অল্প গল্পে অলিম্পিক - ৯: পোলিও রোগীর বিশ্বজয় এবং অন্যান্য
আরো পড়ুনঃ
অল্প গল্পে অলিম্পিক-৭: অলিম্পিকের চোকার এবং একটি 'ফ্লপ'
অল্পে গল্পে অলিম্পিক-২: সিনেমা যেখানে হার মানে
‘দ্য ব্ল্যাক পার্ল’
বাচ্চাটার জন্মই হয়েছে মাত্র সাড়ে চার পাউন্ড ওজন নিয়ে। জন্ম থেকেই নিউমোনিয়া, হুপিং কাশি। বয়স ৬-৭ মাস হতে না হতেই কালাজ্বরে পড়লো মেয়েটা। যমে-মানুষের সেই টানাটানিতে মেয়েটা জিতলেও হার মানলো পোলিওর কাছে! চার থেকে নয়, এই ক'টা বছর মেয়েটা হাঁটতেই পারল না। জন্ম টেনেসির কালো অধ্যুষিত অঞ্চলে, সাদাদের হাসপাতালেও এই মেয়ের জায়গা নেই। প্রতি সপ্তাহের দুইদিন মেয়েকে কোলে নিয়ে মা যেতেন ৫০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে, বাসে চড়তে পারলেও আসন পেতেন না, কালো বলে বাসের শেষ মাথায় বসতে হত মেঝেতে!
মেয়ের পোলিও সাড়ানোর জন্যে মায়ের এত পরিশ্রম বৃথা যায়নি, নয় বছর বয়সে মেয়েটা হাঁটা শুরু করে। তখন অবশ্য ব্রেস পড়ে হাঁটতে হত। এগার বছরে খুলে ফেলা হয় ব্রেসটাও। এত বছর চুপচাপ বসে থেকে অন্যকে দৌড়াতে দেখেছে বলেই কিনা হাঁটতে শিখার পর মেয়েটার দুরন্তপনা ছিল প্রচণ্ড। সারাদিন মাঠে ঘাটে লাফালাফি, দৌড়াদৌড়ি। স্কুলের বাস্কেটবল দলের অপরিহার্য সদস্য মেয়েটা এক ম্যাচে ৪৯ পয়েন্ট নিয়ে গড়ে ফেলল স্টেট রেকর্ডও। শুধু বাস্কেটবলই নয়, স্কুলের অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ৫০ মিটার, ৭৫ মিটার, ১০০ মিটার আর ৪০০ মিটার রিলেতেও মেয়েটা অপরাজিতা। এসব দেখেই স্টেট কোচ এড টেম্পল মেয়েটাকে নিয়ে গেলেন নিজের কাছে, কয়েকমাস প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিকের দল গঠনের ট্রায়ালে!
মেয়েটার বয়স মাত্র ১৬, ভীত-সন্ত্রস্ত সেই কালো মেয়েটা অলিম্পিক দলে জায়গা নেয়ার জন্য নামল ১৯৫২ হেলসিংকি আসরের চ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে, স্নায়ুচাপ অতিক্রম করে জায়গা করে নিল ৪০০ মিটার রিলের ইউএস প্রমীলা দলে!
মাত্র ৫ বছর আগে যে মেয়ে হাঁটা শিখেছে, জীবনের প্রথম এগারটি বছর যে কাটিয়েছে মায়ের কোলে নয়তো বিছানায়, সেই মেয়েই মাত্র ১৬ বছর বয়সে অংশ নিল অলিম্পিকে। কালো বলে যার জায়গা ছিলনা বাসের আসনে, সে-ই বিমানের বিজনেস ক্লাসে বসে পাড়ি দিল অর্ধেক পৃথিবী। শুধু অংশ নিতেই যে সে অলিম্পিকে আসে নি সেটাও বুঝিয়ে দিল ব্রোঞ্জ জিতে!
