দিলশানের পথে, ‘দিলস্কুপ’-এর সাথে
পথচলা। শেষটা জানা নেই, শুরুটা কখন হবে, তাও না। শুরু হলে আবার পথ বেঁকে যায়, গন্তব্য বদলে যায়। মাঝপথে ক্লান্তি আসে, আবার নতুন উদ্যম। নতুন গতিপথ, নতুন লক্ষ্য। তারপর থমকে দাঁড়াতে হয় হঠাৎ করেই। হয়তো পথ বাকী ছিল, হয়তো পথের শেষটা আরও দূরে ছিল। তবুও থামতে হবে। তবুও থামতে হয়। তিলকারত্নে মুদিয়ানসেলাগে দিলশান যেমন থামলেন।
****
পথচলাটা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯৯ সালে, বুলাওয়েতে, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। এক ইনিংস খেলে করতে পারলেন নয় রান, তবে অবদান রাখলেন একটা রান-আউট আর দুইটা ক্যাচে। দিলশান যে শুধু মিডল অর্ডারের একজন ব্যাটসম্যান নন, অলরাউন্ডারও বটে! ব্যাট হাতের দিলশান জ্বলে উঠলেন দশদিন পর। হারারেতে, একই প্রতিপক্ষের সঙ্গে। পাঁচ নম্বরে নেমে করলেন ১৬৩ রান, ব্যাট করলেন ৪৭৯ মিনিট। ওয়ানডে অভিষেকটাও হয়ে গেল সে সফরেই। সে সফরের চার বছর পর টেস্টে দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটা পেয়েছিলেন দিলশান। আর ওয়ানডের প্রথম তিন অঙ্কের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় ১০ বছর! দিলশানের ক্যারিয়ারের পথটা মূলত বদলে গিয়েছিল সে বছরই, ২০০৯ সালে। যখন টেস্টে ওপেনিংয়ে উঠে এসেছিলেন শ্রীলঙ্কার ‘স্টাইলিশ’ বয়।
গল টেস্টে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ওপেনিংয়ে নেমে দিলশান করলেন ৯২ ও ১২৩ রান। দিলশানের মতে, ক্যারিয়ারটাই তাঁর বদলে গিয়েছিল সে টেস্টের পর। অবশ্য তার আগের বছরই ওয়ানডেতে ওপেনিং করেছিলেন। তবে টেস্টে ওপেনিং করাটা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকগুণ! দিলশান যে চাইতেন, এমন পজিশনে খেলবেন, যেখান থেকে দলের জয়টা সহজ বানিয়ে দেয়া যায়। এমন পজিশন নয়, যেখানে খেলতে গিয়ে সঙ্গীর অভাবে পড়তে হয়! দিলশান দলের জয়ে অবদান রাখতে চাইতেন। নিজে উইকেট পেলে তাই উদযাপনটাও করেন বেশ ক্ষিপ্রতায়।
****
কুমার সাংগাকারার তখন অভিষেকই হয়নি। ওপেনিংয়ে জয়াসুরিয়ার সঙ্গে কালুভিতারানা। এরপর আতাপাত্তু, জয়াবর্ধনে। বোলিংয়ে ভাস-মুরালিধরণ। ডি-সিলভা খেলেন তখনও। শ্রীলঙ্কার দলে তখনও ‘৯৬ বিশ্বকাপের সুবাতাস। দিলশান এসেছিলেন সে সময়। সময় গড়িয়েছে। দিলশানের ক্যারিয়ার বদলে গেছে ওপেনিংয়ে আসার পর। ‘বুড়ো’ হয়েছেন যতো, ব্যাটিংয়ে যেন ধার বেড়েছে ততো! ৩৫ বছরের আগে তাঁর ওয়ানডে গড় ছিল ৩৫, সেটাই ৩৫-এর পর হয়ে গেছে ৪৫ এর ওপর! ৩৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন ক্রিকেটাররা বেলাশেষের গান শোনেন, সে সময়েই দিলশান এক পঞ্জিকাবর্ষে তিনবার করেছেন ১০০০ রান! একবার করেছেন ৯৯০। অবশ্যই, ওয়ানডে ক্রিকেটে এমন কীর্তি নেই আর কারও!
