অল্প গল্পে অলিম্পিক - ৮ঃ 'ইটি'র উৎসাহ আর বিশ্বসেরার দাম্ভিকতা
আরো পড়ুনঃ
অল্প গল্পে অলিম্পিক - ৭ঃ অলিম্পিকের চোকার এবং একটি 'ফ্লপ'
অল্প গল্পে অলিম্পিক - ৫ঃ দ্বৈরথ, বিতর্ক আর আকাশ ছোঁয়ার গল্প
'স্যার' ক্রিস্টোফার হয়
পিছনে গাড়িতে করে ধাওয়া করছে খ্যাপাটে বিজ্ঞানীদের দল। ক্যালিফোর্নিয়ার জঙ্গলের উঁচুনিচু রাস্তা, এর মধ্যেই ছুটে চলছে একদল দুরন্ত কিশোর। সাথে আছে ভিনগ্রহ থেকে আগত এক প্রাণী, যেভাবেই হোক তাকে পৌঁছে দিতে হবে উদ্ধারকারী স্পেসশিপের কাছে। বন্ধুত্ব, ভালবাসা আর রহস্যের মিশেলে স্টিভেন স্পিলবার্গ তাঁর বিখ্যাত 'ইটি' চলচ্চিত্রটি শেষ করেছিলেন এরকমই একটি দৃশ্য দিয়ে। ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি এই তিন দশক পরেও বিনোদনের খোরাক হয়ে আছে, বন্ধুত্বের মর্যাদার স্মারক হয়ে আছে। তবে 'ইটি' যে একই সাথে কাউকে কাউকে অলিম্পিকে সোনাও পাইয়ে দিচ্ছে এটা কি খোদ স্পিলবার্গ জানেন?
ক্রিস্টোফার হয় তখন একেবারেই ছোট, মাত্র আট বছর বয়স। ইটি-র প্রধান চরিত্র এলিয়টের বয়সের প্রায় সমান। ঐ বয়সে এলিয়ট সাইকেল চালিয়ে ভিনগ্রহবাসীদের সাহায্য করছে আর সে মারেফিল্ডে শহরের মধ্যে বসে থেকে কিছুই করতে পারছে না, এই ভাবনা থেকেই ছোট ক্রিস বাবার কাছে আবদার করে একটি সাইকেলের। বাবা মানা করেন নি, তিনি একটি পুরাতন বিএমএক্স সাইকেল কিনে এনে সেটাকে নিজে মেরামত করেন এবং রঙ করে ইটি-তে এলিয়টের ব্যবহার করা সাইকেলের মতো সাজিয়ে দেন। ক্রিসের সাইক্লিস্ট হবার সূত্রপাত ঘটে সেখান থেকেই।
ক্রিসের যেখানে জন্ম সেখানে আছে স্কটল্যান্ডের জাতীয় রাগবি স্টেডিয়াম। শহরটা শুধু রাগবির জন্য নয়; বরং আইস হকি, ফুটবল, টেনিস খেলোয়াড়দের আঁতুড়ঘর হিসেবেও প্রসিদ্ধ। সেখান থেকেই কিনা ক্রিস হয়ে গেল সাইক্লিস্ট এবং স্কটিশদের মধ্যে সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান! ক্রিসের জয়যাত্রার সূচনা এথেন্স ২০০৪ অলিম্পিক থেকে, এক কিলোমিটার টাইম ট্রায়ালে ব্রিটেনের সোনা আসে ক্রিসের হাত ধরে। যদিও এটা তাঁর প্রথম অলিম্পিক পদক নয়; ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে দলগত ইভেন্টেও জিতেছিলেন রূপা। তবে ঐ সোনাজয়ের পরই ক্রিসের ক্যারিয়ারের আকাশযাত্রা শুরু হল। ২০০৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত টানা ৫টি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে জিতলেন মোট সাতটি সোনা। এর বাইরে স্কটল্যান্ডের হয়ে ২০০৬ মেলবোর্ন কমনওয়েলথ গেমসেও সোনা জিতেছেন। তবে এসব কিছু নয়, তাঁকে আসলে মহানায়ক বানিয়েছে ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিক!