উইলমা রুডলফের পোলিও জয় করে অলিম্পিকে এসে ব্রোঞ্জজয়কেই যদি আপনি অতি মানবীয় বলেন, তাহলে পরের অলিম্পিকে তাঁর কৃতিত্বকে আপনি কি বলবেন? ১৯৬০ রোম অলিম্পিকের ১০০ মিটার, ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার রিলেতে জিতলেন স্বর্ণ। পোডিয়ামে উঠার সময় প্রত্যেকবার হাতে রাখলেন বাড়ি থেকে আনা খড় আর চট দিয়ে তৈরি হ্যাট, দর্শকদের অভিবাদন জানালেন এই হ্যাট নেড়েই। নিজের শিকড়কে, স্বজাতিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার প্রয়াসেই উইলমা অমন উদযাপন করেছিলেন।
উইলমাই প্রথম আমেরিকান মহিলা যিনি এক আসরে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে তিনটি সোনা জিতেছেন। তাঁর অমন উন্মত্ত পারফরম্যান্সের পর ইতালীয়রা তাঁর নাম দেয় লা গ্যাজেলা নেরা (দ্য ব্ল্যাক গেজেল), ফ্রেঞ্চরা আবার তাঁকে বলে 'ল্য পার্লে নয়্যর' (দ্য ব্ল্যাক পার্ল)।
রোম অলিম্পিকের পরেই খেলা ছেড়ে দেন এই টেনেসির টর্নেডো। নারীমুক্তি আর কালোদের অধিকার আদায়ের জন্য চষে বেড়ান পুরো আমেরিকা। শুধু অ্যাথলেট হিসেবেই নন, উইলমা রুডলফ আমেরিকানদের হৃদয়ে একজন মহাত্মা হিসেবেও আজীবন বেঁচে থাকবেন।
বুড়ো হাড়ের ভেলকি
‘You’re not good enough,’ কোচ ফ্রাঙ্ক ডিকের এই একটি কথাই মোড় ঘুরিয়ে দিল ক্রিস্টির ক্যারিয়ারের।
তখন ১৯৮৪ সাল, লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকের ৪×১০০ মিটার রিলের দল গঠনের সময় ক্রিস্টিকে বাদ দেয়া হয় অতিরিক্ত পার্টি করার মনোভাব থাকার কারণে! লিনফোর্ড ক্রিস্টির জন্ম ক্যারিবিয়ানে, পার্টির প্রতি একটা আলাদা টান তো তাঁর জন্মগতই। সাত বছর বয়সে বাবা-মার সাথে সে চলে আসে ইংল্যান্ডে। ক্রিস্টি ছিলেন জন্মগত প্রতিভা, তবে আলসেমিটাও ছিল বেশি। ১৯৮৪ এর আগে জাতীয় মিট এবং ইনডোর গেমসে তাঁর পারফরম্যান্স চমৎকার থাকলেও আলসেমির জন্য কোচের সুনজরে পড়তে পারেননি, অলিম্পিক মিসের আসল কারণ ওটাই।
প্রত্যাখ্যাত হবার যন্ত্রণা থেকেই ক্রিস্টি বদলে গেলেন। লক্ষ্য স্থির করলেন ১৯৮৬ কমনওয়েলথ গেমস, অংশ নিলেন না এর মাঝের আর কোনো প্রতিযোগিতাতে। কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেননি, তবে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ৪×১০০ মিটার রিলেতে রূপা জিতে জানিয়ে দিলেন তিনি তখনো ফুরিয়ে যাননি! সাথে পরবর্তী অলিম্পিক দলে জায়গা পাকা করলেন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ১০০ মিটারে সোনা জিতে।
ক্রিস্টি সিউল অলিম্পিকেও রূপা জিতেছিলেন দুইটি ইভেন্টে। তবে ঐ আসরে তিনি নিষিদ্ধ সিউডোএফিড্রিন নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাঁর দাবী ছিল ইচ্ছাকৃতভাবে এই ড্রাগ না নেয়ার, ব্রিটিশ অলিম্পিক কমিটিরও তাই। অলিম্পিক কমিটি শেষে ভোটাভুটি করে সিদ্ধান্ত নেয় যে তাঁর পদক ফিরিয়ে নেয়া হবে না।
নিজেকে পরিশুদ্ধ প্রমাণ করতেই কিনা এর পরের দু’বছর ক্রিস্টি তাঁর সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রয়োগবিন্দু দেখালেন। ১৯৯০ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারের সোনা ধরে রাখলেন, সাথে কমনওয়েলথ গেমসে জিতলেন দুইটি সোনা (১০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার রিলে)। একই বছরে ইউরোপিয়ান ইনডোর গেমসের ৬০ মিটার স্প্রিন্টেও সোনা জিতলেন। ইউরোপের দ্রুততম মানব হিসেবে পা রাখলেন ১৯৯১ টোকিও বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের আসরে।