ওয়ানডেতে তাঁর ১০০০০ রান আছে। বিশ্বেই এ কীর্তি আছে আর দশজনের। দিলশানের আগে চার লঙ্কান ব্যাটসম্যান ছুঁয়েছিলেন এ মাইলফলক। চারজনের মধ্যে সবচেয়ে কম রান দিলশানের। তবে কিছু জায়গায় এগিয়ে তিনি সবার চেয়ে। ২০১১ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান ছিল তাঁর, আর কোনো লঙ্কান ব্যাটসম্যানের এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড নেই। শুধু ক্রিকেট বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক নন, দিলশান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন ২০০৯ সালে। ফাইনালে ব্যর্থ হয়েছিলেন, দলও হেরেছিল। তবে ২০১৪ সালে সে আক্ষেপ মিটিয়েছিলেন দিলশান, টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য হয়ে।
দিলশান আরও একটা জায়গায় অনন্য। অধিনায়ক হিসেবে তিন ফরম্যাটেই সেঞ্চুরি করা একমাত্র ব্যাটসম্যান দিলশান। পাল্লেকেল্লেতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ১০৩ রান করে ‘ফরম্যাট-সেঞ্চুরি’র চক্র পূরণ করেছিলেন দিলশান। এর আগে অধিনায়ক হিসেবে মাত্র দ্বিতীয় টেস্টেই লর্ডসে করেছিলেন ১৯৩, টেস্টে দিলশানের সর্বোচ্চ স্কোর। আর ২০১০ সালে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ওয়ানডেতে করেছিলেন সেঞ্চুরি। সব ফরম্যাটেই সেঞ্চুরি করা ১১ ব্যাটসম্যানেরও একজন তাই দিলশান।
ওয়ানডেতে আছে ২২টি সেঞ্চুরি, এর চেয়ে বেশী আছে মাত্র সাতজনের। এ ফরম্যাটে ২৫ বার ম্যাচসেরা হয়েছেন দিলশান। লঙ্কানদের জয়াসুরিয়া, সাংগাকারা ও ডি সিলভার শুধু এর চেয়ে বেশীবার ম্যাচসেরা হওয়ার রেকর্ড আছে। ১০০০০ রান ও ১০০ উইকেটের ‘ডাবল’ নেয়া পঞ্চম ক্রিকেটার দিলশান, শ্রীলঙ্কার মধ্যে এ কীর্তি আছে আর শুধু জয়াসুরিয়ার। দিলশানের আবার একটা স্ট্যাম্পড করারও ‘রেকর্ড’ আছে, দিলশান যে শুধু ব্যাটসম্যান, অফস্পিনার বা ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের অন্যতম ভরসাজাগানিয়া ফিল্ডার নন, উইকেটকিপারও!
****
কলম্বো। দুই মহারথি, কুমার সাংগাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনের শেষ ওয়ানডে দেশের মাটিতে। সে ম্যাচের নায়ক? সেঞ্চুরির পর তিন উইকেট নেয়া তিলকারত্নে দিলশান! অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস কি আর এমনি এমনি বলেন, সাংগা-জয়ার চেয়ে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে কম অবদান নয় দিলশানের! তবে বিশ্ব ক্রিকেটে একটা জায়গায় সাংগা বা জয়ারও সেই কীর্তিটা নেই, যা আছে দিলশানের। ডি-সিলভা বা আতাপাত্তুরও নেই। ফুটওয়ার্কে, আক্রমণে তাঁর কথা বলতে গেলে যে শেওয়াগের নাম আসে, সেই শেওয়াগেরও নেই এমন ‘কীর্তি’। দিলশানের নিজের নামে যে একটা শট আছে! ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দিলশান শুরু করেছিলেন, মাথার ওপর দিয়ে স্কুপ খেলা। যে শটের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘দিলস্কুপ’। আধুনিক যুগে কিপারের ঠিক পেছনে কোন অধিনায়কই বা ফিল্ডার রাখেন! আধুনিক যুগের দিলশান তাই শুরু করেছিলেন এ শট, বোলারের লেংথকে হেলাফেলা করে!
