অভিনব প্রতিবাদ
খেলাধুলায় রাজনীতি টানার যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু যুগে যুগে রাজনৈতিক প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে খেলার মাঠের ব্যবহারটা নতুন নয়। একাত্তরে ঢাকায় আন্তর্জাতিক একাদশের বিপক্ষে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একাদশের হয়ে ব্যাটে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সম্বলিত স্টিকার লাগিয়ে মাঠে নেমেছিলেন দলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি রকিবুল হাসান।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে রাজনৈতিক প্রচারণার সর্বশেষ নজিরটি সম্ভবত আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের। গেল ফুটবল বিশ্বকাপের প্রাক্কালে বুয়েন্স এইরেসে স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচের আগে ব্রিটিশ উপনিবেশ ফকল্যান্ডকে নিজেদের দাবী করে ‘মালভিনাস (ফকল্যান্ড দ্বীপের স্থানীয় নাম) আর্জেন্টিনার’ লেখা ব্যানার প্রদর্শন করেন আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সদস্যরা। এ নিয়ে পরবর্তীতে দেশটির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে জরিমানাও করে ফিফা।
ক্রিকেট বিশ্বকাপের কাউন্টডাউনে এহেন ‘রাজনৈতিক’ আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের যে ম্যাচটির স্মৃতিচারণে এই লেখার অবতারণা সেটির ঐতিহাসিক গুরুত্বে ছোট্ট একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ জড়িয়ে আছে।
১৯৭৫ সালের ১১ জুন। লন্ডনের কেনিংটন ওভালে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপে গ্রুপ-বি’র ৭ম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মোকাবেলা করবে শ্রীলংকা। টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন লঙ্কান অধিনায়ক আনুরা টেন্নেকুন। যথারীতি উইকেটের দু’ প্রান্তে অবস্থান নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান দু’ ওপেনার। শ্রীলংকার খেলোয়াড়রাও মাঠজুড়ে ‘পজিশন’ নিচ্ছেন। প্রথম ওভারের প্রথম বলটি করার জন্য দৌড় শুরু করবেন টনি ওপাথা। ঠিক তখনই ঘটলো ঘটনাটা।
আচমকা মাঠে ঢুকে পড়লেন ক’জন দর্শক। প্রত্যেকের হাতে কাগজের প্ল্যাকার্ড। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিচের উপর গিয়ে শুয়ে পড়লেন তাঁরা। ধাক্কাটা কাটাতে মাঠে উপস্থিত সবারই কিছুক্ষণ সময় লাগলো। ওটুকু সময়ই বোধহয় চেয়েছিলেন ঘটনার ‘নায়ক’রা। শ্রীলংকায় তামিলদের উপর চলমান নির্যাতনের এই অভিনব প্রতিবাদ ক্যামেরাবন্দী হয়ে ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়াজুড়ে।
ঘটনা এর বেশী এগোয় নি। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা তড়িৎ সরিয়ে নিলেন ‘প্রতিবাদকারী’দের। ম্যাচটির স্মৃতিচারণে ওই দিন মাঠে উপস্থিত শ্রীলংকা দলের সদস্য (বর্তমানে ক্রিকেট ভাষ্যকার) রঞ্জিত ফার্নান্ডো ইতিবাচক কিছুই খুঁজতে চাইছিলেন, “আমাদের কাছে খেলাটা সবসময়ই সাম্যের প্রতীক, এখানে রাজনীতির কোন স্থান নেই। ঘটনাটা ক্ষণিকের জন্য আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল বটে, কিন্তু কোন আতংক সৃষ্টি করতে পারে নি। বরং এরপর বড় ম্যাচের স্নায়ুচাপটা আর টের পাই নি। অতো দর্শকের সামনে ভালো কিছু করতে যেটা খুব দরকার ছিল।”
সে বিশ্বকাপ দিয়ে একদিনের আন্তর্জাতিকে অভিষেক হওয়া শ্রীলংকা ৬০ ওভারের ম্যাচটা হেরেছিল ৫২ রানে। নবীন দল হিসেবে সমসাময়িক পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩২৮ রানের জবাবে ২৭৬ করাটাকে ‘ভালো কিছু’ না মেনে উপায় কি?