• রিও অলিম্পিক ২০১৬
  • " />

     

    উত্তাল সমুদ্র থেকে অলিম্পিকের পুলে

    উত্তাল সমুদ্র থেকে অলিম্পিকের পুলে    

    চারদিকে যতদূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকোটা অতিরিক্ত যাত্রীর ভারেই কিনা, ভূমধ্যসাগরের উত্তাল বুকে বেরসিকের মতো ইঞ্জিন অচল হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে গেছে। ঢেউয়ের তোড়ে নৌকোয় পানিও উঠতে শুরু করলো বলে। খুব দ্রুত ডিঙ্গির ভার না কমালে জনা বিশেক যাত্রীর কারোরই বাঁচার আশা নেই। তিন বছর বয়স থেকে সাঁতার পারা তরুণী ইয়ুসরা মারদিনি ভাবছিলেন, তাই বলে শেষ পর্যন্ত পানিতে ডুবে মরবেন! অতো সাতপাঁচ ভেবে নষ্ট করার মতো সময়ই বা কই? ঝাঁপ দেবার প্রস্তুতি নিতে নিতেই ইয়ুসরা দেখলেন বড় বোন সারাহ ঝাঁপ দিয়ে ফেলেছেন। বোনের নিষেধ উপেক্ষা করেই তাঁর পিছু নিলেন ইয়ুসরা। দু'বোনের দেখাদেখি অশান্ত সমুদ্রে নেমে পড়লেন আরেক তরুণীও। বাকিটা সিনেমাকেও হার মানানোর মতো গল্প। তিন তরুণী মিলে পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টা ভূমধ্যসাগরে সাঁতরে বাকি যাত্রীদেরসহ ওই ডিঙ্গি নিয়ে ভেড়ালেন ডাঙ্গায়।

     

    মধ্যপ্রাচ্য সংকটে দেশ ছেড়ে ইউরোপগামী শরণার্থীদের অনেকেরই হয়তো এমন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। তবে অষ্টাদশী সিরিয়ান তরুণী ইয়ুসরা মারদিনি একটু ভিন্ন কারণে এখন গণমাধ্যমের শিরোনাম। যুদ্ধের ভয়াবহতা কেড়ে নিয়েছে যাদের স্বাভাবিক জীবন, সেই তাঁরাই আবার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে গাইতে পারেন জীবনের জয়গান- রিও অলিম্পিক মঞ্চ থেকে এ বার্তা যারা বিশ্বকে দেবেন, ইয়ুসরা তাঁদেরই একজন।

     

     

    সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে আর দশটা কিশোর-তরুণ বয়সের ছেলেমেয়ের মতো তাঁরও একটা বন্ধু-আড্ডাময় সুখের জীবন ছিল। বাবা-মা আর তিন বোনের পরিবার। বাবার কর্মস্থলের সুবাদে স্থানীয় জিমনেশিয়ামে ইয়ুসরার চলাচল খুব অল্প বয়স থেকেই। সাঁতারটা টানতো খুব! পানিতে একবার নেমে গেলে টেনে তোলা দায়।

     

    দুঃস্বপ্নের শুরুটা ২০১১ সালে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যখন-তখন, যত্রতত্র বোমার শব্দে কাঁপছে শহর। বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ। মরছে সাধারণ মানুষ, সে তালিকায় একটু একটু করে বাড়ছে কাছের মানুষদের সংখ্যাটাও। সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার স্বাভাবিক হবে জীবন- এমন আশায় বুক বাঁধেন ইয়ুসরারা। মাস গড়িয়ে বছর যায়, বছর পেরিয়ে আরেক বছর- পরিস্থিতি কেবল খারাপই হয়। চোখের সামনে ইয়ুসরা দেখেন তাঁর সুইমিং পুলের উড়ে যাওয়া ছাদ। টলমলে পানি বড্ড টানে, কিন্তু নামার উপায় নেই। গৃহবন্দী জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। আর সব সিরিয়ানের মতো তাঁদের সামনেও তখন দুটো পথ- দেশে বসে থেকে মৃত্যুর জন্য দিন গোনা, নয়তো দেশান্তরী হয়ে শরণার্থীর খাতায় নাম লেখানো। তাতেও যে মৃত্যুর শংকা নেই তা নয়, "হয়তো যাত্রাপথেও মরে যেতে পারতাম। কিন্তু দেশে বসে তো প্রতিনিয়ত একটু একটু করে মরছিলাম।"

     