টোকিওর ঐ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালটা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে কার্ল লুইসের বিশ্বরেকর্ড ভাঙ্গার জন্য। ইতিহাসে ওটাই প্রথম দৌড় যেখানে একই সাথে চারজন স্প্রিন্টার টাইমিং করেছিলেন ১০ সেকেন্ডের নিচে। ক্যারিয়ার সেরা ৯.৯২ সেকেন্ড টাইমিং করেও তাই ক্রিস্টি ঐ আসরে হয়েছিলেন চতুর্থ! ঐ দৌড়ের পর বিবিসির সাংবাদিক ব্রেন্ডন ফস্টার মাঠে বসেই তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে ৯.৯২ সেকেন্ড টাইমিং নিয়ে কথা বলার চাইতে বেশি ছিল ক্রিস্টির অবসর নেয়া নিয়ে কথাবার্তা। ১৯৯২ সালে বার্সেলোনা অলিম্পিকের ১০০ মিটারে সোনা জিতার পর তাই তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন ঐ ফস্টারকেই, তিনি অমন ‘বুড়ো’ বলে তাতিয়ে না দিলে তো আর বার্সেলোনায় সোনা জিতার জন্যে এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতেন না!
ক্রিস্টির অলিম্পিক সোনাটা বিখ্যাত আরেকটা কারণে। ত্রিশের উপর বয়স নিয়ে (৩২ বছর ১২১ দিন) ১০০ মিটার চ্যাম্পিয়ন অলিম্পিয়ান তিনি কেবল একাই, বুড়ো হাড়ে গড়া এই রেকর্ড আদৌ কখনো ভাঙ্গবে কিনা কে জানে?
খালি পায়ের ভবঘুরে...
জোলা বাড এমন এক সময় জন্মেছিলেন যখন দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদ প্রথার জন্য গোটা বিশ্বের যেকোন খেলায় নিষিদ্ধ। তখন ১৯৮৪ সাল, লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক কড়া নাড়ছে দুয়ারে। দক্ষিণ আফ্রিকান জোলার আজীবনের ইচ্ছা অলিম্পিকে খেলার, স্বপ্ন আইডল ম্যারি ডেকারের সাথে একই ট্র্যাকে দৌড়ানো। সেটা সম্ভব নয় জেনেই সতের বছরের তরুণী নিজ দেশের স্টেলেনবশ্চ শহরের ৫০০০ মিটার মিটে অংশ নিলেন। সেখানে হলেন প্রথম আর ভেঙ্গে দিলেন তাঁর আইডল ম্যারি ডেকারের গড়া বিশ্বরেকর্ডটা!
ঐ এক দৌড়েই দুনিয়াজুড়ে হুলুস্থুল পড়ে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকান বলে অলিম্পিকে অংশ নিতে পারবেন না, এজন্যে নয়টি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ক্রীড়াবৃত্তি প্রদানের জন্য উঠে পড়ে লাগল! ইতালি চাইলো নাগরিকত্ব দিতে, হল্যান্ড এবং ব্রিটেনও চাইলো তাই! জোলা বাড প্রথমদিকে এর কিছুই গ্রহণ না করলেও অলিম্পিয়ান হবার আশায় শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন ব্রিটেনের নাগরিকত্ব নিতে। জল ঘোলা হবার সূত্রপাতও সেখান থেকে!
তখনকার সময় ব্রিটেনের নাগরিকত্ব পাবার জন্যে সময় লাগত ১৩-২৪ মাস। কিন্তু ইংলিশ পত্রিকা দ্য মেইল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চাপ প্রয়োগ করে অলিম্পিকের আগে আগেই জোলাকে নাগরিকত্ব পাইয়ে দেয়। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকানরা এ ঘটনাকে ভালভাবে নেয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংল্যান্ডের হাইকমিশনের সামনে আন্দোলন হয়, এমনকি আন্দোলন হয় লন্ডনের রাস্তাতেও!