জিম্বাবুয়ের সঙ্গে একটা সফরে দুইটা টেস্ট খেলার কথা ছিল শ্রীলঙ্কার। সফরটা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। দিলশান সে সিরিজেই টেস্টে শেষ বলতে চেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত বলতে হয়েছিল আগেই। নতুন কারও জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে যে! যেমন ওয়ানডেতে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। টি-টোয়েন্টিতেও ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
মাস দুয়েক পর চল্লিশ বছর পূর্ণ হবে। গত বছরই ৫২ গড় ও ৯০ স্ট্রাইক রেটে ১২০৭ রান করা ব্যাটসম্যানকে তাই জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। নির্বাচকরা যে ২০১৯ বিশ্বকাপের জন্য চাইছেন নতুন কাউকে। গড়ে ওঠার জন্য দিতে চাইছেন সময়।
দিলশানের পথ তাই শেষ। ওয়ানডেতে আজই শেষ, টি-টোয়েন্টিতে হবে কদিন পরে। নিজের একটা ফ্যাশন হাউস আছে, রেস্টুরেন্টও আছে। হয়তো থাকবেন সেসব নিয়েই। বা আছে দুনিয়াজোড়া টি-টোয়েন্টি লিগ। সেসবে আরও কতবছর খেলবেন, সেটাও বলবে সময়ই।
****
শোয়েব মালিক, তিলকারত্নে দিলশান। গত শতাব্দীতে অভিষেক হওয়ার পরও ওয়ানডে খেলতে নেমেছেন এ বছর এ দুজনই। দিলশান ডাম্বুলায় নামলেন শেষবারের মতো। মিচেল স্টার্কের বলটা আউটসাইড-এজ হয়ে বেড়িয়ে গেল থার্ডম্যান দিয়ে। দিলশানের শেষের শুরু। হ্যাজলউডের পরের ওভারের শেষের বলে শুধু একটা রান নিলেন। স্টার্কের পরের ওভারেই মিললো দেখা, সেই পুরোনো চিরায়ত দিলশানের। ফুল-ফেসে ড্রাইভ, শাফল করে ফ্লিকে বাউন্ডারি। ওভারপিচড বলকে সোজা ব্যাটে মারলেন, অ্যাডাম জ্যাম্পাকে টেনে সুইপ করলেন। দিলশানের পথের শেষ স্টেশনটা তাহলে কি দাঁড়িয়ে আছে আরও একটা মাইলফলক হয়ে! পথ কি তবে বাকি এখনও! নাহ্! ওই হঠাৎ থেমে যাওয়া। জ্যাম্পার ফুলটসে এগিয়ে এসে খেলতে গেলেন, শর্ট মিডউইকেটে হলো ক্যাচ!
দিলশান হেলমেটটা খুললেন। কজন অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ডার এসে অভিবাদন জানিয়ে গেলেন। এলেন উইকেটে সঙ্গী থাকা চান্ডিমাল। পুরো ডাম্বুলা উঠে দাঁড়ালো। দিলশান মাথা নোয়ালেন। গ্যালারিতে দাঁড়ানো পরিবারের দিকে চুমু ছুড়লেন। মাথায় সেই পরিচিত স্কার্ফ, গলায় চেইন। কানে দুল। দাড়ি ‘স্টাইল’ করে কাটা। হাতে পরিচিত ‘সিএ’ ব্যাট। ওয়ানডে ব্যাটিংয়ে দিলশানের পথচলা শেষ।
তবে দিলশানের ‘ঝলক’ বাকী আছে তখনও! অস্ট্রেলিয়ার প্রথম উইকেটটাতেও থাকলো দিলশানের অবদান। ম্যাথিউসের বলে শক্ত হাতে খেলতে গেলেন ওয়ার্নার। পয়েন্টে ক্যাচ গেল। ঝাঁপিয়ে পড়ে নীচু হয়ে যাওয়া বলটা লুফলেন দিলশান। লাফিয়ে উঠে ম্যাথিউস এর আগে উৎকন্ঠায়, ক্যাচ হওয়ার পর উল্লাস। কে জানে, হয়তো আফসোসেরও একটা ঝিলিক খেলা করে গেল লঙ্কান অধিনায়কের মনে। আরও কটা দিন যে তাঁকে পেতে পারতেন দলে!
হলো না। দিলশানের পথচলা শেষ হয়ে গেল। টি-টোয়েন্টিতেও হবে।
যে পথচলায় দিলশান নিশ্চয়ই আনন্দই পেয়েছেন। যেমন পেয়েছে দিলশানকে খেলতে দেখা ক্রিকেটপ্রেমীরা!