    বাবা-মা আর ছোট বোনটার কাছ থেকে চোখের জলে বিদায় নিয়ে দু' বোন গত বছরের ১২ আগস্ট পা বাড়ান 'নিরাপদ' গন্তব্যের খোঁজে। ভূমধ্যসাগরের বুকে মৃত্যুঞ্জয়ী হবার গল্পটা এরই অংশ। তীর থেকে যখন তাঁরা ত্রিশ মিনিটের মতো দূরে, হাত-পা যেন আর চলছিল না। ডিঙ্গির একটা করে রশি এক হাতে পেঁচিয়ে আরেক হাত আর পা দুটো দিয়ে ওই বরফ শীতল পানিতে কতক্ষণই আর টেকা যায়? "প্রত্যেকের মুখ মৃত্যুভয়ে আক্ষরিক অর্থেই ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। জীবনটা যেন চোখের সামনে ভাসতে দেখছিলাম। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে আমি আবার নৌকায় উঠে যাই। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে যেতে যেতে উত্তাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভয়ে শিউরে উঠছিলাম- কিভাবে এর মধ্যে তিন ঘন্টার উপর কাটিয়ে দিলাম!"

     

    দামেস্ক থেকে বৈরুত, সেখান থেকে সমুদ্রপথে গ্রীস; তারপর মেসেডোনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া; কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বাস কিংবা ট্রেনে এক হাজার মাইলের পথ পেরিয়ে ইয়ুসরারা পৌঁছোন জার্মানিতে। অবধারিতভাবেই সেখানে তাঁদের প্রথম ঠিকানা হয় এক শরনার্থী ক্যাম্পে। তবে বিদেশ-বিভূঁইয়ে, অচেনা-অজানা শহরে ইয়ুসরার প্রথম অনুসন্ধানই ছিল- সবচেয়ে কাছের সুইমিং পুলটা কোথায়!

     

    এক মিশরীয়র মাধ্যমে দু'বোন পেয়েও যান স্থানীয় এক সুইমিং কমপ্লেক্সের খোঁজ। প্রথমবার পানিতে নেমেই তাঁরা, বিশেষ করে ইয়ুসরা নজর কাড়েন কমপ্লেক্সের প্রশিক্ষকদের। সিরিয়ার অলিম্পিক কমিটির খাতায় যার নাম ছিল, তার আর অতোটুকু মুগ্ধতা না ছড়ালেই যে নয়!

     

    চার সপ্তাহ তাঁকে নিয়ে কাজ করেই কোচ ভেন স্পানারকার্ভস ছক কষতে শুরু করেন ২০২০ অলিম্পিকের জন্য। এরই মধ্যে এই বছরের মার্চে এলো এক অপ্রত্যাশিত ঘোষণা- বিশ্বের সব শরণার্থীদের কাছে আশার বার্তা পৌঁছে দিতে এবারের রিও অলিম্পিকেই শরণার্থীদের নিয়ে গড়া একটি দল রাখা হবে।

     

    খবরটা পেয়েই মাথায় নতুন চিন্তা খেলতে শুরু করে স্পানারকার্ভসের। ইয়সুরার নামে আবেদন সেরে গুরু-শিষ্য কোমর বেঁধে নামেন নিবিড় অনুশীলনে। এই মার্চেরই এক সকালে চলে আসে সুখবরটা। ইনবক্সে অলিম্পিক কমিটির মেইল কাঁপা হাতে খোলেন ইয়ুসরা। ক্ষণিকের জন্য কোনো অনুভূতি কাজ করে না। পরক্ষণেই পাগলের মতো লাফাতে শুরু করেন...রিও অলিম্পিকের জন্য শরণার্থীদের ৪৩ জনের বাছাই করা দলে ঠাঁই পেয়ে গেছেন ইয়ুসরা মারদিনি! অতি আনন্দে কোচ ভেন স্পানারকার্ভস সেদিন নিজের মোবাইলখানা ছুঁড়ে মেরেছিলেন ফ্রিজের ভিতর!

     

    কোচ স্পানারকার্ভসের সাথে মারদিনি


    বড় এক গল্পের এ হয়তো শুরু কেবল। ইয়ুসরা স্বপ্ন দেখছেন আগামী টোকিও অলিম্পিকেই একটা পদক জিতে নেওয়ার। সাঁতরে যিনি ফিরে এসেছেন ফেনায়িত সমুদ্রে মৃত্যুর মুখ থেকে, পুলের শান্ত পানিতে তো একদিন না একদিন তিনি ঝড় তুলবেনই। মারদিনি যে বিশ্বাস করেন, "ব্যর্থরাই হেরে গেলে হাল ছেড়ে দেয়, সফলরা হারতে থাকে...না জেতা পর্যন্ত!"

     

    মারদিনির সাঁতার দেখতে চান এক ঝলক? ৮ আগস্ট, সোমবার চোখ রাখুন মেয়েদের ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের হিটে।