর! বার্সেলোনা অলিম্পিকে যাবার জন্যে প্রস্তুতিও শুরু করলেন। কিন্তু বয়স তো আর তাঁর জন্যে থেমে থাকে নি, জাতীয় ট্রায়ালে যাবার যোগ্যতাও এজন্যে তিনি অর্জন করতে পারেননি। প্রাথমিক হিটেই হেরেছিলেন বিশাল বিশাল সব ব্যবধানে।

    মার্ক স্পিৎজকে তবুও আমেরিকানরা মনে রেখেছে। মনে রেখেছে তাঁর বিশালাকায় গোঁফের জন্যে, পুলে ঝড় তোলার অমানবীয় ক্ষমতার জন্যে আর টিভি পর্দায় তাঁর সপ্রতিভ এবং চাঁছাছোলা মন্তব্যের জন্যে। শুধু আমেরিকানদের কাছেই নয়, যতদিন অলিম্পিক থাকবে, যতদিন সাঁতার থাকবে- মার্ক স্পিৎজ ততদিনই অবিনশ্বর হয়ে থাকবেন! 


    পরবর্তী পর্বঃ 
    অল্প গল্পে অলিম্পিক-৭: অলিম্পিকের চোকার এবং একটি 'ফ্লপ'