বেইজিংয়ের উসাইন বোল্ট কিংবা মাইকেল ফেলপসের কীর্তি নিয়ে যত উপাখ্যান লেখা হয়েছে, ক্রিসের কীর্তি নিয়ে সে তুলনায় কিছুই হয়নি বলে তিনি মন খারাপ করতেই পারেন। বেইজিংয়ের সেই আসরে তিনি জিতেছিলেন তিনটি সোনা; ১৯০৮ সালের পর কোনো ব্রিটিশ অ্যাথলেটের এক আসরে সর্বাধিক সোনা জয়ের রেকর্ড এটি। আর কোটাটা শুধু স্কটল্যান্ডে নিয়ে আসলে এমন রেকর্ড কারোরই নেই। মহানায়ক থেকে ক্রিস অমর হয়েছেন এরপরের লন্ডন অলিম্পিকে। আরো দুটি সোনা জিতেছেন সেখানে, সাথে একটি রূপাও। অলিম্পিকে ছয়টি সোনা এবং দুটি রূপা জিতে সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান সাইক্লিস্ট হিসেবে সেখানেই তাঁর নাম পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন।
ক্রিস দুনিয়াজোড়া অত খ্যাতি পাননি বলে তাঁর অবশ্য আফসোস থাকার কথা নয়। নিজভূমে অনুষ্ঠিত হওয়া লন্ডন অলিম্পিকের ‘দূত’ ছিলেন তিনি। পেয়েছেন নাইটহুড উপাধি, আর নিজ দেশ স্কটল্যান্ডে তো তিনি জাতীয় বীর। ২০১৩ সালে খেলা ছেড়েছেন, এখন মজেছেন সাইকেল ছেড়ে গাড়ির নেশায়। ফর্মুলা ওয়ানের ট্র্যাক দাবিয়ে বেড়ান নিশান জিটি একাডেমি দলের হয়ে। পায়ে সাইকেলের প্যাডেল নিয়েই যেই কীর্তি গড়েছেন, কে জানে হয়তো কয়েক বছর পর নিশানের হুইল হাতে ক্রিসের অর্জন নিয়ে নতুন কোনো প্রতিবেদনই আবার লিখতে হবে!
'মহাশূন্যপ্রপাত'
যদি পরিসংখ্যান অথবা পদক জয়ের হিসেব করেন, অথবা যদি ইউটিউবে তাঁর দৌড়ের ভিডিও দেখেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই কার্ল লুইসকে আপনি সর্বকালের অন্যতম সেরা ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের অ্যাথলেট হিসেবে অধিষ্ঠিত করবেন! ১৯৩৬ সালে জেসি ওয়েন্স হিটলারের সামনে যেই কীর্তি গড়েছিলেন সেই একই কীর্তি লুইস গড়ে দেখিয়েছেন ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকে। একজন অ্যাথলেট কর্তৃক ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের চারটি ইভেন্টে সোনা জয়ের কীর্তি এখন পর্যন্ত এই দুটিই, মনে রাখবেন উসাইন বোল্টও কিন্তু এক আসরে তিনটির বেশি সোনা জিততে পারেন নি!
কার্ল লুইস যেন ছিলেন কষ্টিপাথরে খোদাই করা এক আশ্চর্য মানব মূর্তি। অসাধারণ শারীরিক গড়ন এবং ক্যামেরার সামনে সাবলীলতার জন্যে চলচ্চিত্র পাড়াতেও তাঁর বেশ নামডাক ছিল। নিজ দেশে হতে যাওয়া ১৯৮৪ অলিম্পিকের আগে হলিউড থেকে সিনেমায় অভিনয়ের জন্যে ডাক পেয়েছিলেন, পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি ছিল নানা পণ্যের দূতিয়ালি করার জন্যেও। বাস্কেটবলটাও ভাল খেলতেন, এনবিএর যেকোন দলে অনায়াসে সুযোগ পেতে পারতেন; ডাকও পেয়েছিলেন বেশ কয়েকটা দল থেকে। এসবই কিন্তু ১৯৮৪ অলিম্পিকের আগের ঘটনা, তখনো কিন্তু তিনি অলিম্পিকে একটি পদকও জিতেন নি।
কার্ল অবশ্য সবকিছু বাদ দিয়ে অলিম্পিকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল সেটাও ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪০০ মিটার রিলে এবং লং জাম্পে সোনা জিতে বাস্তবায়ন করে দেখালেন। এ ঘটনার পর লুইস 'ক্রেজ' হবার কথা ছিল আকাশচুম্বী, অথচ তিনি কিনা পরিণত হলেন জনসাধারণের চক্ষুশূলে! নিজ দেশের দর্শকরাই তাঁকে প্রত্যেকটি সোনাজয়ের পর করতালির বদলে দুয়োধ্বনি দিয়ে নিন্দা জানাতে লাগল। দোষ অবশ্য দর্শকদের নয়, এর দায়ভার আসলে লুইসের নিজেরই।