এতকিছুর পরও জোলার ব্রিটিশ হওয়া আটকানো যায়নি! আইওসি-ও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। ইংল্যান্ডের অলিম্পিক ট্রায়ালে টিকে জোলার জায়গা হয় লস অ্যাঞ্জেলসগামী বিমানে। পূরণ হয় অলিম্পিয়ান হবার স্বপ্নটাও।
জোলা বাড অবশ্য এজন্যে অলিম্পিকের ইতিহাসে স্মরণীয় নন। ৫০০০ মিটার দৌড়ের শেষ ল্যাপ, লিডে আছেন জোলার আইডল আমেরিকান ম্যারি ডেকার। তাঁর ঠিক পিছনেই দৌড়াচ্ছিলেন এই জোলা। জোলা দৌড়াতেন খালি পায়ে, দু’হাত ছড়িয়ে রাখতেন বেশি, কাউকে অতিক্রম করা তাঁর জন্যে একারণে কঠিন হত। ম্যারি ডেকারের পিছন পিছন এক লয় রেখে তিনি তিন ল্যাপ শেষ করেছিলেন কিন্তু অতিক্রম করতে পারছিলেন না। শেষ ল্যাপের শুরুতে বাঁক নেয়ার সময় গতি বাড়াতে চাইলেন এবং তখনি ম্যারির সাথে পা বেঁধে গেল। খালি পায়ে থাকা জোলা সামলাতে পারলেও ম্যারি পারলেন না, তিন ল্যাপে লিডে থাকা ম্যারি ভূপাতিত হলেন ট্র্যাকের উপর।
জোলা অবশ্য দৌড় থামাননি, লিডে তখন তিনি, সোনা জিতাটা মুহূর্তের ব্যাপার। কিন্তু ঘরের মেয়েকে ‘ল্যাং’ মারার অপরাধে পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে তখন বু-উ-উ ধ্বনি। জোলা পরে বলেছিলেন, তখন তিনি পারলে লজ্জায় মাঠের ভিতরে ঢুকে যেতেন। এই লজ্জা মাথায় নিয়ে সোনা জিততে চাননি বলেই তিনি তাঁর গতি কমিয়ে দেন। প্রথম হবার সুযোগ থাকলেও সপ্তম হয়ে দৌড় শেষ করেন!
পোডিয়ামে উঠে লজ্জার মুখোমুখি হতে চাননি বলে তিনি পদক ছুড়ে ফেলে এসেছিলেন ট্র্যাকে, কিন্তু ব্রিটেনে এই ঘটনার জন্যে তাঁকে দাঁড়াতে হল কাঠগড়ায়। মৃত্যু হুমকি পেলেন অজস্র, তাঁকে সেনা তৎপরতায় এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হল।
জোলা বাডের অলিম্পিকে পদক ছুঁড়ে আসার এই দুঃখটা আজীবন পোড়াবে। ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে তিনি অংশই নিতে পারেন নি আইওসি বহিষ্কার করায়। তাঁর অপরাধ ছিল স্বদেশের একটি ‘নিষিদ্ধ’ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি দর্শক হিসেবে গিয়েছিলেন! ১৯৮৯ সালে তিনি ব্রিটেনের মায়া ত্যাগ করে চলে আসেন স্বদেশে। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯২ অলিম্পিকে অংশ নেয়ার সু্যোগ পেলে তিনিও দক্ষিণ আফ্রিকান অলিম্পিক দলে ঠাঁই পান। কিন্তু সেরা সময় পিছনে ফেলে আসা বাড ঐ অলিম্পিকের ফাইনালেই উঠতে পারেন নি।
আজীবন বিতর্ক সঙ্গী করে চলা বাডের পারিবারিক জীবনও বিপর্যস্ত হয়েছে। তাঁর বাবা উইল করে গিয়েছিলেন, মেয়ে যাতে তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে প্রবেশাধিকার না পায়, ব্রিটেন ছেড়ে এসেছিলেন বলে স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়েও যেতে হয়।
কিছু অ্যাথলেট বোধহয় থাকেনই এমন, চ্যাম্পিয়ন হতে গিয়েও নিয়তির বাধায় যাঁদের আজীবন পরাজিতদের দলে পড়ে থাকতে হয়!