অ্যাথলেট হিসেবে কার্ল লুইস দশে দশ পেতে পারেন, কিন্তু মানুষ হিসেবে কত পাবেন কে জানে! অলিম্পিক শুরু হবার পর প্রথম নিন্দিত হলেন গেমস ভিলেজে থাকতে না চেয়ে। যুক্তি দেখালেন তাঁর মত এত সম্মানিত অ্যাথলেটের সবার সাথে শেয়ার করে থাকা মানায় না! স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য আমেরিকান অ্যাথলেটরা এই ঘটনাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। লুইসের এর চাইতেও বড় সমস্যা ছিল প্রতিপক্ষকে প্রাপ্য সম্মানটুকু না দেয়া। মার্কিং লাইনে দাঁড়ানোর সময় অন্যান্য অ্যাথলেটদের তীব্রভাবে কটুক্তি করতেন। আজেবাজে গালি দিতেও ছাড়তেন না। এমনকি আমেরিকান অন্যান্য অ্যাথলেটরাও তাঁর এই বাক্যবাণ থেকে রেহাই পেতেন না। এছাড়াও তাঁকে নিয়ে আরো কিছু কানাঘুষা ছিল, তিনি সমকামী ছিলেন এমন অভিযোগের তীরও গেমস চলাকালীন সময়েই তাঁর দিকে তোলা হয়। যদিও লুইস সেটা দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন।
এত বিতর্কের ফলাফল কার্ল লুইসের ট্র্যাকের বাইরের ক্যারিয়ারে খুবই বাজে প্রভাব ফেলে। জনগণই যেখানে তাঁকে দেখতে পারছে না, পণ্যের দূতিয়ালির কাজ দিয়ে 'ব্র্যান্ড ভ্যালু' কমানোর ঝুঁকি স্বাভাবিক ভাবেই কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নেয়নি। হলিউড থেকে আসতে থাকা চলচ্চিত্রের প্রস্তাবগুলোও ফিরিয়ে নেয়া হয়। নাইকিও তাঁর সাথে সমস্ত চুক্তি বাতিল করে ফেলে। রদ হয়ে যায় এনবিএ তে খেলার যাবতীয় সম্ভাবনাও।
অলিম্পিকে অমন অতিমানবীয় কীর্তি করেও কার্ল লুইস তাই আমেরিকানদের চোখে তিরস্কারের পাত্র। এমন নয় যে লুইসের কীর্তি ঐ অলিম্পিকেই শেষ, তিনি ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকেও ১০০ মিটার স্প্রিন্ট আর লং জাম্পে সোনা জিতেছেন। লং জাম্পের সোনা ধরে রেখেছেন পরের দুটো অলিম্পিক আসরেও। ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিকে ৪০০ মিটার রিলেতেও তাঁর সোনা জয়ের কৃতিত্ব আছে।অলিম্পিকের টানা চার আসরে লং জাম্পে সোনা ধরে রাখার কৃতিত্ব লুইসের একারই আছে, ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে টানা চারটি অলিম্পিকে সোনা জয়ের কৃতিত্বও এখন পর্যন্ত তাঁর! মাঝে ১৯৯১ সালের টোকিও বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ৯.৮৬ সেকেন্ডে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট শেষ করে করেছেন বিশ্বরেকর্ডও!
এতসব কীর্তির পর যেখানে তাঁর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উপার্জনের সু্যোগ ছিল, নিজের জিদ আর বাজে ব্যবহারের জন্যে সেই সুযোগ হারিয়ে কার্ল লুইস আজো যাপন করছেন আটপৌঢ়ে জীবন। তাঁর সমসাময়িক মার্ক স্পিৎজ যেখানে ছিলেন সর্বসাধারণের চোখের মণি, সেখানে লুইস ছিলেন নেহায়েতই অপাংক্তেয়। লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকের ঐ কাণ্ডের পর পদক আর রেকর্ড গড়ে লুইসের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ ছিল। তিনি অবশ্য তা করেছিলেনও।
তবে খেলা ছাড়ার ৬ বছর পর ২০০৩ সালে বোমা ফাটায় ইউএস অলিম্পিক কমিটি। আরো ১০০ আমেরিকান অলিম্পিয়ানের সাথে কার্ল লুইসকেও ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে নিষিদ্ধ ড্রাগ গ্রহণের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। লুইসকে পদক ফেরত দিতে হয়নি নিয়মনীতি পরবর্তীতে পরিবর্তন করায়। লুইসের সময় এফেড্রাইন স্টিমুল্যান্ট ৬ পিপিএমের (প্রতি লিটারে মিলিগ্রাম) উপরে থাকলেই টেস্ট পজিটিভ ধরা হত, লুইসেরও তাই ছিল। পরবর্তীতে এই সীমা ১০ পিপিএম করায় লুইস বেঁচে যান।
এখনকার হিসেবে নির্দোষ হলেও তাঁর আমলের হিসেবে তো তিনি ডোপপাপীই! চরিত্রে লাগা কালির ছোপ তাই লুইস আজও মুছতে পারেন নি। বিশ্বযুদ্ধের পর কার্ল লুইসই বোধহয় একমাত্র অ্যাথলেট যিনি এত পদক জিতেও স্বদেশীদের মনে 'অচ্ছুৎ' হয়ে আছেন!
পরবর্তী পর্ব : অল্প গল্পে অলিম্পিক - ৯: পোলিও রোগীর বিশ্বজয় এবং অন্যান্য